ঘূর্ণি পিচ অস্ত্র করেই বাজিমাত বিরাট বাহিনীর

আবার একই ম্যাচে ফাস্ট বোলারের ওপেন করতে নামা, ওপেনিং ব্যাটসম্যানের বলে বলে উইকেট পাওয়া ও অফ স্পিনারের বোলিং ওপেন করা দেখে সনাতন ক্রিকেটের মুগ্ধ ভক্তরা বলতে পারেন, কী বৈচিত্রময় এই ক্রিকেট! চরম তৃপ্তি তো টেস্ট ম্যাচেই।

Advertisement

রাজীব ঘোষ

মোহালি শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১৬
Share:

তখন জয়ের গন্ধ পাচ্ছেন কোহলি। ডে’ভিলিয়ার্স আউট। শনিবার মোহালি টেস্টে পিটিআইয়ের ছবি।

বারো, দশ ও আঠেরো। মোহালি টেস্টের তিন দিনে বোলারদের শিকার সংখ্যা। যা দেখে সারা দুনিয়ার ব্যাটসম্যানরা শিউরে উঠতে পারেন।

Advertisement

আবার একই ম্যাচে ফাস্ট বোলারের ওপেন করতে নামা, ওপেনিং ব্যাটসম্যানের বলে বলে উইকেট পাওয়া ও অফ স্পিনারের বোলিং ওপেন করা দেখে সনাতন ক্রিকেটের মুগ্ধ ভক্তরা বলতে পারেন, কী বৈচিত্রময় এই ক্রিকেট! চরম তৃপ্তি তো টেস্ট ম্যাচেই।

কিন্তু বিরাট কোহলি কী বলছেন?

Advertisement

বলছেন, বিদেশি অতিথিকে ঘরে ডেকে এনে দেশি খাবার খাওয়ানোটাই হল টেস্ট ক্রিকেট। মোহালিতে যা হল।

মেহমান নওয়াজির এর চেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে?

এ বিরাট কোহলিই পারেন! বিদেশি দলকে এনে টার্নিং ট্র্যাকে ফেলে দেওয়াটাই বোধ হয় এ বার থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের রীতি হতে চলেছে।

এগারো বছর আগে নাগপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সবুজ উইকেট দেওয়ার জন্য শশাঙ্ক মনোহরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেও যা পারেননি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, শাস্ত্রী-কোহলিরা সেটাই পারলেন। আদায় করেই ছাড়লেন র‌্যাঙ্ক টার্নার। আর তাতেই কাত বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট খেলিয়ে দল দক্ষিণ আফ্রিকা।

পুরো তিন দিনও গড়াল না টেস্ট। বিপক্ষকে ১০৮ রানে হারিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন প্রজন্মের আস্ফালন দেখে কে! কোহলি তো বলেই দিলেন, ‘‘এখন থেকে যে রকম উইকেটে রেজাল্ট পাওয়া যাবে, সে রকমই উইকেট তৈরি হবে। আমরা বাইরে গেলে আমাদেরও তো ওদের পছন্দের উইকেটেই যুঝতে হয়। কই, তখন তো কেউ আপত্তি করতে আসেন না।’’

শনিবার ঘূর্ণি-উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে মুড়িয়ে দেওয়ার পর এ বার বাকি তিন টেস্টেও একই ধরনের উইকেট করতে বলা হয়েছে বলে শোনা গেল। অর্থাৎ দেশি খাবার খাইয়ে বিদেশি ‘অতিথি সৎকার’-এর পালা চলছে, চলবে।

কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজেরাও যে ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন কোহলিরা! প্রথম ইনিংসে ২০১, দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০-য় অল আউট। প্রথম ইনিংসে মুরলী বিজয়ের ৭৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে চেতেশ্বর পুজারার ৭৭ ছাড়া পাতে দেওয়ার মতো কোনও ইনিংস নেই। টেস্ট ক্রিকেটের যা সম্পদ, সেই স্মরণীয় পার্টনারশিপ একটাও নেই। ম্যাচের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপটা ৮৬ রানের, মুরলী ও পুজারার মধ্যে। এটা টেস্ট ক্রিকেট!

ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন অবশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘সে নয় ঠিকঠাক করে
নেওয়া যাবে। কিন্তু এই নিয়মে কোনও অন্যায় নেই।’’

ম্যাচ শেষে সুনীল গাওস্কর বলছিলেন, ‘‘দক্ষিণ আফ্রিকা এক নম্বর টেস্ট দল। ওদের হারানো চাট্টিখানি কথা নয়। যথেষ্ট বড় ব্যাপার। আমাদের ক্যাপ্টেন যে ভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে দলটাকে জয়ের দিকে নিয়ে গেল, তার তারিফ করতেই হবে।’’ চিরকাল যে লোকটা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিতে পারল, তার মুখে এমন কথা! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। এমন অর্ডারি উইকেট বানিয়ে জেতার তৃপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে শুনেও প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বললেন, ‘‘লো-স্কোরিং ম্যাচ কি আগে হয়নি? এরও আলাদা মজা আছে। মাঝে মাঝেই উইকেট পড়ছে। ব্যাটসম্যান বনাম স্পিনার দুর্ধর্ষ যুদ্ধ। ভরপুর বিনোদন। আইপিএলের যুগে এটাও খারাপ নয়।’’

শনিবার সকালে ১২৫-২-এ দিন শুরু করার পর লাঞ্চে ভারত ১৮৫-৮! মাত্র দু’ঘণ্টায় যে ভাবে ধস নামল ভারতীয় ইনিংসে, তাতে চিন্তার কারণ আছে বইকী। ওই সময় বঙ্গসন্তান ঋদ্ধিমান সাহার তিনটি বাউন্ডারি-সহ কুড়িটা রানই মহার্ঘ্য মনে হচ্ছিল। তাঁর ব্যাট ধরেই দুশোর গণ্ডি পেরোয় ভারত। নেহাত ভারতীয় স্পিনাররা এক একজন এক একটা মারণাস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাই এঁদের সামনে দাঁড়াতেই পারলেন না কোনও প্রোটিয়া যোদ্ধা। দুশো রানের টার্গেট নিয়ে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে নামা হাসিম আমলা, এবি ডে’ভিলিয়ার্স, ফাফ দু’প্লেসিদের মতো ক্রিকেটের মহাযোদ্ধাদেরই ৩২ রানের মধ্যে ঘরে ফিরিয়ে দিলেন অশ্বিনরা। তার আর পর কী থাকতে পারে? ৪৫-৫ হয়ে যাওয়ার পর ১০৯ পর্যন্ত যে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছবে, এটাই অনেকে আশা করেননি।

দু’দিন প্রায় ধু ধু প্রান্তর ছিল গ্যালারি। দিনটা শনিবার হওয়ায় মোহালিতে এ দিন কিছু উৎসুক ক্রিকেটপ্রেমীর দেখা মিলল। সেখানে রীতিমতো পিকনিকের মেজাজ। পিৎজা, কোল্ড ড্রিঙ্কস। মিনি স্কার্টের আধুনিকা। বোঝা গেল, টেস্টের গ্যালারিতেও আইপিএলের ফ্লেভারটা ঢুকে পড়েছে। পড়বে না-ই বা কেন? মাঠে যেখানে ঘনঘন উইকেট পড়ছে, উত্তেজনার পারদ চড়েই রয়েছে। খেলা শুরু মানে তার একটা এসপার-ওসপারও হবে বলে জানছে সবাই। তা হলে আর আইপিএল দর্শকদের আসতে অসুবিধে কোথায়? তবে যা-ই বলুন, এই দৃশ্য সনাতন ক্রিকেটের আভিজাত্যে ধাক্কা মারে বইকী।

ভারত

(আগের দিন ১২৫-২)

পূজারা ক আমলা বো তাহির ৭৭

বিরাট ক ভিলাস বো ফান জিল ২৯

রাহানে ক বাভুমা বো হার্মার ২

ঋদ্ধিমান ক ভিলাস বো তাহির ২০

জাডেজা এলবিডব্লিউ বো হার্মার ৮

অমিত ক দু’প্লেসি বো হার্মার ২

অশ্বিন ক আমলা বো তাহির ৩

উমেশ বো হার্মার ১

বরুন ন.আ. ১।

অতিরিক্ত ১০।

মোট ২০০।

পতন: ১৬১, ১৬৪, ১৬৪, ১৭৮, ১৮২, ১৮৫, ১৮৮।

বোলিং: ফিলান্ডার ১২-৩-২৩-১ হার্মার ২৪-৫-৬১-৪

এলগার ৭-১-৩৪-০ তাহির ১৬.৩-১-৪৮-৪

রাবাদা ১২-৭-১৯-০ ফান জিল ৪-১-৫-১।

কয়েক দিন আগেই ইয়ান চ্যাপেল তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘‘তিন দিনের ম্যাচই ভবিষ্যতের টেস্ট ক্রিকেট। প্রতি শুক্র, শনি, রবিবার একটা করে টেস্ট করো। তাতে খেলা দেখতে মাঠে লোকও আসবে, ক্রিকেটারাররাও দুটো টেস্টের মাঝখানে যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়ে যাবে। দু’দিক থেকেই ভাল।’’ বিরাট কোহলিদের এই ম্যাচ দেখার পর এ বার বোধ হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক এখন থেকে প্রায়ই তাঁর এই প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দেবেন।

শুধু বিরাট কোহলিদের কাণ্ড কেন? সনাতন ক্রিকেটের রাজা বলে যাকে এখনও মেনে থাকেন অনেকে, সেই অ্যাসেজের একটা টেস্টও তো এ বার পাঁচ দিন গড়ায়নি। বার্মিংহ্যাম আর নটিংহ্যামে তো তিন দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল টেস্ট। তা হলে শুধু শুধু ভারতের উইকেটকে দোষ দিয়ে লাভ কী?

দক্ষিণ আফ্রিকা

এলগার ক কোহলি বো বরুন ১৬

ফিলান্ডার এলবিডব্লিউ জাডেজা ১

দু’প্লেসি ক রাহানে বো অশ্বিন ১

আমলা বো জাডেজা ০

ডেভিলিয়ার্স বো অমিত ১৬

ফান জিল ক রাহানে বো অশ্বিন ৩৬

ভিলাস বো জাডেজা ৭

হার্মার ক রাহানে বো জাডেজা ১১

স্টেইন ক বিজয় বো অশ্বিন ২

রাবাদা ন.আ. ১

তাহির এলবিডব্লিউ জাডেজা ৪।

অতিরিক্ত ১৪।

মোট ১০৯।

পতন: ৮, ৯, ১০, ৩২, ৪৫, ৬০, ১০২, ১০২, ১০৫।

বোলিং: অশ্বিন ১৪-৫-৩৯-৩ জাডেজা ১১.৫-৪-২১-৫

অমিত ৮-০-২৬-১ বরুন ৩-০-৩-১ উমেশ ৩-০-৭-০।

সাত বছর আগে এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই আমদাবাদ ও কানপুরে পরপর দু’টো টেস্ট তিন দিনে শেষ হয়েছিল। একটায় ভারত জিতেছিল, অন্যটায় প্রোটিয়ারা। এই তো ২০১৩-তেই ইডেনে সচিন তেণ্ডুলকরের শেষ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন দিনে হারিয়ে দেয় ভারত। তার পর মুম্বইতেও সচিনের শেষ টেস্ট তিন দিনের বেশি গড়ায়নি। সেই বছরেই ফিরোজ শাহ কোটলায় অস্ট্রেলিয়াকে তিন দিনে হারিয়ে সিরিজ ৪-০ জিতে নিয়েছিল ভারত।

এমনই যে চলবে, তার ইঙ্গিত সেই দু’বছর আগে থেকেই ছিল। এ বার দেশের মাটিতে প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া কোহলিও তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন।

সনাতন টেস্টের আভিজাত্য চুলোয় যাক। নিজেদের পছন্দের উইকেট বানিয়ে জিতে নাও। আর হয়ে যাও সর্বকালের সবচেয়ে সফল টেস্ট অধিনায়ক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন