ধোনি আর সৌরভ দু’জনের কাছেই অনেক শিখলাম

এটিকে ম্যাচে টিভি ক্যামেরা সহজে পেয়ে যেত তাঁকে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে ভিআইপি লাউঞ্জের বাঁধাধরা জায়গায় রোজ বসেন। অথচ আইপিএলে অনেক ম্যাচেই মাঠে আসছেন না।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০৪:০০
Share:

দিল্লি ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতে সঞ্জীব গোয়েন্কা। ছবি গৌতম ভট্টাচার্য

এটিকে ম্যাচে টিভি ক্যামেরা সহজে পেয়ে যেত তাঁকে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে ভিআইপি লাউঞ্জের বাঁধাধরা জায়গায় রোজ বসেন। অথচ আইপিএলে অনেক ম্যাচেই মাঠে আসছেন না। এ দিন কোটলায় থেকেও ডাগআউটের কাছাকাছি নেই। কিন্তু এক-একটা হারের পর রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস মালিক
সঞ্জীব গোয়েন্‌কা-কে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগের দুপুরে এবিপি-র সামনে তিনি। কখনও সাবধানী, কখনও বিস্ফোরক। এটা শেষ করেই নাকি ধোনির সঙ্গে দিল্লি ম্যাচের এগারো নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা।

Advertisement

প্রশ্ন: কলকাতা থেকে এই মুহূর্তে দিল্লি আসা মানে লোকে একটা প্রশ্ন অবধারিত করবে— দিদি কত সিট পাচ্ছেন? আর আইপিএল টিম মালিক মানে তাঁকে আরও একটা বাড়তি প্রশ্ন করবে। আপনার টিমের কী আশা দেখছেন?

দুটোরই জবাব চাইব।

Advertisement

সঞ্জীব: হুমম। আমি বিশ্বাস করি গত পাঁচ বছরে আমাদের রাজ্য অনেক উন্নতি করেছে। যে ভাবে রাজ্য এগিয়েছে তাতে আমরা খুশি। চাইব একই ভাবে এগিয়ে যেতে। এই উন্নতির ধারা বজায় রাখতে।

প্র: এটাই উত্তর?

সঞ্জীব: এটাই উত্তর (হাসি)।

প্র: পুণে?

সঞ্জীব: পুণে আশানুরূপ খেলতে পারেনি এখনও। তবে একটা কথা মনে রাখবেন। আমাদের পাঁচটা টপ প্লেয়ারের মধ্যে চারজন ইনজিওর্ড হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যের মার ছাড়া আর কী! নিজেদের মাঠে সব ম্যাচ খেলতে পারছি না। এগুলো নানা সমস্যা। তবু আমরা অনেক লড়েছি। সামান্য এ দিক-ও দিক হলে অন্তত আরও দুটো ম্যাচ আমাদের জেতার কথা। ক্লোজ হেরে গেলাম ম্যাচগুলো। তবে একটা প্রমিস এখনই করে রাখছি যে, নেক্সট ইয়ার আমাদের অন্য খেলা দেখবেন।

প্র: স্পোর্টসে এ রকম প্রমিস আগাম করা যায় নাকি?

সঞ্জীব: বললাম তো, একই ভুল আমরা আর করব না।

প্র: সেগুলো কী?

সঞ্জীব: পরের বার আমরা মুক্ত মনে ঝাঁপাব। আমাদের ভেবেই নামতে হবে যে, জেতা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। চেষ্টা করতে হবে কোনও ব্যাগেজ ছাড়া খেলতে। কী হয় জানেন, যখন আপনি নিজের খ্যাতি অক্ষত রাখতে নামবেন তখন আপনার মনোভাবটা টিমের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে যায়।

আমি এটুকু বুঝি যে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জিততে হলে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে হয়। যার কোনও খ্যাতি নেই তাকে নিয়ে অনেক সময় চলার সুবিধে হল, সে কোনও কিছু মাথায় না রেখে জেতার জন্য ঝাঁপায়। আর এই ফর্ম্যাটে কখনও কখনও খ্যাতিমানদের চেয়ে টিমের পক্ষে বেশি উপকারী হয়ে যায়।

প্র: এর পর আর স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে ঢুকছি না। কিন্তু একটা সত্যি কথা বলুন। আন্তোনিও হাবাসকে মিস করছেন না ক্রিকেটে? কখনও মনে হচ্ছে না, আমার একটা হাবাস থাকলে সব কিছু ঠিক করে দিত?

সঞ্জীব: না, ফ্লেমিং ইজ আ গ্রেট কোচ। হাবাসকে আমি রেসপেক্ট করি কিন্তু ফ্লেমিংকে আরও বেশি করি। যদি আমাকে বেছে নিতে বলেন দু’জনের মধ্যে, আমি ফ্লেমিং বাছব। হাবাস খুব বদমেজাজি। প্লেয়ারদের সঙ্গে সব সময় ওর যোগাযোগ ভাল থাকে না। হাবাস নিশ্চয়ই বড় কোচ কিন্তু টিম নিয়ে চলতে পারে না।

প্র: তাতে কী এল গেল? হাবাস তো আপনাকে সাফল্য দিয়েছেন?

সঞ্জীব: আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটা কতটা হাবাসের জন্য, কতটা টিমের জন্য, সেটা আমরা এ বার দেখব।

প্র: কোথাও যেন মনে হচ্ছে আইএসএলে সফল দৌড় আপনার অভ্যেস এমন খারাপ করে দিয়েছে যে, ক্রিকেটে প্রথম বছর সাকসেস না পেয়ে আপনি দ্রুত অধৈর্য হয়ে পড়ছেন।

সঞ্জীব: না, না তা কেন। সাফল্য তো আপনাকে আরও দায়িত্ববান আর পরিশ্রমী করে যে, এটাকে ধরে রাখতে হবে। ফ্যানদের ভালবাসার আরও মর্যাদা দিতে হবে।

প্র: আইএসএলে যেমন আপনাকে নিত্যদিন মাঠে দেখা যায়, আইপিএলে কিন্তু দু’চার দিন বাদ দিলে আপনি অদৃশ্য। ডাগআউটের আশেপাশে নেই। টিম ওনার্স লাউঞ্জেও কম। এত লো-প্রোফাইল কেন?

সঞ্জীব: কারণ কোনও অহংকারের কোশেন্ট আইপিএল টিম মালিক হওয়ার পেছনে নেই। আইএসএলে তো ব্যাপারটাই এমন যে, প্লেয়াররা প্লেয়ার। সেলিব্রিটি কেউ নয়। আমার সিদ্ধান্তের পেছনে সেখানে একটাই লক্ষ। ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি করা। গ্রাসরুট থেকে প্লেয়ার তুলে আনা। এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, ভারতীয় ফুটবল কোনও ভ্যানিটি কোশেন্ট জোগায় না। আইপিএল সেখানে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সবাই সেলিব্রিটি। তবু আমি খুব সচেতন ভাবেই দূরে থাকছি। দূর থেকেই এনজয় করছি।

প্র: এই ফুটবল আর ক্রিকেট টিম কিনতে গিয়ে আপনি এমন দু’জনের সান্নিধ্যে এসেছেন যাঁরা ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক হিসেবে পরিচিত। বলা যায় সেরা দুটো স্পোর্টিং মাইন্ড।

সঞ্জীব: সত্যি।

প্র: যদি ধোনি আর সৌরভ দু’জনের তুলনা করা যায়, তা হলে কোন শাসনব্যবস্থাটা জ্যোতিবাবুর আমলের সিইএসসি? কোনটা মমতার আমলের সিইএসসি?

সঞ্জীব: এই রে (হাসি)।

প্র: আরে বলুন না।

সঞ্জীব: আমি শিওর নই এ ভাবে ধোনি আর সৌরভের তুলনা করা যায় কি না। আমি মনে করি ওরা দু’জনেই নেতা হিসেবে ন্যাচারাল। ওরা দু’জনেই ব্রিলিয়ান্ট। যে কোনও বাহিনীকে লিড করতে পারে। ওদের সাফল্যটা তাই অনিবার্য ছিল। আমি নিজে অন্তত যত বার ওদের সঙ্গে কথা বলি, কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করি।

প্র: আপনি নিজে এত বড় সংস্থা চালান। আপনার বাবাকে দেখেছেন। ক্যাপ্টেন্স অব দ্য ইন্ডাস্ট্রি যাঁদের বলা হয়, তাঁদের চেনেন। এর পর সৌরভ-ধোনির কাছে নতুন কী শেখার থাকতে পারে?

সঞ্জীব: শেখার হল ওদের যে কোনও জিনিসকে দেখার ধরন। কী করে ওরা উৎপটাং পরিস্থিতিগুলো সামলায়? বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কী ভাবে ডিল করে? কী করে কঠিন পরিস্থিতিতে আউট অব দ্য বক্স ভাবে? কী করে মানুষকে নিয়ে চলে? বিশেষ করে যারা খুব টেম্পারামেন্টাল। ইমোশন নিয়ে কী ভাবে ডিল করে? এগুলো আমি শেখার এক-একটা ধাপ হিসেবে দেখি। হয়তো খুব ছোট ছোট জিনিস, কিন্তু শিখে নিলে ক্ষতি কী। যে ভাবে হয়তো সৌরভ সল্টলেক স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখে গেটের লোকটার দিকে মিষ্টি হাসে। বা ধোনি যে ভাবে বোলারকে বলে, ঠিক এই সময় ফুল লেংথ করো। ওদের মাইন্ডটা যে ভাবে কাজ করে, সেটা খুব রোমাঞ্চকর।

প্র: নেতা হিসেবে ওঁদের মিল কোথায়?

সঞ্জীব: কোনও মিল নেই। ওরা একদম ভিন্নধর্মী। একটাই মিল, দু’জনের মন সাঙ্ঘাতিক। দু’জনেই জেতার জন্য একই রকম রুক্ষ। কিন্তু স্টাইলটা সম্পূর্ণ আলাদা।

প্র: আপনাকে যদি বেছে নিতে বলা হয় কার লিডারশিপ মডেল বাছবেন? ধোনি না সৌরভ?

সঞ্জীব: আমি কেন একজনের মধ্যে চুজ করতে যাব? আমি বরং দু’জনেরই সেরাটা নেব (হাসি)।

প্র: কিন্তু এই যে বলা হয় ধোনির ক্যাপ্টেন্সি মডেল বোঝা যায় না। এ বার তো পুণের অন্দরমহলে এমনও শোনা যাচ্ছে যে, হাবাস যেমন স্বৈরতান্ত্রিক ভাবে এটিকে টিম চালাতেন। ধোনিও তাই করছেন। ক্যাপ্টেন হয়েও স্ট্র্যাটেজি মিটিংয়ে পর্যন্ত থাকছেন না। কতটা সত্যি?

সঞ্জীব: যেগুলো একান্তই টিম ম্যানেজমেন্টের ইস্যু, তা নিয়ে খোলাখুলি খবরের কাগজে কথা বলাটা আমার পক্ষে অনুচিত হবে। অন্যায়ও হবে। আমি এ ভাবে দেখি যে, এক-একজন মানুষের অপারেশনের এক-এক রকম ধরন। দিনের শেষে সাফল্য এল কি না, সেটাই আসল বিচার।

প্র: অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা শোনা যায় ভীষণ বেশি প্লেয়ারদের ওপর নাক গলান। কোনও কোনও প্লেয়ার তিক্ত হয়ে এমনও বলেছে যে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার চেয়ে ইন্ডিয়া ক্যাপ পরে নামা অনেক বেশি রিল্যাক্সিং। আপনি কেমন মালিক? খুব বেশি খবরদারি করেন কি?

সঞ্জীব: আমি টিমের সঙ্গে কয়েক বার মিটিং করেছি। আমি চেষ্টা করি খুব কাছে না ঘেঁষার। তবে খুব বেশি উঁকিঝুঁকি মেরেছি বলে মনে হয় না। প্লেয়াররাই হয়তো এর ঠিক উত্তর দিতে পারবে।

প্র: বারবার করে এই যে ম্যাচ হারার চাপ, এটা হজম করা কতটা কঠিন? বিশেষ করে আইএসএলের তুলনায় আপনার ক্রিকেট মাঠের হারাটা যখন অনেক বেশি বিজ্ঞাপিত?

সঞ্জীব: হার-জিত দুটোই খেলার অঙ্গ। দুটো থেকেই শিখতে হয়। হ্যাঁ, পরপর হারতে কার ভাল লাগে? জিততে জিততে ওই শেষ ওভারে হেরে যাওয়া খুবই মর্মান্তিক। কিন্তু আমি এ ভাবে দেখছি যে, হারাটাকেও পজিটিভ ধরে নিয়ে এগোতে হবে। যাতে পরের বছর কাজে লাগাতে পারি।

প্র: এ বারের অভিশপ্ত অভিযানের পজিটিভ কী কী?

সঞ্জীব: একটা তো বললামই— টিম মননের অন্য রকম কন্ডিশনিং যে, জেতা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। আর একটা, টিমের সাইজ কেটে ছোট করে আনা। অবাঞ্ছিত অংশকে বাদ দেওয়া। ট্রিম করতে হবে সব কিছু। সেটা যে অর্থেই ধরুন।

প্র: একটা কোনও বড় কোম্পানির সঙ্গে জড়িত থাকা টিম যখন ক্রমাগত হারতে থাকে, তখন সেই কোম্পানির ভাবমূর্তির কি ক্ষতি হয়?

সঞ্জীব: সময় বলবে। আমার তো আগে ক্রিকেট টিম চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তবে আমার মনে হয় না, খেলার মাঠে হারায় কোম্পানি ইমেজের ক্ষতি হয় বলে। হ্যাঁ, জিতলে একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল ইমপ্রুভমেন্ট হয় কোম্পানির। হয়তো শেয়ারের দাম বাড়ে না কিন্তু লোকের মনে একটা ইমেজারি তৈরি হয়। সে দিক থেকে এটা সেফ। নেগেটিভ প্রভাব নেই তো— হারলে ক্ষতি নেই। জিতলে পজিটিভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন