চুয়াল্লিশের চায়নাম্যান আর রবিনহুডের মস্তানিতে ইডেনে নাইটদের জয়ধ্বনি

ইডেনের ধ্বনি বনাম সিএসকে-র ধোনি। ইডেনের পরীক্ষা। কেকেআরেরও। শেষ হাসিটা কিন্তু ফুটল ইডেনের মুখেই। দু’দিন আগের দু’রানে হারের বদলা সাত উইকেটে জিতে নিয়ে হাসি গৌতম গম্ভীরের মুখেও। ঘরের মাঠে ১৬৬-র টার্গেটটা যে পাহাড়প্রমাণ, তা কী করে বলা যায়? এর চেয়েও বড় রান তাড়া করে যে ইডেনে জিতেছে নাইটরা। কিন্তু দু’দিন আগে চিপকের হারের কাঁটাই খোঁচাচ্ছিল তাদের।

Advertisement

রাজীব ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৪:১৩
Share:

ই়ডেন যখন নাইটদের। দুরন্ত হগ। বেপরোয়া রাসেল।

ইডেনের ধ্বনি বনাম সিএসকে-র ধোনি।

Advertisement

ইডেনের পরীক্ষা। কেকেআরেরও।

শেষ হাসিটা কিন্তু ফুটল ইডেনের মুখেই।

Advertisement

দু’দিন আগের দু’রানে হারের বদলা সাত উইকেটে জিতে নিয়ে হাসি গৌতম গম্ভীরের মুখেও।

ঘরের মাঠে ১৬৬-র টার্গেটটা যে পাহাড়প্রমাণ, তা কী করে বলা যায়? এর চেয়েও বড় রান তাড়া করে যে ইডেনে জিতেছে নাইটরা। কিন্তু দু’দিন আগে চিপকের হারের কাঁটাই খোঁচাচ্ছিল তাদের। কেকেআরের অর্ধেক ওভার ব্যাটিংয়ের পর যখন আস্কিং রেট বেড়ে দাঁড়ায় দশ, তখন খোঁচানিটা আরও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। আন্দ্রে রাসেল ও রবিন উথাপ্পা তখন ক্রিজে। সূর্য, মণীশ ও গম্ভীর ডাগ আউটে ফিরে গিয়েছেন। ধোনির দলের বোলাররা প্রাণপণে চাপে রাখছেন তাঁদের।

এখান থেকেই লড়াই শুরু রাসেল ও উথাপ্পার। সারা ইডেন জুড়ে তখন গুঞ্জন, এটা কি টেস্ট ম্যাচ খেলছে কেকেআর ব্যাটসম্যানরা! ১৬৬-র টার্গেট নিয়ে নেমে দশ ওভারে ৬৬! ইনিংসের বয়স ১৫ ওভার হতে বিস্ময়ের ঘোর যেন আরও বাড়ল। ৩০ বলে দরকার ৪৮। আস্কিং রেট প্রায় একই— ৯.৬। তখনও রাসেল ক্রিজে, হাফ সেঞ্চুরির গণ্ডি পেরিয়েছেন উথাপ্পা। নেহরা, ব্র্যাভোরা তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার চেষ্টায় মরিয়া। মাঝে মাঝে জাডেজাকে বল করিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিলেন ধোনি।

সতেরো নম্বর ওভারে শুরু হল সেই ক্যারিবিয়ান ‘ডুয়েল’। ব্র্যাভো বনাম রাসেল। পরপর দুটো ছয় রাসেলের। একটা মিড উইকেটের উপর দিয়ে, অন্যটা স্কোয়ার লেগের উপরে। এখান থেকেই নিজেদের দিকে ম্যাচের মুখ ঘুরিয়ে নিল নাইট-বাহিনী। বল ও রানের ব্যবধানটা কমে দাঁড়াল সমান-সমান। চিপকের হারের বদলা নিতে ১৮ বলে ১৯ রান দরকার। শেষ দুই ওভারে ১১। ইডেন-ধ্বনি ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। শেষের আগের ওভার করতে এলেন মোহিত শর্মা। দ্বিতীয় বলেই উথাপ্পা কভার দিয়ে বাউন্ডারি পার করিয়ে দিলেন তাঁকে। একশোর পার্টনারশিপও পেরিয়ে গেল তাঁদের। কিন্তু এ ছাড়া আর রান কোথায়? চার চারটে ডট বল সেই ওভারে। ছ’বলে ছ’রান দরকার।

শেষ ওভারে ধোনির ফাটকা— রনিত মোরে। প্রথম আইপিএল ম্যাচ খেলছেন। তার আগে মাত্র ছ’টা প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতা। তিন বলে চার রান দিলেন বেলগাঁওয়ের ২৩ বছর বয়সি মিডিয়াম পেসার। চতুর্থ বলে ফের একটা খুচরো রান। সমান-সমান। স্কোর লাইন সমান। পাঁচ নম্বর বলটা রাসেলের প্যাডে লেগে ফাইন লেগ দিয়ে সোজা বাউন্ডারিতে আর ইডেন উত্তাল নাইটদের জয়ের আনন্দে।

বাবা হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির শহরে এই প্রথম পদার্পন ধোনির। কন্যা জিবাকে কোলে নিয়ে এ শহরে পা রাখার ছবি তো লক্ষ্মীবারের সকালে দেখেই নিয়েছে কলকাতা। সঙ্গে স্ত্রী সাক্ষী। বোধহয় ভেবেছিলেন জোড়া লেডি লাকের ভরসায় ইডেন কাঁপাবেন। কিন্তু সে ভাবনায় জল ঢেলে দিলেন রাসেল, উথাপ্পা ও ৪৪ বছর বয়সি অস্ট্রেলীয় চায়নাম্যান বোলার ব্র্যাড হগ।

আগের দিন বেঙ্গালুরুতে ম্যাজিক দেখিয়েছেন ১৭-র সরফরাজ, এ দিন ইডেনে জ্বলে উঠলেন ৪৪-এর হগ। একেই বলে আইপিএল।

শেন ওয়ার্নের দাপটে অস্ট্রেলিয়া দলের বাইরে প্রায় সাত বছর বসে থাকার সময় যে বিদ্যাটা রপ্ত করেছিলেন ‘হগি’, সেই চায়নাম্যান ম্যাজিকেই এ দিন ইডেন মাতালেন। ভারতেই শেষ টেস্ট সিরিজ খেলে অবসর ঘোষণা করা হগ কমেন্ট্রি বক্সে প্রাক্তনদের পাশে বসে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে হঠাৎ ক্রিকেট মাঠে ফেরার সিদ্ধান্ত, ২০১২-র বিগ ব্যাশে খেলা, ভারতের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি জাতীয় দলে ডাক পাওয়া এবং রাজস্থান রয়্যালসের হাত ধরে সে বছরই আইপিএল গ্রহে ঢুকে পড়া। বৃহস্পতিবারের পারফরম্যান্সের আগে এক ঝলকে তাঁর ইতিহাস এটাই। প্রত্যাবর্তনের সেই নায়কের হাত ধরেই এ দিন চেন্নাইয়ের ব্যাটিংকে বেঁধে রাখল কেকেআর।

চিপকে যে ভাবে দল হেরেছে, তার পর যে ভাবে শিবিরে এসে আছড়ে পড়েছে নারিন-বার্তা, তার পরে নাইটদের শিবিরে যে যথেষ্ট উত্তাপ জোগাল এই জয়, তা ম্যাচের পর গম্ভীরের ছেলেদের উল্লাসেই স্পষ্ট। গম্ভীরও বললেন, ‘‘এটা ছিল আমাদের টেস্ট অফ ক্যারেক্টর। ছেলেদের বলে দিয়েছিলাম, আমরা যে গত বারের চ্যাম্পিয়ন, তা প্রমাণ করতে আমাদের আজ জিততেই হবে। ছেলেরা সেটাই প্রমাণ করে দেখাল।’’ বনধ্, বৃষ্টির পূর্বাভাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইডেন উপছে পড়া হাজার ষাটেক ক্রিকেটপ্রেমী তাঁদের প্রিয় নাইটদের কাছ থেকে যে পারফরম্যান্স দেখতে এসেছিলেন তা-ই দেখালেন গম্ভীররা।

প্রথম বলেই কভার পয়েন্টে অনবদ্য ক্যাচ ধরে রায়ান টেন দুশখাতে যে ইঙ্গিত দেন, খেলা শেষে সেটাই প্রমাণ হল।

শুরুতেই উঠল ম্যাকালাম-ঝড়। ইডেনে তখন চিপকের রিপ্লে-র পূর্বাভাস। বল হাতে নিয়ে যা পুরো পাল্টে দিলেন হগ। তাঁর প্রথম ওভারের প্রথম বলই পুল করতে গিয়ে এলবি ডব্লিউর ফাঁদে পড়ে যান বিধ্বংসী ম্যাক। ২৬৬-র স্ট্রাইক রেট নিয়ে তিনি ব্যাট করছিলেন তখন। ১২ বলে ৩২। উমেশ যাদব দ্বিতীয় ওভারে ফিরে এসে ফেরত পাঠালেন রায়নাকে।

এর পরই ইডেন জুড়ে ধ্বনি উঠল কেকেআর.... কেকেআর....। এই জয়ধ্বনির মধ্যেই নেমেছিলেন ধোনি। ইডেন যাঁর কাছে অপয়া নয়। ধোনির কাছ থেকে একটা ‘কোয়ালিটি’ ইনিংস যে চায়নি ইডেন, তা নয়। তবে কেকেআর-কে বিপদে ফেলে? ধর্মসঙ্কটে পড়ে যাওয়া ইডেন-দর্শকরা তবু গম্ভীরদের জন্যই চেঁচালেন। চাওলার গুগলি তাঁকে ফেরত পাঠাতেই যেন বনধে্ প্রভাবিত আপাত শান্ত কলকাতা কেঁপে উঠল ইডেনের গ্যালারির গর্জনে। আরও একটা তথ্য, এই প্রথম আইপিএলে ধোনির উইকেট পেলেন চাওলা।

ক্রিকেটের নন্দনকাননে ধোনিকে ছাপিয়ে গেল গ্যালারির ধ্বনি। হাতে চোট পাওয়া রবিচন্দ্রন অশ্বিন তখন বাড়িতে বসে টুইট করছেন ‘হাহ্’। দীর্ঘনিশ্বাস! জবাবে রোহিত শর্মার টুইট, ‘‘তুই মাঠে থাকতে পারতিস’’। অশ্বিন হয়তো এখন ভাবছেন, সত্যিই এমন হলে ভাল হত। নারিন বনাম অশ্বিন লড়াইটা হয়তো দেখতে পেল না ইডেন। কিন্তু পেল তার চেয়েও বেশি কিছু।

প্রিয় দলের জয়ের চেয়ে বড় আর কী-ই বা হতে পারে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

চেন্নাই সুপার কিঙ্গস ১৬৫-৯ (ম্যাকালাম ৩২, হগ ৪-২৯)

কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৬৯-৩ (উথাপ্পা ৮০ ন.আ., রাসেল ৫৫ ন.আ., মোহিত ১-২২)

ছবি: উত্পল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন