জাতীয় দলের জার্সিতে ললিত উপাধ্যায়।
হস্টেলের ফোনটা ঘনঘন বেজে উঠছিল। আশপাশের মানুষগুলোর মুখ ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল। সঙ্গে ব্যবহারও। একটা ফোন এসেছিল তাঁর জন্যও। তার পরই বদলে গেল তাঁর দুনিয়াটাও। বদলে গেল পাশের মানুষগুলো।
ওই দিনটি ভুলতে পারেন না। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় আতঙ্কে। ঘুমের মধ্যেই বলে ওঠেন, ‘‘আমি কিছু জানি না।’’ সে দিন এই কথাটাও যে বলতে পারেননি ১৭ বছরের ছেলেটি। শুধু অবাক হয়ে ভেবেছিলেন, ‘‘আমি কী করলাম। কিছুই তো করিনি।’’ কলকাতা সাইয়ে দাঁড়িয়ে সেই স্মৃতি মনে করতে আজও চোখে মুখে ফুটে ওঠে সেই কষ্ট। ভারত পেট্রোলিয়ামের হয়ে বেটন কাপ খেলতে এসেছেন। দল ফাইনালে। সামনে ইন্ডিয়ান অয়েল। জাতীয় দলে ফিরেছেন। দলের জন্য এখন অপরিহার্য তিনি। কিন্তু দীর্ঘ অন্ধকার সময় কাটিয়ে ফেরা।
আট বছর আগের সেই স্মৃতি এখনও তাড়া করে ললিত উপাধ্যায়কে। দিন বদলেছে, বদলেছে জীবনের চালচিত্রও। ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলো আজ অতীত। তবুও মন থেকে মুছে যায়নি অন্ধকার সেই দিনগুলো। জাতীয় স্তরের এক টেলিভিশন চ্যানেলের একটা স্টিং অপারেশন কী ভাবে হকি থেকে ছিটকে দিয়েছিল উদীয়মান এই হাফ ব্যাককে। বলতে গেলে এখনও গলা কেঁপে ওঠে। গুছিয়ে উঠতে পারেন না সবটা। বলেন, ‘‘স্টিং অপারেশন কী বুঝতেই আমার অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। সবাই শুধু বলছিল কোনও এক চ্যানেল কিছু একটা করেছে যাতে আমার নাম নেওয়া হয়েছে।’’ একটু থেমে আরও বলেন, ‘‘কী করেছে সেটা কেউ বলতে পারছিল না। চ্যানেল, আমার নাম, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি সিনিয়র শিবিরে সবে সুযোগ পেয়েছি। বাড়ি থেকে ফোনটা এসেছিল ওখানেই।’’
বারাণসীর বাড়িতে বসে যখন হকির স্বপ্ন দেখতেন ললিত তখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁর পরিবারের। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি তিনি। তাঁর মধ্যে থেকেই লড়াই চলতে থাকে। একটা সময় ডাকও চলে আসে সিনিয়র জাতীয় শিবির থেকে। পরিবারে তখন খুশির হাওয়া। অনেক কষ্টের মধ্যেও পরিবারের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছিল ললিতের এই সাফল্য। ঠিক পিছনেই যে অপেক্ষা করেছিল অন্ধকার সময় কে জানত।
বেনারসের ঘাটে বসে ললিত উপাধ্যায়। একদিন বদলে গিয়েছিল সবটাই।
আরও খবর: ‘ট্রাক নিয়ে বাবা এখন বাংলাদেশ সীমান্তে, দেখা হবে বলেছে’
সেই সময় ভারতীয় হকি পরিচালনা করত ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশন। সচিব ছিলেন জ্যোতিকুমারন। তাঁকে ঘিরে অনেক দিন ধরেই চলছিল নানা জল্পনা। তাঁকেই হাতে নাতে ধরতে চেয়েছিল সেই টেলিভিশন চ্যানেল। দিনটি ছিল ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল। উত্তরপ্রদেশের প্রোমোটার সেজে জ্যোতিকুমারনের অফিসে হাজির হয়েছিলেন সেই চ্যানেলের সাংবাদিক। তিনি জ্যোতিকুমারনকে পাঁচ লাখ টাকা অফার করেন একটি টুর্নামেন্টের স্পনসরের জন্য। কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল আগামী মাসে আজলান শাহর জন্য যে সিনিয়র দল নির্বাচন হবে তাতে রাখতে হবে উত্তরপ্রদেশের এক প্লেয়ারকে। সেই সময় জ্যোতিকুমারকে দু’লাখ টাকা দেন তিনি। পুরো ঘটনাটিই ধরা পড়ে ক্যামেরায়। সঙ্গে পুরো কথোপকথন। বাকি তিন লাখ টাকা কাজ হয়ে গেলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এই দু’লাখ টাকা দিল্লির এক পাঁচতারা হোটেলে ১০ ও ১১ এপ্রিল দু’ভাগে দেওয়া হয়। ২১ এপ্রিল সেই চ্যানেলে ফাঁস করা হয় পুরো স্টিং অপারেশনের ভিডিও। আর তখনই ঘটে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।
সব কিছু থেকে অনেক দুরে তখন ভবিষ্যতের স্বপ্নে মশগুল ললিত উপাধ্যায়। সেই সময় শিবিরে উত্তরপ্রদেশ থেকে ছিলেন তিনি একাই। টেলিকাস্টের সময় জানায়, সেই প্লেয়ারের নাম বদলে দেওয়া হয়। আর তখনই পুরো সন্দেহটা ঘুরে যায় ললিতের দিকে। এখনও অবাক হয়ে ললিত বলেন, ‘‘দু’লাখ টাকা কেমন দেখতে লাগে এক সঙ্গে সেটাই জানতাম না। ভাল খাওয়ার কথাই যারা ভাবতে পারেন না তারা কী করে ঘুষ দেওয়ার কথা ভাববে বলতে পারেন।’’ এই স্টিং অপারেশন টেলিকাস্ট হওয়ার পর পদত্যাগ করেন জ্যোতিকুমারন। ভেঙে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশন। অলিম্পিক্সে প্রথম অংশ নেওয়ার ৮০ বছর পর প্রথম ২০০৮-এ যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় ভারতীয় হকি দল। এর পর তৈরি হয় হকি ইন্ডিয়া। ভারতীয় হকির এক অন্ধকার অধ্যায়। আর তার শিকার এক ১৭ বছরের উদীয়মান হকি প্লেয়ার।
ধনরাজ পিল্লাইয়ের সঙ্গে ললিত। যাঁ হাত ধরে আবার হকিতে ফেরা।
‘‘তার পর বাদ পড়লাম জাতীয় শিবির থেকে। চার বছর কেউ ডাকেনি। বাড়িতে ফেরার পর দেখলাম সবাই কেনম সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আমার পরিবার এক ঘরে হয়ে গিয়েছে। কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলে না। এর পর পাশে এসে দাঁড়ান ধনরাজ স্যার (ধনরাজ পিল্লাই)। স্যার না থাকলে আমার ফেরা হত না। হকি ছেড়ে দেব ভেবেছিলাম। ধনরাজ স্যার তখন আমাকে এয়ার ইন্ডিয়া দলে খেলার সুযোগ করে দেন স্টাইপেন্ডের বিনিময়ে,’’ অনর্গল বলে যান ললিত উপাধ্যায়।
জীবনের মোর ঘুরিয়ে দেয় ওয়ার্ল্ড হকি সিরিজ। সেটা ২০১২ সাল। সেখানে খেলেই ‘রুকি প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’এর পুরস্কার তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনে মূলস্রোতে। ততদিনে সেই চ্যানেলও জানিয়ে দিয়েছে ললিত সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণাই ছিল না। ওরা একটা মনগড়া কাহিনি বানিয়েছিল। যেটা মিলে গিয়েছিল ললিতের সঙ্গে। একটা ছোট্ট ভুলকে ঠিক করতে গিয়ে বিরাট একটা ভুলের শিকার হয়ে গিয়েছিলেন ললিত। জাতীয় দলের স্বপ্নের নীল জার্সিটা ফেরত পান ২০১৪ সালের হকি বিশ্বকাপে। তার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বদলে যাওয়া মুখগুলো ফিরেছে পুরনো ফর্মে। শুধু নিজেকে অনেকটাই বদলে নিয়েছেন ললিত উপাধ্যায়। আজ তিনি অভিজ্ঞ। জীবন চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। তাই হয়তো সে দিন হকি ছাড়ার কথা ভাবা ললিত আজ বলেন, ‘‘হকির জন্য জান হাজির।’’
ছবি: সংগৃহীত।