কলম্বোয় মঙ্গলবার রাতে নিজের বাড়িতে সঙ্গার ছোটবেলার কোচ রয় ডায়াস। ছবি তুলেছেন গৌতম ভট্টাচার্য।
কপিল দেবের ভারতীয় দল তিরিশ বছর আগে শ্রীলঙ্কায় যে প্রথম সিরিজ খুইয়ে গিয়েছিল তার প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি! ভিভের বাছা অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশে তিনি তিন নম্বরে। কপিল দেব সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফাইনালেও বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় এত মারকুটে ব্যাটসম্যান আর দেখেননি। আর গাওস্কর তো বরাবরই তাঁর গুণমুগ্ধ। সত্যি, শ্রীলঙ্কার মাঠে তিনি ব্যাট করতে এলে বলা হত, এ বার সিট বেল্ট বেঁধে চুপ করে বসুন! বাদ পড়েন সাতাশির বিশ্বকাপের পর। অথচ শ্রীলঙ্কার হয়ে শেষ ম্যাচে রান ৮১। সেই রয় ডায়াস মঙ্গলবার রাতে আনন্দবাজারের টেপ রেকর্ডারের সামনে তাঁর এককালের ছাত্র কুমার সঙ্গকারা সম্পর্কে অনাবিল...
সঙ্গকারাকে প্রথম দেখা: আমি সেই সময় কলম্বোয় একটা ক্রিকেট স্কুল চালাই আর সেই স্কুলে ভিড় লেগেই থাকে। এক দিন বিকেলে কাজের মেয়েটা বলল, ফোন এসেছে। ফোন ধরতে গিয়ে উল্টো দিক থেকে কণ্ঠস্বর বলল, আই অ্যাম মিস্টার সঙ্গকারা। আ লইয়ার ফ্রম ক্যান্ডি। আমার ছেলের বয়স আঠারো। ও এক মাসের জন্য গরমের ছুটিতে কলম্বো আসছে। আপনার কাছে একটু পাঠাতে চাই। আমি বললাম, পাঠাও। সেই প্রথম দেখা। সঙ্গা তখন আঠারো। দারুণ কিছু কিন্তু তখনও খেলছে না। একটা প্রচণ্ড চেষ্টা ছিল কিন্তু এমন কখনও মনে হয়নি যে, এ তো হিরে চকচক করছে!
সঙ্গা-কাহিনির সারবত্তা: আমার মনে হয় সঙ্গা কাহিনি এটাই প্রমাণ করে যে, তুমি যদি খাটনির সঙ্গে কোনও রকম অসততা না করে জীবনে এগোতে রাজি থাকো, তা হলে অনেক সাফল্য পরের দিকে তোমার জন্য থাকবে। কী অক্লান্তই না খেটেছে কুমার! শান দিয়ে দিয়ে, দিয়ে দিয়ে একটা মানুষ কোথায় পৌঁছতে পারে এটাই আমার ট্রেনিদের শেখাই। বলি যে, ড্রাইভিং যদি শিখতে চাও সচিনের ভিডিও দেখো। পরিশ্রম যদি শিখতে চাও, কুমারকে দেখো!
সঙ্গার টেকনিক: আমি বলব কুমার যে জায়গাটায় সবাইকে মেরে বেরিয়ে গেল তা হল ওর টেকনিক। যতই ক্রিকেট বদলাক, গ্রেট থেকে গ্রেটেস্ট হতে চাইলে টেকনিক ছাড়া বাঁচোয়া নেই। কুমারকে ক’বার দেখেছেন অন্য বাঁ হাতিদের মতো স্লিপ কী গালিতে আউট হতে। কচিৎ হয়। তার কারণ ও বলটাকে দারুণ ভাবে ঠিক চোখের নীচে মিট করে। এই বলের মিটিং পয়েন্টগুলো ওর এত ভাল যে, সেখানেই ও এগিয়ে যায়। এগুলো ছোটখাটো মনে হতে পারে কিন্তু ছোটগুলোই আসল। রাহুল দ্রাবিড় যেমন রিসেন্টলি একটা দারুণ কথা বলেছে যে, সবাই বলে বল দেখো, বল দেখো। বল যখন সুইং করছে বলের কোন দিকটা দেখতে হয়, না ইনসাইড। এই কথাটা রাহুল বলেছে। কুমার এটাই নীরবে করে থাকে।
সঙ্গার স্পিন খেলা: দারুণ খেলে স্পিনটা। অনেক বছর আগের কথা বলি। সিলনের হয়ে আনঅফিশিয়াল টেস্ট খেলতে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। ক্যাপ্টেন ছিলেন তেনেকুন। বললাম, স্যর খুব ভয় লাগছে, ওদের চারটে বাঘা স্পিনার। বেদী, প্রসন্ন, চন্দ্র, বেঙ্কট। খেলব কী করে? তেনেকুন বললেন, যখন মারবে তখন পুরো মারবে। আর যখন ডিফেন্ড করবে, বলের লাইনের এত কাছে যাবে যে বলকে চুমু খেতে পারো। সঙ্গকারার স্পিন খেলা ঠিক তাই! একেবারে বলের গন্ধ শোঁকে যখন ডিফেন্স করে। আর নইলে একদম উড়িয়ে দেয়।
সঙ্গার একটা নিজস্ব ব্যাটিং স্টাইল আছে। বাঁ-হাতিদের দেখতে এমনিই ভাল লাগে। সঙ্গাকেও তাই। অবশ্য বিপক্ষ টিমের প্লেয়ার হিসেবে ছন্দে চলে এলে ওর ব্যাটিং একেবারেই উপভোগ করতাম না! শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, গোটা বিশ্বের ক্রিকেটারদের কাছে ও আদর্শ। দুর্দান্ত বিশ্বমানের প্লেয়ার সঙ্গা। ক্রিকেটার হিসেবে ওকে আরও পরিণত হতে দেখাটা দারুণ লেগেছে। কেরিয়ারের শুরুর দিকে ও বড় শট মারত না। কিন্তু আমার মনে হয় পরের দিকে ও নিজের খেলাটা পুরো বদলে ফেলেছিল। গিয়ার পাল্টে ওর ইচ্ছেমতো আক্রমণ করত।
—সচিন তেন্ডুলকর
শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচনে ভোট: আমার ভোট ব্যাটসম্যান হিসেবে কুমার সঙ্গকারা। বোলার হিসেবে মুরলী। নাহ্, একজন কাউকে বাছতে পারলাম না।
সঙ্গা, জয়সূর্য আর অরবিন্দের মধ্যে একজনকে বাছতে হলে: ডিপেন্ড করছে সিলেকশনটা ক’টা ম্যাচের? কাদের সঙ্গে খেলা? যদি অনেক ম্যাচের হয়, তা হলে কুমার। যদি একটাই ম্যাচ হয় আর বিপক্ষে চার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার—আমি অরবিন্দ নেব। ফাস্ট বোলিং ওই রকম মারতে আমি কাউকে দেখিনি। শুধু অরবিন্দের একটু নামী অপোনেন্ট দরকার ছিল। নইলে ও নিজেকে মোটিভেট করতে পারত না।
সঙ্গার বিদায়ী টেস্ট: এখন পরিবেশটা তৈরি হয়নি বোধহয় ইলেকশনটা ছিল বলে। অনেক লোক কলম্বো থেকে দেশের বাড়িতে ভোট দিতে গেছিল। তারা ফিরুক। ঠিক জমে যাবে। সঙ্গা ক্যান্ডিতে ম্যাচটা করতে পারত। ওর নিজের শহর। আসলে আমার মনে হয় ও বাড়তি কোনও ইনিশিয়েটিভ ম্যাচ নিয়ে নিতে চায়নি। শুধু সচিনকে ওর নেমন্তন্ন করা উচিত ছিল। সচিন এলে কী দারুণ হত ব্যাপারটা। সঙ্গার কাছে একটা টিকিট পাঠানো কী!
ভবিষ্যৎ সঙ্গা: শ্রীলঙ্কার অনূর্ধ্ব উনিশ টিমের কোচ হিসেবে এই প্রশ্নটা এখন অহরহ শুনতে হচ্ছে কবে আসবে পরের মাহেলা? পরের সঙ্গা? আমি বলছি একটু ধৈর্য ধরুন। সবে তো দশ মাস আমি দায়িত্ব নিয়েছি। কিছু ছেলেকে আমার স্পট করা হয়ে গিয়েছে। এদের নিয়মিত বোলিং মেশিনের সামনে ফেলছি। বোলিং মেশিন দিয়ে প্র্যাকটিসের আমি খুব বিশ্বাসী। তবে সব কিছুর পর এটাও মেনে নিতে হয় সঙ্গাকে কোচেরা তৈরি করে না। কোচেরা ওই ছাঁচটা ফলো করে কয়েকটা ভাল প্লেয়ার তুলতে পারে, এই যা।