ইতিহাসের সামনে দাঁড়়িয়ে ভারতীয় ক্রিকেট। ফেলে আসা ৮৪ বছরের সেই লড়াই। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মাটিতে ব্রিটিশদের হাত ধরেই ক্রিকেটে ঢুকে পড়া। লর্ডসের মাটিতে চোখে চোখ রেখে লড়়ে যাওয়ার ইতিহাস। ছিটকে পড়া, আবার ঘুরে দাঁড়়ানো। অনেকটা ‘লগান’ সিনেমার মতোই। যেখানে ধুতির কাছা গুটিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়়েছিলেন আমির খান। আর আজ সেই ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করে ভারত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের মাথায় বসে থাকেন কোনও এক ভারতীয়। বিশ্ব ক্রিকেটকে যে কোনও সিদ্ধান্তের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় এই ভারতের দিকেই। যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জোড় গলায় বলে দিতে পারেন, ভারতকে ছাড়া বিশ্ব ক্রিকেটের উন্নতি সম্ভব নয়। সেই ভারতের ক্রিকেটে উত্থান কিন্তু সহজ ছিল না।
তখন ক্রিকেট মানেই টেস্ট। ৫০০ টেস্ট ক্রিকেট খেলার ইতিহাস গড়তে চলেছে ভারত। কিন্তু কী ভাবে জায়গা করে নেওয়া টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে। কবেই বা প্রথম টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলের। ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস।
ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতের প্রথম ক্রিকেট ক্লাব তৈরি হয়েছিল ১৭৯২ সালে, কলকাতায়। তার আগেই অবশ্য ১৭২১-এ ভারতের মাটিতে ক্রিকেট ম্যাচ খেলে ফেলেছে ব্রিটিশরা। ১৮৪৮এ পার্সি কমিউনিটি মুম্বইয়ে শুরু করে ওরিয়েন্টার ক্রিকেট ক্লাব। এটাই প্রথম ক্রিকেট ক্লাব যা ভারতীয়রা তৈরি করেছিল। এর পর ১৯১২ থেকে নিয়মিত পার্সি, শিখ, হিন্দু ও মুসলিমরা ক্লাব তৈরি করে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে কোয়াড্র্যাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট খেলত। ১৯০০তে বেশ কিছু ভারতীয় যোগ দেন ইংল্যান্ড দলে। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই বড় নাম রঞ্জিত সিংজি ও দলীপ সিংজি। যাঁদের নামে ডোমেস্টিক ক্রিকেটের সেরা দুটো টুর্নামেন্ট চলে। ১৯১১তে প্রথম কোনও ভারতীয় দল যায় ইংল্যান্ড সফরে। তবে সেই দল শুধু খেলেছিল কাউন্টি দলের সঙ্গেই। তখনও তৈরি হয়নি জাতীয় দল।
ভাবনা-চিন্তার শুরু এখান থেকেই। তৈরি হতে শুরু করে ভারতীয় দল। ততদিনে ক্রিকেটে মজতে শুরু করেছে ভারত। আজকের ভারতের ক্রিকেটপ্রেমের শুরু কিন্তু সেই ব্রিটিশ যুগ থেকেই। ব্রিটিশরা অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও দিয়ে গিয়েছিল এই দেশকে।
কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম টেস্ট খেলতে লেগে গিয়েছিল অনেক বছর। সেটা ১৯৩২ সাল। ঐতিহাসিক লর্ডসেই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমেছিল ভারত। অধিনায়ক ছিলেন সিকে নাইডু। দিনটি ছিল ২৫ জুন। ১৫৮ রানে হেরেছিল ভারত। তখনই ষষ্ঠ দল হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের ছাড়পত্র পেয়ে যায়। ঢুকে পড়ে ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্রে।
১৯৩৩-এ ভারতে প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলা হয়। প্রতিপক্ষ সেই ইংল্যান্ড। ভেন্যু ছিল মুম্বই, কলকাতা ও চেন্নাই। এই সিরিজ ভারত হেরে গিয়েছিল ০-২এ। তার পর থেকে প্রথম ৫০ বছর টেস্ট ক্রিকেটে ভারত ছিল দুর্বলতম দল। এর পর দিন বদলেছে। বদলেছে নাম, বদলেছে সাফল্যের খতিয়ান। লর্ডসের মাটিতে যখন অভিষেক ম্যাচে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি আসে বা সেই লর্ডসের ব্যালকনিতেই যখন জয়ের উচ্ছ্বাসে নিজের জার্সি খুলে মাথার উপর বন বন করে ঘোরান, তখন বোঝা যায় লড়াইটা আসলে আজও চলছে। সাফল্যটা বাড়তি পাওনা। যে মানুষগুলো এই পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের শ্রদ্ধাই এই সাফল্য।
এই জায়গায় উঠে আসতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটকে। প্রথম ১৯৬টি টেস্টের মধ্যে ভারত জয়ের মুখ দেখেছিল মাত্র ৩৫টিতে। ১৯৩২ এ টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের পর ভারতকে প্রথম জয় পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০ বছর। ১৯৫২তে প্রথম জয়ের মুখ দেখে ভারত। ১৯৭০ থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে ভারতীয় ক্রিকেট। ভারতীয় দলে যুক্ত হতে শুরু করে সুনীল গাওস্কর, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথন, কপিল দেব, এরাপল্লী প্রসন্ন, ভেঙ্কটরাঘবন, চন্দ্রশেখর, বিশন সিংহ বেদীরা।
দেশের বাইরে ভারতীয় দল সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে একুশ শতক থেকে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট ম্যাচও জেতে। তার আগে ঘরের মাঠে প্রথম জয় তুলে নিয়েছে ভারত। ১৯৫২তে চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এর পর পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়। সেই শুরু। ভারতের বিজয় রথ কখনও চলেছে দ্রুত গতিতে কখনও ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু থেমে যায়নি। এখন ৫০০তম টেস্ট থেকে ভারতীয় ক্রিকেটারদের শপথ টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে আবার শীর্ষে উঠে আসা। কানপুরের গ্রিন পার্কে ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই এই লড়াইয়ে নামতে চলেছেন বিরাট কোহালিরা।