টিমের সঙ্গে শহরে পা দেবজিতের। সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
এটিকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই সবার মুখে দেবজিৎ মজুমদারের প্রশংসা শুনছি। আর প্রশংসা করবেই বা না কেন। গোটা টুর্নামেন্টে ওর পারফরম্যান্সের গ্রাফ একটুও ওঠা-নামা করেনি। শুরু থেকে শেষ, একই রকম দুর্দান্ত খেলেছে। লাস্ট লাইন অব ডিফেন্সের যা কাজ সেটা করে গেছে।
কিন্তু এ সব মাথায় রেখেও এখনই দেবজিতকে বাংলার সর্বকালের সেরা গোলকিপার বলতে পারব না। ছেলেটা ভাল খেলছে ঠিকই। কিন্তু একটা আই লিগ বা একটা আইএসএল চ্যাম্পিয়ন দিয়ে সর্বকালের সেরা বলাটা ঠিক হবে না। কারণ সেরার সেরা বাছার আগে আমার মাথায় আসছে অনেক নাম— প্রদ্যুত বর্মন, সনৎ শেঠ, তরুণ বসু। এরা লেজেন্ড। এর পর আসবে শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, অতনু ভট্টাচার্য, তনুময় বসু, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়রা। এরাও যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে খেলেছেন বহুদিন।
প্রদ্যুত বর্মনের কিপিং দেখিনি। তবে শুনেছি। বিশ্বমানের কিপার ছিলেন। সমৎ শেঠকেও দেখিনি। উনিও নাকি অসাধারণ সব সেভ করেছেন একসময়। কিন্তু তরুণদার খেলা দেখেছি। অন্যদেরও। আমার দেখা সেরা কিপার কিন্তু তরুণদাই। এই তালিকায় দেবজিতকে ঢুকতে হলে আরও পরিশ্রম করতে হবে। আরও অনেক সাফল্য পেতে হবে। ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। পরের পাঁচ-ছ’বছর অন্তত টপ লেভেল টুর্নামেন্টে কিপিং করতে হবে। সেটা করলেই তবেই দেবজিতকে সেরার তালিকায় ঢোকানোর কথা ভাবব।
তবে সর্বকালের না হোক এটা বলতে পারি এখনকার বাঙালি কিপারদের মধ্যে সেরা দেবজিৎ-ই। আর ভারতীয়দের মধ্যে অন্যতম সেরা। কী জন্য ও ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে না, সেটাই আমার কাছে একটা বড় ধাঁধা। ভারতীয় কিপারদের মধ্যে দেবজিতের ফিটনেসের ধারেকাছে কেউ নেই। গুরপ্রীত সিংহ সান্ধুর উচ্চতা একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। কিন্তু ওর রিফ্লেক্স মোটেই দেবজিতের মতো ভাল নয়।
আইএসএলে সবাই বলছিল জোসে মলিনার সাহস নাকি কলকাতাকে ট্রফি দিয়েছে। সেটা একটা অংশ। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে দলে কোনও এক দেবজিৎ না থাকলে কলকাতা সেমিফাইনালেও যেতে পারত কি না সন্দেহ। কয়েকটা ম্যাচে তো দেখেছি দেবজিতই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। ফাইনালে ও পেনাল্টি সেভ না করলে কলকাতা চ্যাম্পিয়নও তো হতে পারত না।
টিভিতে ফাইনাল দেখার সময় ক্যামেরায় যত বার দেবজিৎকে দেখেছি কোনও টেনশনের ছাপ চোখে পড়েনি। টাইব্রেকারের সময় যখন এটিকে গোলের নিচে দাঁড়াচ্ছে, তখনও দেখেছিলাম দেবজিতের মুখে হাসি। অনেকের মনে হতে পারে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচে দেবজিত কী ভাবে এত চাপমুক্ত থাকতে পারে? আমি নিজেও কিপার ছিলাম। তাই জানি, ভিতর ভিতর যতই টেনশন থাকুক, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেওয়া যায় না। টেনশন করলে বিপক্ষের যে ফুটবলার কিক মারতে আসছে সে মনে জোর পেয়ে যায়। গোলকিপার নড়ে গেলে ডিফেন্সের মধ্যেও টেনশন ঢুকে যায়। আর গোলকিপারের সাহসী মুখাবয়ব ডিফেন্সকেও ভরসা দেয়। আর দেবজিতের মধ্যে এই সাহসটাই দেখতে পেলাম। কোচির ফাইনালে ঘরের মাঠে খেলছে কেরল। গ্যালারিতে অসংখ্য সমর্থক। কিন্তু দেবজিতের মুখ দেখে মনে হল না এ সব ওকে একটুও চাপে ফেলেছে। মাথা ঠান্ডা করে নিজের বেসিকগুলো ঠিক রাখল।
দেবজিতের তিনটে বড় গুণের কথা লিখতে বসলে প্রথমেই মাথায় আসছে ওর রিফ্লেক্স। দারুণ অনুমানক্ষমতা। পজিশনিং সেন্সটা থাকায় ও জানে কখন কোথায় দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, ওর গ্রিপিং। সেট পিসে যেটা সাহায্য করেছে কলকাতাকে। ভিড়ের মধ্যে বলটা ধরে নিতে পারে। তৃতীয়ত, ওর মুভমেন্ট রি়ড করার ক্ষমতা। দিল্লির বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে মালুদার পেনাল্টিটা দারুণ বাঁচিয়েছিল। কারণ আগেভাগেই রিড করেছিল কোন দিকে মারতে পারে বলটা। দুর্বলতা বলতে শুধু আউটিং। তাতে গোলও খেয়েছে। সেটা হতেই পারে। আমার আশা ম্যাচ খেলতে খেলতেই ওই সমস্যাটা শুধরে নিতে পারবে।
গত বছর এক অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলেছিলাম, আর যাই কর ফিটনেসটা সব সময় ধরে রাখিস। নব্বই মিনিট ম্যাচ খেলার পর দিনও অনুশীলন কর। কারণ গোলকিপারদের এমন দিনও আসে যখন সব ভুল হয়। আমি যতদূর শুনেছি অনুশীলনে কোনও ফাঁকি দেয় না ও। আইএসএলে খেলা দেখেও তাই মনে হল। ওকে আমার পরামর্শ, একটা-দুটো ভাল ট্রফি জিতেছ বা পেনাল্টি সেভ করেছ ভেবে আকাশে উড়ো না। একটা খারাপ গোল খাওয়া অনেক গোল বাঁচানোর কথা সবাইকে ভুলিয়ে দেয়।