ক্রিকেট ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন ফুটবল

আরও অঘটন ঘটাতে পারি আমরা, হুঙ্কার গুরপ্রীতের

ক্রিকেটকে প্রত্যাখ্যান করা সেই খুদেই ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হয়ে উঠলেন। তিনি, গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু। চব্বিশ ঘণ্টা আগে দোহায় যিনি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে এশিয়া-সেরা কাতারের বিরুদ্ধে একা কুম্ভ হয়ে লড়ে বাঁচালেন ভারতকে। 

Advertisement

শুভজিৎ মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:১৮
Share:

দুর্ভেদ্য: গুরপ্রীত প্রাচীরেই আটকে গিয়েছিল কাতারের আক্রমণ। রয়টার্স

বছর সাতেকের ছেলেকে নিয়ে মোহালিতে পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার অ্যাকাডেমিতে গিয়েছিলেন তাজিন্দর সিংহ সাঁধু। কিনে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের যাবতীয় সরঞ্জামও। অথচ মাত্র দু’-তিন দিন অনুশীলন করার পরেই মোহভঙ্গ। একরত্তি ছেলে যে তখন স্বপ্ন দেখছে ফুটবলার হবে।

Advertisement

ক্রিকেটকে প্রত্যাখ্যান করা সেই খুদেই ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হয়ে উঠলেন। তিনি, গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু। চব্বিশ ঘণ্টা আগে দোহায় যিনি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে এশিয়া-সেরা কাতারের বিরুদ্ধে একা কুম্ভ হয়ে লড়ে বাঁচালেন ভারতকে।

গুরপ্রীতের জেদের কাছে হার মেনেছিলেন পঞ্জাব পুলিশের আধিকারিক তাজিন্দর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন চণ্ডীগড়ের সেক্টর ৪৫-এর সেন্ট স্টিভন স্কুলের ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। বুধবার মোহালি থেকে ফোনে তাজিন্দর বলছিলেন, ‘‘মোহালি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ থাকলেই আমার দায়িত্ব পড়ে নিরাপত্তা সামলানোর। তখন থেকেই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন দেখতাম।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘আমাদের পরিবারে খেলাধুলোর চল খুব একটা নেই। গুরপ্রীতের মা হরজিৎ কৌর সাঁধু আমার মতোই পুলিশে কর্মরত। এই কারণেই ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছিলাম মোহালি স্টেডিয়ামের পিছনের পিসিএ-র অ্যাকাডেমিতে। ভাবতেই পারিনি, ও দু’-তিন দিন অনুশীলনে যাওয়ার পরে ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত ওর কথাই মেনে নিলাম। ভর্তি করিয়ে দিলাম স্কুলের ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। ও সবার চেয়ে লম্বা বলে কোচ গোলকিপিং করার পরামর্শ দিলেন। স্কুলের অ্যাকাডেমিতে খেলার সময়ই অনূর্ধ্ব-১৪ রাজ্য দলে সুযোগ পায়। অভিষেকের বছরেই জাতীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন।’’

Advertisement

ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলকে বেছে নেওয়ার কারণ কী? বুধবার দোহা থেকে বেঙ্গালুরু ফিরেছেন গুরপ্রীত। হাসতে হাসতে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘মোহালিতে সবাই ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকত। ফুটবল নিয়ে কারও আগ্রহ ছিল না। তাই ফুটবলারই হব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।’’

গুরপ্রীত যে ভবিষ্যতে ভারতীয় ফুটবলের সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন, তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ইউথ ডেভেলপমেন্টের প্রধান কলিন জোসেফ টোল। তিনিই গোয়ায় ফেডারেশনের অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যান প্রতিশ্রুতিমান গোলরক্ষককে। সেই সময় ভারতীয় দলের আর এক প্রাক্তন তারকা তনুময় বসু ছিলেন অ্যাকাডেমির গোলরক্ষক কোচ। প্রথম দর্শনে তিনি যদিও খুব একটা প্রভাবিত হননি। কাতারের বিরুদ্ধে গুরপ্রীতের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তনুময়কে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অতীতে। তিনি বললেন, ‘‘কলিন টোলকে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যর, এই ছেলেটাকে কেন বাছলেন? ওঁর জবাব ছিল, গুরপ্রীতের উচ্চতা দারুণ। ওকে ঠিকমতো তৈরি করতে পারলে আন্তর্জাতিক মানের গোলরক্ষক হবে।’’ কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খেলেন তনুময়। কেন? বললেন, ‘‘গুরপ্রীতের প্রধান সমস্যা ছিল নিচু হয়ে আসা বল একদম ধরতেই পারত না। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। দু’বেলা ওকে অনুশীলন করাতাম। কখনও গোয়ার সমুদ্রসৈকতে নিয়ে যেতাম। কখনও আবার মাঠেই অনুশীলন করাতাম। গুরপ্রীতের সব চেয়ে বড় গুণ ছিল, পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও কথা শোনা।’’ তনুময় যোগ করলেন, ‘‘কখনও বলেনি, স্যর, আর পারছি না। নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় গুরপ্রীতকে এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।’’

ফেডারেশনের অ্যাকাডেমিতে থেকেই ২০০৯ সালে গুরপ্রীতকে সই করায় ইস্টবেঙ্গল। যদিও প্রথম বছর ফেডারেশনের দল ইন্ডিয়ান অ্যারোজের হয়েই খেলেন তিনি। পরের বছর যোগ দেন লাল-হলুদে। সেই সময় কোচ ছিলেন ট্রেভর জেমস মর্গ্যান। প্রাক্তন ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত মর্গ্যান বললেন, ‘‘আমি এখন ইংল্যান্ডে। তাই ম্যাচটা সরাসরি দেখতে পারিনি। ইন্ডিয়ান অ্যারোজ থেকে আসা গুরপ্রীতকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উচ্চতার কোনও ভারতীয় গোলরক্ষক আমি এর আগে কখনও দেখিনি। অনুশীলনে কখনও ফাঁকি দিত না। এমনিতে শান্ত। কিন্তু মাঠের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রাসী ও অকুতোভয়। আরও অনেক দূর যাবে গুরপ্রীত।’’ ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গুরপ্রীত যোগ দিয়েছিলেন নরওয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনে স্তেবাক এফসি-র হয়ে। একমাত্র ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন ইউরোপা কাপ। তার পরে দেশে ফিরে সই করেন বেঙ্গালুরু এফসিতে। মুগ্ধ ভাইচুং ভুটিয়া বলেছেন, ‘‘গুরপ্রীত অনবদ্য। ওর জন্যই এশিয়ার সেরা দল কাতারের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করতে পেরেছি।’’

দুরন্ত সাফল্যের পরেও আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত গুরপ্রীত। এমনকি, কাতারের বিরুদ্ধে ম্যাচকে জীবনের সেরা পারফরম্যান্স বলতেও রাজি নন। বললেন, ‘‘অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স বলা যেতে পারে। আমি নিজের শুধু কাজটা করে গিয়েছি। আমাকে আরও উন্নতি করতে হবে। আমি মনে করি, সেরা পারফরম্যান্স এখনও দেখাতে পারিনি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এই ম্যাচটাকে জীবনের সেরা বাছলে ভবিষ্যতে নিজেকে উজ্জীবিত করতে সমস্যা হবে।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, কাতারের বিরুদ্ধে ওদের ঘরের মাটিতে পয়েন্ট অর্জন করাটা দারুণ তৃপ্তিদায়ক। এ বারের কোপা আমেরিকাতেও খেলেছে এশিয়া চ্যাম্পিয়নেরা।’’

কাতারের বিরুদ্ধে ড্র করায় ভারতের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গুরপ্রীত বলছিলেন, ‘‘কাতারের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে কোচ ইগর স্তিমাচ বলেছিলেন, কখনও ভয় পাবে না। সবাই মিলে লড়াই করতে হবে। তাই এই ছন্দটা ধরে রাখতে পারলে আরও অঘটন ঘটাতে পারি আমরা।’’ সুনীল ছেত্রীকে ছাড়া খেলা কতটা কঠিন ছিল? গুরপ্রীতের জবাব, ‘‘কঠিন তো ছিলই। সুনীল ভাই আমাদের দারুণ ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে।’’

বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে ভারতের পরের ম্যাচ ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কলকাতায়। এই মুহূর্তে ফুটবলারেরা ফিরে গিয়েছেন ক্লাবে। ইগর অবশ্য বাংলাদেশ ম্যাচের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘ছেলেদর জন্য গর্বিত। আশা করছি, কলকাতায় আমাদের সমর্থন করতে আশি হাজার দর্শক আসবেন স্টেডিয়ামে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন