গব্বরের হুঙ্কার। আর তার জোরেই বিশ্বকাপে এই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিল ভারত। ছবি: রয়টার্স।
রোববার রাতে মেলবোর্নের সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত মানুষের নাম কী?
যদি বলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি উত্তরটা দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটিংয়ের মতোই ভুলভাল হল! ধোনি হয়তো গ্রুপ বি-র শীর্ষে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তামুক্ত হলেন। বাকি ম্যাচগুলো ঠিকঠাক চললে কোয়ার্টার ফাইনালে নিরীহ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মেলবোর্নে খেলার ব্যবস্থা পাকা করার দিকে এগোলেন।
কিন্তু ম্যাচ শেষে তাঁর চেয়ে অনেক উদ্বেলিত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাহেবরা। জলিমন্ট স্ট্রিটের মুখ্য বিপণন কর্তা ঘোষণাই করে দিলেন, “বিশ্বকাপ সফল হয়ে গেল। আজ যে এত লোক এসেছিল, তাদের সচরাচর আমরা ক্রিকেট মাঠে পাই না।”
ভারতীয় সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে গ্যালারি ভাসিয়ে দেওয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে এ দেশ এত দিন দেখছিল অ্যাডিলেডের ভারত-পাক! রোববারের এমসিজি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সেই শৃঙ্গকেও নতুন উচ্ছ্বাসের প্লাবনে ১৩০ রানে হারিয়ে উঠল।
শনিবার রাতভর মহানগরী মেলবোর্ন যা দেখেছিল, সে উৎসবের নাম হোয়াইট নাইট। আর এ দিন দেখল ব্রাউন নাইট।
শুধু ‘নাইট’ই বা বলি কী করে। নীল জার্সির রঙে ফাগুনের নেশা তো দুপুর থেকেই। প্রায় সাতাশি হাজার লোক হয়েছিল এ দিনের ম্যাচ দেখতে, যার একটাও ফ্রি-টিকিট নয়। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া কর্তারা উল্লাসের সঙ্গে জানালেন, বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াও এত ভিড় দিতে পারেনি। মেলবোর্ন মাঠের ইতিহাস বলছে, অস্ট্রেলিয়া নেই, এমন ওয়ান ডে ম্যাচে এর চেয়ে বেশি ভিড় মাত্র এক বার হয়েছে। সেটা বিরানব্বইয়ের পাকিস্তান-ইংল্যান্ড কাপ ফাইনাল।
কিন্তু সেই ফাইনালও আজকের মতো বর্ণোজ্জ্বল ছিল না। থাক-থাক নীল জার্সি আর প্রতিটা ধাপে তেরঙ্গা মিলে ভারতের একটা চলমান মানচিত্রই যেন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল না, মেলবোর্ন না মুম্বই? অসামান্য একটা কোলাজ। ধবন সেঞ্চুরির রাস্তায় প্রচণ্ড মারছেন। ডেল স্টেইনের বাউন্সার কনুইয়ে আছড়ে পড়ার পর তাকে অগ্রাহ্য করে পাল্টা দিচ্ছেন। স্টেইনকে অন ড্রাইভে সোজা ছক্কা মারলেন। এমসিজির এই সোজা ছক্কা মানে তিরাশি মিটার। দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে আবার আর এক যৌবন। মোহিত শর্মা উদ্দীপ্ত ফাস্ট বোলিংয়ে উঠে এলেন নতুন তারা হয়ে। ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু অজিঙ্ক রাহানে। প্রথম ম্যাচে বোল্ড হওয়াকে কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে দুঃসাহসী সব শট খেলে চলে গেলেন। মনেই হয়নি কোনও কালে শর্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তাঁর দুর্বলতা ছিল বলে। তিন ভারতীয় পেসারই ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিলোমিটারের ওপরে বল করেছেন। এত চাপ আর সার্কলের ভেতর-বাইরে এমনই জমাট ফিল্ডিং আজ ভারতের যে, স্পেশ্যালিস্ট দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের দু’জন কি না রান আউট! আর এ সবই ঘটছে সমর্থকদের তৈরি ওই চলমান ভারতের মানচিত্রের সামনে। বিশ্বকাপে যারা ব্রাজিলীয় সমর্থকদের আত্মবৈশিষ্ট্যের আমেজ নিয়ে এসেছে। তফাতের মধ্যে ব্রাজিলীয়রা খেলার মধ্যে সারাক্ষণ গান গায়। এরা স্লোগান দিতে থাকে জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা!
দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপে ভারত এই প্রথম হারানোয় টুর্নামেন্ট-হিসেব দাঁড়াল ১-৩। কেউ ভাবেইনি এত কম রানে আমলা-ডে’ভিলিয়ার্সদের ইনিংস শেষ করা সম্ভব! সৌরভ শুরু থেকে বলছিলেন ২৭০ চাই। সচিন বলছিলেন ২৮০ চাই। তখন এমসিজির হিসেব দেখাচ্ছে, গত দশ ম্যাচে প্রথম ব্যাট করা দলের গড়ই ২৮০। ভারত তার চেয়ে মাত্র ২৭ রান বেশি করেছে। এমন কী করেছে? বরঞ্চ আজও তো অ্যাডিলেডের মতোই স্লগ ওভারে আটকে-আটকে গিয়েছে।
শিখর ধবন অবশ্য ততক্ষণে আলোচনার পুরো নেটওয়ার্কটাই নিয়ে নিয়েছেন। এমনিতে ভারতীয় দলে তাঁকে যে নামে ডাকা হয়, সেটা খলনায়কেরই। পুরুষ্টু গোঁফ আর পেটানো চেহারার জন্য বলা হয় ‘গব্বর’। কে জানত, ব্রিসবেনের গব্বর মেলবোর্নের বীরুতে রূপান্তরিত হবেন? ব্রিসবেন টেস্টে অনুশীলনে গায়ে বল লাগার পর সকালে তাঁর ব্যাট করতে না নামা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, বিরাট কোহলিও প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার মোট চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের মধ্যে যিনি একমাত্র গ্র্যাজুয়েট, সেই ক্রিস রজার্স গত পরশুও জিজ্ঞেস করেছেন, “ধবন-কোহলির সম্পর্ক কি এখন একটু ভাল?” অ্যাডিলেডের পর আরও একটা দুর্ধর্ষ পার্টনারশিপে ধবন-কোহলি এই আলোচনাকে ইয়ারা নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। ব্রিসবেনে চোট পেয়ে দেরিতে ব্যাট করতে যাওয়ার জন্য ম্যাথু হেডেন তাঁকে কাপুরুষ বলেছিলেন। এ দিন হেডেনকে কোথাও দেখলাম না। কিন্তু তিনি বিশ্বকাপ মহাদেশের যেখানেই থেকে থাকুন, উত্তর পৌঁছে গিয়েছে।
বিশ্বকাপে আগের তিন বার ভারতকে রান তাড়া করেই হারিয়েছে ক্রোনিয়ের দেশ। কিন্তু এমসিজি-তে পারত না। পুরো অস্ট্রেলীয় মরসুমে ম্রিয়মান থাকা ধবন চোট গুছিয়ে এমন ব্যাট করতে পারেন যেমন অবিশ্বাস্য দেখিয়েছিল, তেমনই অবাক লেগেছে জন্টির দেশ এত বাজে ফিল্ডিং করল কী করে? আমলা যে ধবনের ক্যাচটা ছাড়লেন, ওটা দেখে ওপরেও নিশ্চয়ই শিউরে উঠেছেন বব উলমার। ওভারথ্রোরও অভাব ছিল না।
তা বলে কি দক্ষিণ আফ্রিকা আবার ‘চোক’ করল? এতগুলো কোচ আর সাপোর্ট স্টাফও কি তাদের সেই রোগ সারাতে অসমর্থ, রান তাড়ার সময়ে যে দলগত মানসিক বিশৃঙ্খলাকে আধুনিক ক্রিকেট নামকরণ করেছে ‘ব্রেনফ্রিজ’!
উত্তর পরিষ্কার না। ভারত বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় ম্যাচ জিতেছে নিজস্ব দর্পে, প্রতিদ্বন্দ্বী কী করবে তার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজনই মনে করেনি। গোটা অস্ট্রেলীয় মরসুমে একটাও ম্যাচ না জিতে এমন রোমাঞ্চকর প্রত্যাবর্তন দিল্লিতে আপ ক্ষমতায় আসার চেয়েও চমকপ্রদ। আট দিনেই বিশ্বকাপে আচমকা আবেগের লাভাস্রোত হয়ে দাঁড়াল ভারত।
সামগ্রিক বিচারে আজকের বাড়তি তাৎপর্য নেই। টুর্নামেন্ট তো স্রেফ তিন ম্যাচের, যার একটাও আজ ছিল না। কিন্তু গুরুত্বহীন মর্যাদার ম্যাচে জয়েরও তো একটা মৃগনাভি থাকে! ধোনির টিমের আশেপাশে গেলে এখন বাকি টিমগুলো সেই গন্ধটা পাবে! সে তারা যতই বলার চেষ্টা করুক, টানা দু’টো ম্যাচে টস জেতায় সুবিধে হয়েছে।
এমসিজি প্রেসবক্সে ম্যাচ রিপোর্ট শেষ করতে করতে এমন দেরি হয়ে গিয়েছে যে, এখন মেলবোর্নের স্থানীয় সময় রাত একটা। মাঠের চারধার পরিষ্কার করা আর জল দেওয়া চলছে। একটা কোণে নিরুদ্বেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা সামুদ্রিক পাখিগুলো। ম্যাচের মধ্যে যাদের এক বারও দেখিনি।
পাখিগুলোর এতক্ষণে নিশ্চয়ই খবর পাওয়া উচিত যে, তাদের মতোই ডানা মেলে উড়েছে কিছু মানুষ। সেই ডানার রং অবশ্য নীল!
ফাগের রং শুধু লালই হবে কে বলেছে!