কঠিন সময়েই ইডেনে নাইটগুরু শিখিয়েছিলেন রিভার্স সুইং মন্ত্র

দেশের হয়ে খেলবে, শামিকে দেখেই মনে হয়েছিল আক্রমের

কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং পরামর্শদাতা থাকার সময় শামিকে নিজের হাতে গড়েছেন আক্রম। ফাস্ট বোলিংয়ের সোনার খনি উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর সামনে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ 

ম্যাঞ্চেস্টার শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০৩:৫৮
Share:

প্রশংসিত: ভারতের ডান হাতি পেসারের শেখার আগ্রহ শুরুর দিন থেকে প্রভাবিত করেছিল আক্রমকে। ফাইল চিত্র

গলার সংক্রমণ আর জ্বরে কাবু ছিলেন গত কয়েক দিন। তা নিয়েই ধারাভাষ্য দিয়েছেন। তবে আক্ষেপ রয়েছে, ছাত্রের এমন কীর্তির পরে কথা বলে ওঠা হয়নি বলে। ওয়াসিম আক্রম বলে দিচ্ছেন, ‘‘মহম্মদ শামি অনেক দিন ধরেই বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের এক জন। বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক ওর প্রতিভা আর পরিশ্রমের ফল। জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে ও। তার পুরস্কার পাচ্ছে দেখে আমি সব চেয়ে খুশি।’’

Advertisement

কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং পরামর্শদাতা থাকার সময় শামিকে নিজের হাতে গড়েছেন আক্রম। ফাস্ট বোলিংয়ের সোনার খনি উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর সামনে। ‘‘শামির শেখার আগ্রহটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করত। একটা কথা আছে না যে, কলসি তৃষ্ণার্ত কাকের কাছে যায় না, কাক যায় কলসির কাছে। শামিকে দেখে আমার সেই কথাটা মনে পড়ত।’’ তাঁর সঙ্গে শামির দীর্ঘ গুরু-ছাত্রের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে পাক-কিংবদন্তি যোগ করলেন, ‘‘আমি যখন কলকাতায় আসতাম, শামি নিজে চলে আসত বিমানবন্দরে আমাকে নিতে। ওই যে বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত গাড়িতে যেতাম, তার মাঝেই ও বোলিংয়ের নানা জিনিস নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলত। এতটাই ছিল ওর শেখার আগ্রহ। আমাকে সব চেয়ে প্রভাবিত করেছিল ওর শেখার আগ্রহটা।’’

শামিকে তিনি প্রথম যখন দেখেছিলেন, কী মনে হয়েছিল? জানতে চাওয়ায় আক্রম বললেন, ‘‘আমি যখন প্রথম কোনও বোলারকে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি, তার অ্যাকশন কী রকম। কী আছে ওর হাতে? গতি না সুইং? আমি যখন শামিকে দেখেছিলাম, তখন দু’টোই ছিল। গতি আর আউটসুইং। খুব সহজ, সাবলীল অ্যাকশন ছিল। বেশি লম্বা নয়, তাই ওর বলটা পিচে পড়ে পিছলে গিয়ে ফাস্ট হত।’’ দ্রুত যোগ করছেন, ‘‘আমার তখনই দেখে মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা ভারতের হয়ে খেলবে।’’

Advertisement

শামি কোনও কিছুই গোপন করতেন না আক্রমের কাছে। উত্তর প্রদেশের ছোট শহরের প্রত্যন্ত জায়গা থেকে কী ভাবে কলকাতায় ক্রিকেট খেলতে এসেছিলেন, সেই কাহিনি আরও বেশি করে আকৃষ্ট করেছিল আক্রমকে। ‘‘ওর মনোভাবটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। ছোট শহর থেকে এলেও একটা জেদ ছিল নিজেকে প্রমাণ করার। বারবার বলত, আমি দেশের হয়ে খেলতে চাই। ওর চোখের দিকে তাকালে আমি দেশের হয়ে খেলার সেই খিদেটা দেখতে পেতাম। ছোট বয়সে নিজের ঘর ছেড়ে অন্য শহরে এসে থেকে সেখানে খেলা চালিয়ে যাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। ক’জন সেটা করতে পারে?’’ এক দিন শামিকে বলেও ফেলেছিলেন আক্রম, ‘‘তোর স্বপ্ন ঠিকই পূরণ হবে। তোকে ভারতের হয়ে খেলিয়েই ছাড়ব আমি।’’ সেই সময় কেকেআরে খেলার সুযোগই পাচ্ছেন না শামি। তাঁর জীবনের কঠিন এক অধ্যায় সেটা। ‘‘ইডেনে তখন স্পিনারদের উইকেট বেশি হতো। শামির জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। কেকেআর তখন দু’তিন জন করে স্পিনার খেলাত। তাই ওর জায়গা হচ্ছিল না। তবে আমি জানতাম, শামির সুযোগ আসবেই।’’

অন্য যে কেউ হলে নিশ্চয়ই ভেঙে পড়তেন। শামি সেই দল থেকে বাইরে থাকার সময়টাই কাজে লাগান আক্রমের পরামর্শে নিজেকে আরও ধারালো করে তোলার জন্য। সেই সময় নিয়ম করে আলাদা ভাবে শামিকে বোলিং করাতেন আক্রম। নিঃশব্দে চলত গুরু-ছাত্রের ক্লাস। কখনও চলত ইয়র্কারের পাঠ। কখনও আউটসুইং, ইনসুইং। কখনও বা টেলএন্ডারদের উইকেট কী ভাবে পটাপট তুলে নিতে হবে, তার ক্লাস।

এই সময়েই শামির হাতে অমূল্য রিভার্স সুইংয়ের গোপন অস্ত্র তুলে দেন আক্রম। প্রথম তাঁকে শেখান কী ভাবে বলটাকে রিভার্স সুইং করানোর মতো উপযুক্ত করে তুলতে হবে। আক্রমকে ক্রিকেট বিশ্ব নাম দিয়েছিল ‘সুইংয়ের সুলতান’। রিভার্স সুইংয়ের মাস্টার ছিলেন তিনি। ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশে স্লোগানই তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, আক্রমের ইনসুইং ইয়র্কার হয় তোমার উইকেট নেবে নয়তো তোমার পায়ের পাতা।

পুরনো বলে রিভার্স সুইং করিয়ে কী ভাবে সেই ইয়র্কার করতে হবে, ইডেনের নীরব অনুশীলনে তা শামিকে শেখাতেন আক্রম। এমনকি, বলে কতটা পালিশ থাকলে কী রকম সুইং করতে পারে, সেই খুঁটিনাটি পর্যন্ত ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ইয়র্কার করার সময় কোন জায়গাকে চোখের নিশানা করতে হবে, তা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সাফল্যের জন্য গুরু অবশ্য ছাত্রকেই কৃতিত্ব দিতে চান। ‘‘কৃতিত্বটা শামির কারণ ও আগ্রহ দেখিয়ে শিখেছিল। এর জন্য যে পরিশ্রম করার দরকার ছিল, সেটা ও করেছিল। আমি অনেক বোলারের সঙ্গেই কাজ করেছি। কিন্তু এত দ্রুত কাউকে আমি সব কিছু রপ্ত করতে দেখিনি,’’ বলছেন আক্রম। যোগ করছেন, ‘‘ভারতের হয়ে যখন অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামছে, তখন শামি পুরোপুরি তৈরি। তার পর যত সময় গিয়েছে, ও উন্নতিই করেছে।’’ বন্ধু রবি শাস্ত্রী, ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি এবং ভারতীয় কোচিং স্টাফের প্রশংসাও করছেন তিনি। বলছেন, ‘‘রবি আর বিরাট মিলে ফিটনেসের স্তর অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। টিমের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রেখে খোলামেলা আবহাওয়া তৈরি করেছে। কোচিং স্টাফেরা দারুণ কাজ করছেন। সে সবও আছে সাফল্যের নেপথ্যে।’’

হেড কোচ শাস্ত্রী, বোলিং কোচ বি অরুণ এবং ট্রেনার শঙ্কর বাসু মিলে লেগে থাকার ফল, আজকের এই দুরন্ত ফিট শামি। তাঁদের কড়া নজরে না থাকলে ইডেনের সেই ইয়র্কার আর রিভার্স সুইং ক্লাস এতটা কাজে আসত কি না, সন্দেহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন