উল্লাস ও নৈঃশব্দ

মেসির মতো ফুটবলার থাকলে গুয়ার্দিওলার মতো কোচও আছেন

এরই নাম পেপ গুয়ার্দিওলা। মাত্র গত সপ্তাহেই এই ম্যাচটা তিনি ন্যু কাম্পে ০-৪ হারের পরে অনেকের থেকে শুনেছিলাম, গুয়ার্দিওলা নাকি শেষ হয়ে গিয়েছেন! টিমে তারকা ছাড়া কিছুই করতে পারেন না।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২৪
Share:

বার্সেলোনা-১ (মেসি)

Advertisement

ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-৩ (গুন্দোগান-২, দে’ব্রায়ান)

Advertisement

এরই নাম পেপ গুয়ার্দিওলা।

মাত্র গত সপ্তাহেই এই ম্যাচটা তিনি ন্যু কাম্পে ০-৪ হারের পরে অনেকের থেকে শুনেছিলাম, গুয়ার্দিওলা নাকি শেষ হয়ে গিয়েছেন! টিমে তারকা ছাড়া কিছুই করতে পারেন না।

কিন্তু মঙ্গলবার রাত তো বুঝিয়ে গেল আধুনিক ফুটবলে বিশ্বমানের মগজাস্ত্রের একটা আলাদা দাম আছে। তোমার কাছে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য থাকতে পারে। তোমার কাছে স্কিল থাকতে পারে। কিন্তু কোনও বড়মাপের কোচের পরিকল্পনা মাঝেমাঝে সেই সব কিছু ম্লান করে দিয়ে যেতে পারে।

স্কোরলাইন দেখাচ্ছে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-৩, বার্সেলোনা-১। কিন্তু স্কোরটা তো আসল কথাই বলছে না। সেটা হল, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যকে আটকে দিল একজন কোচের দুর্ধর্ষ গেমপ্ল্যান। মেসি-নেইমারের মতো অবিশ্বাস্য প্রতিভাও আটকে গেল একজন কোচের পরিকল্পনার সামনে। বার্সেলোনার হারটা তো দে’ব্রায়ান বা স্টার্লিংয়ের বিরুদ্ধে ঘটেনি। বরং মেসিদের হারটা ম্যাঞ্চেস্টার ডাগ আউটের সামনে দাঁড়ানো পেপ গুয়ার্দিওলার বিরুদ্ধে ঘটল। যাঁর নিঁখুত গেমপ্ল্যান শান্ত করে রাখল বিশ্বের সম্ভবত সর্বকালের সেরা ফরোয়ার্ড লাইনকে!

মঙ্গলবারের ফল

বেনফিকা-১ : ডায়নামো কিয়েভ-০

আইন্দোভেন-১ : বায়ার্ন মিউনিখ-২

মনশেনগ্ল্যাডবাখ-১ : সেল্টিক-১

লুদোগোরেটস্-২ আর্সেনাল-৩

বাসেল-১ : প্যারিস সাঁ জাঁ-২

আটলেটিকো মাদ্রিদ-২ : রস্তভ-১

স্বভাবতই সবার এ বার মনে হচ্ছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গ্রুপ রাউন্ডের এই ফিরতি ম্যাচটায় কী এমন চাল দিলেন গুয়ার্দিওলা যে, পুরো মাত হয়ে গেল বার্সা?

ঘরের মাঠে সিটি কোচের সবচেয়ে বড় চাল ছিল ট্রায়াঙ্গুলার কভারিং। মেসি-নেইমার-সুয়ারেজের মতো ফুটবলারদের জন্য তিন জন মার্কার রেখে দেওয়া। একজন কেটে যাবে তো বাকি দু’জন সাপোর্টে যাবে। বিপক্ষ বল ধরলে কোনও এগোনোর রাস্তা দেওয়া চলবে না।

গুয়ার্দিওলার মতো চতুর কোচ জানতেন, বল পজেশন বা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যয় বার্সা দলের ধারেকাছে নেই তাঁর সিটি টিম। তাই একের বদলে এগারোর উপর নির্ভর করতে হবে। স্ট্রাইকারদেরও নীচে নামিয়ে রাখতে হবে। আবার দরকারের সময় উইংব্যাকদেরও ওভারল্যাপে পাঠাতে হবে। অর্থাৎ গেমপ্ল্যানটা সাজা হবে পুরোপুরি গতির উপর। স্কিলের উপর নয়। এক-একজন ফুটবলারকে চার জনের ওয়ার্ক লোড নিয়ে খেলতে হবে। কেউ কোনও নির্দিষ্ট পজিশনে দাঁড়িয়ে থাকবে না। বরং বিপক্ষের মুভমেন্ট অনুযায়ী নিজেদের পজিশন পাল্টাবে। মেসির গোলে বার্সা এগিয়ে যাওয়ার পরেও তাই একটুও সেই ছক পাল্টায়নি ম্যান সিটি।

গুয়ার্দিওলার এই গেমপ্ল্যান মাঠে দারুণ কার্যকরী করতে পেরেছিল তাঁর ফুটবলাররা। আগেরো, স্টার্লিং, গুন্দোগানরা ক্রমাগত উপর-নীচ করতে থাকে। সুয়ারেজ বা মেসি বল পেলেই ঘিরে নিচ্ছিল সবাই। কোনও এগোনোর জায়গা দিচ্ছিল না। পাসিং আউটলেটগুলো বন্ধ করে দেয়। যাতে বল পেলেও নীচ থেকে সাপোর্ট পাওয়ার সুযোগ না থাকে বার্সার কাছে।

সের্জিও আগেরো গোটা ম্যাচে বিপক্ষ ডিফেন্সকে চাপে ফেলে গেল। বক্সের আশপাশ থেকে সব সময় মাসচেরানো-উমতিতিদের সমস্যায় ফেলছিল। প্রচণ্ড গতিতে কাউন্টার করছিল। খেলাটা ছড়াচ্ছিল। সিটি যে গোলে সমতা ফেরাল, তার পিছনে কেন্দ্রীয় চরিত্র তো আগেরো-ই। যার পাস থেকে স্টার্লিং যেন প্লেটে করে বলটা সাজিয়ে দিয়েছিল গুন্দোগানের জন্য।

দে’ব্রায়ান যেন আবার মাঝমাঠের সেই ফুটবল আর্টিস্ট। যার সূক্ষ্ম কয়েকটা টাচ মাঝমাঠ দখলে নিতে সাহায্য করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দে’ব্রায়ানের ফ্রি-কিকটাও নিঁখুত ছিল। গুন্দোগানকে দেখেও বুদ্ধিদীপ্ত প্লেয়ারের প্রমাণ পেলাম। ঠিক সময় ঠিক জায়গায় থাকছিল। দুটো গোলও করল। আর সিলভা? উফ, কী অসাধারণ ফুটবলার! যেমন প্রথম টাচটা, তেমনই পাসিং সেন্স। মাঝমাঠেই তো আসল খেলাটা জিতে বেরিয়ে গেল ম্যান সিটি।

গুরু বনাম শিষ্য: ১-১। ফিরতি ম্যাচে গোল করেও হার বাঁচাতে পারলেন না মেসি। ছবি: রয়টার্স।

ওটামেন্ডি-স্টোনসেরও প্রশংসা করতে হবে। দুই সেন্টার ব্যাক গোটা ম্যাচ জুড়ে পজিশনিং ঠিক রেখেছিল। ফাইনাল ট্যাকলে যায়নি। জায়গা ছোট করে দিচ্ছিল। বার্সেলোনার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দলে ব্যালান্স নেই। ফরোয়ার্ডে স্বপ্নের ত্রিফলা। ব্যাকলাইনটা আবার কোনও দুঃস্বপ্নের থেকে কম কিছু নয়। উমতিতি বলে ছেলেটা বারবার খারাপ ট্যাকল করে গেল। ওর দু’-একটা ট্যাকল তো পেনাল্টি ছিল, কিন্তু রেফারি দিলেন না। আগেও বলেছি, আবার বলছি — মাসচেরানো দিয়ে আর হবে না। ওর যা দেওয়ার ছিল দিয়ে দিয়েছে। নতুন করে আর কিছু দেওয়া বাকি নেই। গতি হারিয়েছে। ট্যাকলিং ক্ষমতা হারিয়েছে। ট্র্যাক ব্যাক করার দম নেই। স্টার্লিং তো যেন নাচিয়ে-নাচিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

বার্সা দলের ইউএসপি হচ্ছে পাসিং। কিন্তু এত খারাপ পাসিং আগে কোনও দিন করতে দেখিনি মেসিদের। প্রথম গোলটা তো মিসপাস থেকেই খেল। সহজ সহজ স্কোয়ার পাস করতেও পারছিল না! বিশেষ করে দুই উইং ব্যাক সের্জি আর ডিগনে। যে দলের ডিএনএ-তে এক বার মিসপাস ঢুকে যায় সেই রাতে তাদের সাফল্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।

বার্সার আর এক সমস্যা হচ্ছে দলে কোনও ইনিয়েস্তা ছিল না। আমি বারবার বলে এসেছি বার্সার ব্লু-প্রিন্টে ইনিয়েস্তা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওর মতো বল প্লেয়ার খুব কমই আছে গোটা ফুটবলবিশ্বে। বল নিয়ে ব্যালান্স, ড্রিবল করে এগিয়ে যাওয়া— ইনিয়েস্তা মানে কমপ্লিট ফুটবল। কিন্তু ওর চোট থাকায় বদলি আন্দ্রে গোমেস কিছুই করতে পারল না। রাকিটিচও সাপোর্ট না পেয়ে যতক্ষণ মাঠে ছিল ততক্ষণ সে রকম চোখ কাড়ার মতো কিছু করেনি।

মেসি কিন্তু চেষ্টা করেছে। বার্সার যতটুকু যা আক্রমণ তৈরি হয়েছে মেসি তার পিছনে ছিল। গোলটাও দারুণ করল। কিন্তু বিশ্বফুটবলে যেমন মেসির মতো দক্ষ ফুটবলার আছে, তেমনই আবার গুয়ার্দিওলার মতো কোচও আছেন। সেটাই হাড়ে হাড়ে টের পেল বার্সা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন