শেষ শয্যায়। পাশে স্ত্রী। রবিবার। ছবি: সৌভিক দে
মহাসন্ধিক্ষণ? নাকি কাকতালীয়!
ইউরো ফাইনাল দেখার জন্য রাত জাগার প্রস্তুতি চলছে শহরের ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়। তখনই চলে গেলেন বাঙালিকে বিশ্ব ফুটবলের স্বাদ দেওয়ার জনক।
মাস ছয়েক ধরে অসুস্থ ছিলেন পঁচাশি পেরোনো অমল দত্ত। মাসখানেক যাবত তো খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শরীরটা মিশে গিয়েছিল বিছানার সঙ্গে। সুচিত্রা সেন মারা যাওয়ার সময় যে রকম ঘটেছিল অনেকটা সেভাবে গত কয়েক দিন মাঝেমধ্যেই গুজব রটছিল। আনন্দবাজার ক্রীড়া দফতরে কত যে ফোন আসত দিন-রাত। অমল দত্ত বেঁচে আছেন, না...! গুজব এমনই ছড়াচ্ছিল, ফেসবুকে ডায়মন্ড কোচের ছবি দিয়ে কোনওটায় ‘অমর রহে’, কোনওটায় ‘রিপ’ লেখা হত। পাল্টা কেউ আবার লিখতেন, ‘উনি এখনও বেঁচে আছেন, মারা যাওয়ার খবর ভুল’। বেঁচে থাকা কারও ‘মৃত্যু’ নিয়ে এ রকম বিতর্ক কবে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়!
চিরবিতর্কিত অমল দত্ত শেষ পর্যন্ত রবিবার রাত সাড়ে আটটায় মারা গিয়ে যেন বুঝিয়ে গেলেন তিনি মারা যাননি!
আজ সোমবার তাঁর শেষকৃত্য হবে নিমতলা শ্মশানে। তাঁর আগে দেশের প্রথম পেশাদার কোচকে শেষশ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ রাখা থাকবে রবীন্দ্র সদন চত্বরে। সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো। মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর এ দিনই তাঁর বাগুইআটির দোতলা বাড়িতে ভিড় করেন রাজ্যের জনাতিনেক মন্ত্রী-সহ অসংখ্য মানুষ। তাঁর ছাত্র, অনেক প্রাক্তন ফুটবলারও ছিলেন সেই ভিড়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অমলবাবুর ছেলেকে ফোন করে শোক জানান।
দীর্ঘ রোগভোগের পর অমল দত্ত চলে গেলেন। পিছনে পড়ে রইল তাঁর দীর্ঘ পাঁচ দশকের বিতর্কিত আর বৈচিত্রময় ভাবমূর্তি। জীবদ্দশায় তিনি যে সব চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়েছেন এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে তার তুলনা কমই আছে।
ষাটের দশকে ইংল্যান্ড থেকে এফএ কোচিং ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পরে মান্ধাতা যুগের ক্যামেরা ঘাড়ে গ্রামে-গঞ্জে পেলে-গ্যারিঞ্চা, দি’স্তেফানোর খেলা দেখিয়েছেন। সঙ্গে চলত তাঁর নিজের ধারাভাষ্য। হুমড়ি খেয়ে পড়তেন ফুটবলপিপাসুরা। ইস্টার্ন রেলের ভাল চাকরি ছেড়ে সটান চলে গিয়েছিলেন এফ-র ডিগ্রি নিতে। স্ত্রীর গয়না বেঁচে পাওয়া টাকায়। যখন গোটা ভারতে পেশা হিসেবে কেউ ফুটবল কোচিংকে বাছার কথা কল্পনাই করতে পারত না। পরিবারের কথা না ভেবে ঝাঁপ দিয়েছিলেন অনিশ্চিত জীবনে। সে জন্য তাঁকে কম হ্যাপা পোয়াতে হয়নি।
তিন প্রধান ছাড়াও টালিগঞ্জ অগ্রগামী থেকে শুরু করে ডেম্পো, বিএনআর, টাইটানিয়াম, ভ্রাতৃ সংঘ, চার্চিল ব্রাদার্স, ইউনাইটেড স্পোর্টস— পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ ভারতের নানা ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন। ৩৭টা ট্রফি জিতেছেন সব মিলিয়ে। জাতীয় কোচ হয়ে জিতেছেন সাফ কাপ। তা সত্ত্বেও সে ভাবে সর্বভারতীয় কোনও স্বীকৃতি পাননি কোনও দিন। যা নিয়ে আক্ষেপ কম ছিল না তাঁর। পরিচিত সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘‘আমি তো ঠোঁটকাটা, সে জন্য সবাই আমাকে ছাঁটাই করে। পুরস্কার দেয় না। সম্মান দেয় না। এ সব করে অমল দত্তকে ঠেকানো যাবে না। সত্যি কথা আমি বলবই। তাতে যা হয় হোক।’’ ফেডারেশন থেকে মোহনবাগান, আইএফএ থেকে ইস্টবেঙ্গল— অমলবাবুর তীব্র ঝাঁঝালো আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি কেউই। কারণে-অকারণে এমন সব মন্তব্য করেছেন যা তাঁকে বারবার বিতর্কের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। ভাল তবলা বাজাতেন। কিন্তু কথাবার্তায় কোনও দিনই তাল ছিল না।
অমল দত্তের কোচিং কেরিয়ারের অন্যতম বড় ঘটনা সাতানব্বইয়ের ফেড কাপ সেমিফাইনালের ডার্বি। সে বার মোহনবাগানের কোচ হয়ে আমদানি করেছিলেন ডায়মন্ড সিস্টেম। যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে। তাঁর সৃষ্ট হিরের জাদু দেখতে যুবভারতীতে এত দর্শক এসেছিল, যাকে বিশ্ব ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। অমল বনাম পিকের সেই লড়াই দেখতে স্টেডিয়ামে হাজির ছিল এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শক। বিশ্রি ভাবে ম্যাচটা হেরেছিল অমলের বাগান। কোচিং কেরিয়ারে মোহনবাগানকে কুড়িটা ট্রফি দেওয়ার পরেও এয়ারপোর্ট সংলগ্ন এক হোটেলে তাঁর হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে ছাঁটাই করেছিলেন ক্লাব সচিব। যা নিয়ে অমলের মন্তব্য ছিল, ‘‘ওরা কালিদাস!’’ অমল দত্ত যে এ রকমই।
বিতর্কিত ইমেজ আর জেদ বজায় রেখেছিলেন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও। ডাক্তার বা ছেলে-বৌমা বারবার চাইলেও বাগুইআটির বাড়ি ছেড়ে হাসপাতালে যাননি। প্রিয় ফুটবলার-ছাত্ররা টাকা দিয়ে সাহায্য করতে এলে রেগে গিয়েছেন। বিছানায় শুয়ে বলেছেন, ‘‘আমার দরকার নেই।’’
রামধনুর মতো বর্ণময় জীবন কাটিয়েও ডায়মন্ড কোচ আসল হিরের বদলে ‘কাঁচ কাটা হিরে’ হয়ে থেকে যাবেন ভারতীয় ফুটবল আকাশে!