জোকার-হীন বিপক্ষ বধেও ১৭ বছরের পুরনো ব্লেজার

‘সিটি অব গার্ডেন’-এর বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পেরিয়ে বেঙ্গালুরুর সর্বোত্তম মার্কেটিং এরিয়া এম জি রোডে পড়া পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারের বিলবোর্ডগুলো দেখলে মনে হবে, এ শহরে এখন খেলা বলতে একটাই কেপিএল! হুবহু আইপিএলের কায়দায় কর্নাটক প্রিমিয়ার লিগ।

Advertisement

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:২৩
Share:

আনন্দ-কথা। ডেভিস প্রস্তুতির ফাঁকে লিয়েন্ডার পেজ-আনন্দ অমৃতরাজ। ছবি: পিটিআই।

‘সিটি অব গার্ডেন’-এর বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পেরিয়ে বেঙ্গালুরুর সর্বোত্তম মার্কেটিং এরিয়া এম জি রোডে পড়া পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারের বিলবোর্ডগুলো দেখলে মনে হবে, এ শহরে এখন খেলা বলতে একটাই —কেপিএল! হুবহু আইপিএলের কায়দায় কর্নাটক প্রিমিয়ার লিগ। প্রায় এক মাস যাবত্‌ রোজ চিন্নাস্বামীতে টি-টোয়েন্টি চলছে সন্ধের পর থেকে। গুটিকয়েক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টির হোর্ডিংও শোভা পাচ্ছে। আর দিন পাঁচেক বাদেই তো টুর্নামেন্ট। কিন্তু রাত পোহালেই শুরু ভারত বনাম সার্বিয়া ডেভিস কাপ ম্যাচের বিজ্ঞাপন? হোর্ডিং? একটাও চোখে পড়বে না! কাব্বন পার্কের ভেতর যেখানে কাল থেকে তিন দিন ওয়ার্ল্ড গ্রুপ প্লে-অফের এই গুরুত্বপূর্ণ টাই বসতে চলেছে, সেই কেএসএলটিএ স্টেডিয়ামের আশপাশেও টেনিস সংক্রান্ত একটাও ফেস্টুন নজরে পড়ল না আজ সকাল-বিকেল।

Advertisement

বিজ্ঞাপনের মুখ হয়ে রয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়ও। কর্নাটক পুলিশের ট্রাফিক নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন উপলক্ষে দেওয়া বিরাট বিজ্ঞাপনে। ভারতীয় ব্যাটিংকে বছরের পর বছর নিরাপত্তা দেওয়া দ্রাবিড়! অল্প দূরে চাণক্য সার্কেলে বেঙ্গালুরুর সবচেয়ে নামজাদা গল্ফ কোর্সের চারপাশটা আমাদের আরসিজিসি বা টলি ক্লাবের মতো উঁচু দেওয়ালের বদলে অভিনব চার-পাঁচতলা উঁচু আনব্রেকেবল ফাইবারের দেওয়াল তোলা! অফিস টাইমে শত-শত মানুষ বাস-অটো-ট্যাক্সি-প্রাইভেট গাড়িতে যেতে যেতে স্বচ্ছ-দেওয়ালের ওধারে গল্ফ খেলা দেখছেন দিব্যি!

দ্রাবিড়ের নিরাপত্তা-প্রদান আর ফাইবার গ্লাসের মোড়কে ঢাকা বেঙ্গালুরুর গল্ফ কোর্সের মতোই শহরে থাকা ভারতীয় ডেভিস কাপ দল নিরাপত্তা পাচ্ছে আর মোড়কে রয়েছে লিয়েন্ডার পেজ। আনন্দ অমৃতরাজ নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হওয়ার পর এটাই গত দুই যুগ ডেভিস কাপে দেশের সেবা করা ৪১ বছরের ‘তরুণ’-এর প্রথম ম্যাচ। কিন্তু এসেই যেন দলের ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন। এ দিন বেলা এগারোটায় কর্নাটক বিধানসভা ভবনে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার হাতে ডেভিস কাপের ক্রীড়াসূচি বা ‘ড্র’ নিরূপণ হওয়ার পর দুপুরে লিয়েন্ডার যখন বলছিলেন, “আমি সার্বিয়া টাই খেলছি মূলত নিজের ডাবলস ম্যাচের চেয়েও বেশি করে সতীর্থদের চারটে সিঙ্গলসের সময় সাইডলাইনের ধারে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে গাইড করতে,” তখন দেখা গেল আনন্দ অমৃতরাজও ঘাড় নেড়ে সেই বক্তব্য সমর্থন করছেন।

Advertisement

আনন্দের বিখ্যাত টেনিস-দাদা এখন বেঙ্গালুরুতেই। এবং বিজয় অমৃতরাজ আজ ‘ওয়াইন সংগ্রহ অভিযান’-এর প্রচার অনুষ্ঠানে এই টাইয়ের যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেটা জানলে আনন্দ মোটেই খুশি হবেন না। “আমার পছন্দের স্ক্রিপ্ট হতো, প্রথম সিঙ্গলসে সোমদেব সার্বিয়ার দ্বিতীয় সিঙ্গলস প্লেয়ারকে হারিয়ে ভারতকে ১-০ এগিয়ে রাখবে আর পরের সিঙ্গলসে য়ুকি খোলা মনে খেলে এই সার্বিয়া দলের সেরা তারকাকে চাপে রাখবে। কিন্তু আসল ড্রয়ের পর এখন টাই-টা ৫০-৫০।”

আরও দুই প্রাক্তন ডেভিসকাপার এখানে রয়েছেন খেলা দেখতে। এবং জয়দীপ মুখোপাধ্যায় আর আখতার আলি, দু’জনই এই টাইয়ের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়া দেখছেন প্রথম দিনের দু’টো সিঙ্গলসের ফলের উপর। “প্রথম দিন যদি একটা সিঙ্গলসও ভারত বার করতে পারে, তা হলে টাই কিন্তু জমে যাবে,” এ দিন সস্ত্রীক পুতাপুত্তি ঘুরে বিকেলে ফিরে বলে দিলেন জয়দীপ। মাঝ-সেপ্টেম্বরের বেঙ্গালুরুর আবহাওয়া দুই শিবিরকে এতটাই খুশি রেখেছে যে, সার্বিয়া জানিয়েই দিল, “ডেভিস কাপে ভারতে এটাই হয়তো প্রথম ফ্লাডলাইট টাই। কিন্তু এখানে সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাত, যখনই খেলা হোক, খেলতে কষ্ট নেই।” যেটা মোটেই মানছেন না প্রাক্তন ভারতীয় টেনিস তারকারা। আখতার যেমন বোঝালেন, “সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেঙ্গালুরু অনেকটাই হাই অলটিচুড-এ বলে বাতাসের ঘনত্ব অনেক কম। বল বেশি বাউন্স করবে, বেশি-বেশি যাবে। দ্বিতীয় সার্ভিসও প্রতিপক্ষের মুখের সামনে উঠবে! কিন্তু সার্বিয়ানরা সোমদেবদের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা-চওড়া হওয়ায় সমস্যা বেশি ভারতীয়দেরই।”

ভারতীয়দের আরও সমস্যা—য়ুকি চোট সারিয়ে ফেরার পর মাত্র দশটা ম্যাচ খেলেছেন। একটাও পাঁচ সেটের নয়। সব বেস্ট অব থ্রি। শুক্রবার য়ুকির ম্যাচ পাঁচ সেট গড়ালে দিল্লির বছর তেইশের ছেলের স্ট্যামিনা কী দাঁড়ায়, সেটাই দেখার। ডাবলসে লিয়েন্ডার-বোপান্না, দু’জনই ফোরহ্যান্ড প্লেয়ার। ডিউস কোর্ট বা রাইট কোর্টে খেলতে পছন্দ করেন। দু’জনের কে কতটা লেফ্‌ট কোর্ট বা অ্যাডভান্টেজ কোর্টে শনিবার মানিয়ে নিয়ে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে চার নম্বর জিমোনজিচের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, সেটাও দেখার। লিয়েন্ডার-বোপান্না জুটির কিন্তু অতীতে ডেভিস-ডাবলসে হারার নজির আছে।

শুক্রবার দুপুর আড়াইটেয় কেএসএলটিএ-র হার্ডকোর্টে দু’দলের অফিশিয়াল ফটোসেশনে জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় ভারতীয় দলের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন একটা বিশেষ ব্লেজার পরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের বাকি সবাই এআইটিএ-র বানিয়ে দেওয়া নতুন ব্লেজার গায়ে দাঁড়ালেও অমৃতরাজের গায়ে থাকবে সতেরো বছরের পুরনো ডেভিস কাপ ব্লেজার। তবে বিশেষ তাত্‌পর্যের ব্লেজার। সাতাশিতে ভারতের শেষ বার ডেভিস কাপ ফাইনাল খেলার ব্লেজার যে ওটা! সুইডেনের বিরুদ্ধে সেই ফাইনালে আনন্দ খেলেছিলেন। ডেভিসের ওয়ার্ল্ড গ্রুপে ওঠার যুদ্ধে নিজের পাশাপাশি দলকেও উদ্বুদ্ধ করতে তাঁই সতেরো বছরের পুরনো ব্লেজার আলমারি থেকে বার করেছেন আনন্দ।

ভারতের দুই শিল্পী ফুটবলার আর ক্রিকেটারের শহর বেঙ্গালুরু—আমেদ খান আর গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। ডেভিস কাপেও ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসে অনেক বড়-বড় জয় আছে। ছেষট্টির ব্রাজিল হয়ে চুয়াত্তরের অস্ট্রেলিয়া পেরিয়ে ফ্রেজুর ফ্রান্স ঘুরে বছর দুয়েক আগেই ০-২ পিছিয়ে থেকে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ৩-২ জয়! কিন্তু শৈল্পিক টাচ বা সোনালি ইতিহাস, দুয়ের কোনওটারই এই মুহূর্তে দ্বারস্থ নয় আনন্দ অমৃতরাজের ভারতীয় ডেভিস কাপ দল। তারা আপাতত তুকতাকে ভরসা করছেন! বিপক্ষ শিবিরে কোনও এক নোভাক জকোভিচ না-থাকা সত্ত্বেও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন