কর্নেলময় মোহনবাগান। শনিবার। ছবি: উৎপল সরকার
মোহনবাগান-৩ (গ্লেন-২, বলবন্ত)
আইজলএফসি-১ (প্রীতম-আত্মঘাতী)
ম্যাচের পাঁচ মিনিটে প্রথম গোলটা করে কর্নেল গ্লেন দৌড়ে গেলেন গ্যালারির দিকে। পেটের উপর জার্সি তুললেন। তার পর নাগাড়ে বুকে চাপড়!
বিশ্বকাপার তো, মারাদোনা-স্টাইল ধার করতেই পারেন।
মিনিট পনেরো যেতে না যেতে পরের গোলটা করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সতীর্থ সেনাদের নিজের কাছে আসার জন্য ডাকতে লাগলেন বাগানের কর্নেল।
সবুজ-মেরুন জার্সিতে যেন কোন কোন বিদেশি এর আগে এ রকম করে গিয়েছেন সাম্প্রতিক অতীতে? ভাবার বিশেষ দরকার নেই। দু’টো নাম মনে পড়বেই— হোসে ব্যারেটো আর ওডাফা ওকোলি। তার পর ফের সেই পরিচিত দৃশ্য বাগানে।
রাশভারি কর্নেল ম্যাচ শেষে দু’বার হাসলেন। কালো ইস্পাতের মতো চেহারা থেকে সাদা দাঁতগুলো ঝলসে উঠল দু’টো প্রশ্ন শুনে। আপনি কেন এমন রাগী চোখমুখ নিয়ে সব সময় থাকেন? আর হ্যাটট্রিকটা মিস করলেন বলে আফসোস হচ্ছে না?
‘‘আই লিগ জেতার স্বপ্ন নিয়ে মোহনবাগানে এসেছি। আমি টিমম্যান। নায়ক হতে চাই না। নিজের গোলের চেয়ে টিমের জেতাটাই আমার কাছে আগে। হ্যাটট্রিক হয়নি বলে দুঃখ নেই,’’ বলে দিলেন তিনি
প্রিয় পুরনো ক্লাবের খেলা দেখে বেরনোর সময় সাংসদ-ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় উচ্ছ্বাস। ‘‘ওডাফার চেয়ে পা-টা ভাল। গোলের সামনে অনেক স্পিডে অপারেট করতে পারে,’’ কর্নেলকে শংসাপত্র তাঁর।
ওডাফা প্রচুর গোল করলেও আই লিগ দিতে পারেননি মোহনবাগানকে। ত্রিনিদাদ টোবাগো স্ট্রাইকার পারবেন কি না সেটা সময়ই বলবে। তবে পরের শনিবার সনি নর্ডি মাঠে নামার পর ক্যাটকেটে হলুদ রঙের বুট পরা পা দু’টো আরও ঝলসাবে যে, সেই প্রতীক্ষায় থাকতেই পারেন সবুজ-মেরুন সমর্থকরা।
কিন্তু মুদ্রার এ পিঠ থাকলে ও পিঠও আছে। কর্নেল গ্লেনের ‘পারফেক্ট’ টেন’ পাওয়ার দিনে বিগ জিরো-ও পাচ্ছে তাঁর দলের কেউ কেউ। আই লিগ খেতাব অটুট রাখার অভিযানে নেমে প্রথম হার্ডল সহজে টপকে গেলেও সঞ্জয় সেনের টিমের মাঝমাঠ আর রক্ষণের দশা দেখে হাজার বারো দর্শকের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি বেড়েছে। লুসিয়ানো সাব্রোসা এসে কতটা মেরামত করতে পারবেন কে জানে— বলতে বলতে কিন্তু মাঠ ছাড়লেন অনেক সমর্থকই।
টোট্যাল নম্বরে পাশ করলেও ম্যাচের পর বাগান কোচ তাঁর ফুটবলারদের যে ব্যক্তিগত মার্কশিট পেশ করেছেন তাতে পাসের চেয়ে ফেলের তালিকা দীর্ঘ। টিমের হেডমাস্টারের মন্তব্য-সহ সেটা এ রকম—
ডিফেন্সিভ ব্লকার শৌভিক চক্রবর্তী: ‘‘রর্বেতো কার্লোস ওকে প্রায় সব ম্যাচ খেলালেও এ দিনের মতো খেললে আমার টিমে জায়গা হবে না। কার্লোস তো আড়াই মাস বেড়াতে এসেছিলেন এ দেশে। ওঁর চেয়ে ভারতীয় ফুটবলারদের আমি একটু বেশিই চিনি।’’
রাইট ব্যাক প্রীতম কোটাল: ‘‘আইএসএল আর আই লিগ এক নয়। খুব খারাপ পারফরম্যান্স আজ। এ রকম খেললে টিমে জায়গা হবে না।’’
মিডিও কাতসুমি: ‘‘খুব খারাপ। চূড়ান্ত ব্যর্থ।’’
লেফট ব্যাক ধনচন্দ্র: ‘‘ডাহা ফেল। ওকে বুঝতে হবে আইএসএলের চেয়ে আই লিগ কঠিন। জার্সির চাপ নিতে হবে।’’
তা হলে পাস করলেন কে কে?
তিন জনের নাম বেরোল গত বারের চ্যাম্পিয়ন কোচের মুখ থেকে। কর্নেল গ্লেন, বলবন্ত সিংহ আর কিংশুক দেবনাথ। ‘‘কেন লুইস মোটামুটি চলে যায়।’’
আইজলের আলফ্রেডের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া বল ধরতে গিয়ে প্রীতম ঢুকিয়ে দিলেন নিজের গোলে। ম্যাচটা ১-১ হয়ে যাওয়ার কলঙ্কের মিনিটটা অবশ্য মুছে গেল গ্যালারিতে, গ্লেনের অসাধারণ দু’নম্বর গোলটা দেখে। ডান পা দেখিয়ে বাঁ দিকে হঠাৎ টার্ন। পরক্ষণে গোলে নিখুঁত শট। বলতে দ্বিধা নেই, গোলটা ছিল বাগানে অনেক না পাওয়ার মধ্যেও রংমশাল।
ম্যাচের আধঘণ্টার ভেতর বাগানের পক্ষে স্কোর ৩-১। উদ্বোধনী উৎসব শুরু করার একেবারে মুক্তমঞ্চ। সেটাই শেষমেশ শেষ হল এমন ভাবে যে মনে হচ্ছিল, আরে শিল্টন পাল আজ গোলে না থাকলে আইজলই তো জিতে যেতে পারত। ধনচন্দ্র নিজের গোলে আরও একটা গোল ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন প্রীতমের মতোই। আলফ্রেড, তুলুঙ্গারা অন্তত তিনটে নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করলেন। মিজেরামের ক্লাব একটা সময় এমন ভাবে চেপে ধরেছিল সঞ্জয়ের ডিফেন্সকে যে, শেষের দিকে দেখা যাচ্ছিল বাগান গোলের সামনে গ্লেন ছাড়া তাঁর বাকি দশ টিমমেটই দাঁড়িয়ে।
বাগান কোচ ৪-৪-২ ফর্মেশনে নেমেছিলেন। আইজলের স্প্যানিশ কোচ ম্যানুয়েল দল সাজিয়ে ছিলেন ৪-৫-১। ফলে মাঝমাঠ দখলের যুদ্ধে সব সময় বাড়তি সুযোগ পাচ্ছিল বাগানের বিপক্ষ। সেটা আরও ঝকঝকে লাগল বিরতির পর। পাহাড়ি দলটার তীব্র গতি আর ছোট ছোট পাসের বৈচিত্র যত বাড়ল তত ঠকঠকানি বাড়ল বাগান রক্ষণে। প্রীতম-বালমুচুদের অবস্থা এমন হল যে, গ্লেনের জোড়া গোলের পর নাগাড়ে গ্যালারিতে যে তাসা-পার্টি চলছিল, তারাও সব গুটিয়ে ফেলল। কী হয় কী হয় ভাবতে ভাবতেই ম্যাচ শেষ। ঠোটকাটা বাগান কোচ বলেও ফেললেন, ‘‘খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে জিতেছি। কিন্তু ভাল খেলেছে আইজলই।’’
আইএসএলের ধারেকাছে নেই আই লিগের আয়োজন। বারাসত স্টেডিয়াম আইএফএ নেওয়ার পর তা আরও হতশ্রী। প্রেসবক্সে ভাঙা চেয়ার। বাইরের লোকে ভর্তি। গ্যালারি নোংরা। ঝোপঝাড়ের মধ্য নিয়ে দর্শকদের যেতে হয়। শৌচাগার নেই। ভিআইপিতে যে দু’টোমাত্র আছে সেখানে আবার আলো নেই। আইজলকে সমর্থন করতে এ দিন মাঠে এসেছিলেন কয়েকশো সমর্থক। প্রচুর মহিলা এসেছিলেন রঙিন হয়ে। তাঁদেরই সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হল। লিগটা কবে যে ফেডারেশনের হাত থেকে নীতা অম্বানীর হাতে যাবে!
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, বালমুচু, কিংশুক, ধনচন্দ্র, কেন (সার্থক), কাতসুমি, শৌভিক, মণীশ (বিক্রমজিৎ), বলবন্ত, গ্লেন (আজহার)।