সেই প্রথম টেস্টের দুই কুশীলব। হাবিবুল ও আকরাম।
ষোলো বছর আগে যাদের টেস্ট ক্রিকেটের অভিযান শুরু, সেই বাংলাদেশ শততম টেস্টের দোরগোড়ায়।
বৃহস্পতিবার নিজামের শহরের অদূরে উপ্পল স্টেডিয়ামে যে ঐতিহাসিক টেস্টে বিরাট কোহালির সঙ্গে টস করতে নামবেন মুশফিকুর রহিম, সেটা হবে তাঁদের ৯৮তম টেস্ট ম্যাচ।
যে ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের মাঠে শুরু হয়েছিল ওপার বাংলার টেস্ট অভিযান, সেই ভারতে এসে টেস্ট খেলতে যে তাদের ষোলো বছর লেগে গেল, তা ভেবে সে দেশের ক্রিকেট মহলের অনেকেই অবাক।
হাবিবুল বাশার যেমন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর দেশের প্রথম টেস্টে দু’ইনিংস মিলিয়ে একশোর উপর রান করা এই ব্যাটসম্যান বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে ফোনে বললেন, ‘‘এটা আমাদের দুর্ভাগ্য বলতে পারেন যে, ষোলো বছরে একশো টেস্টও খেলতে পারলাম না। তা ছাড়া এত বছর পরে আমরা ভারতে গিয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ পাচ্ছি, এটাও কম অবাক করার মতো নয়। তবে সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন তা কাজে লাগাতে হবে আমাদের। ভারতের বিরুদ্ধে ভাল খেলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে।’’
প্রাক্তন টেস্ট অধিনায়ক হাবিবুল এখন জাতীয় নির্বাচক। ২০০০-এর নভেম্বরে দেশের প্রথম টেস্টে তাঁর সতীর্থ ব্যাটসম্যান আকরাম খান, যিনি এখন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা, এ দিন ফোনে বলেন, ‘‘আমরা যেমন অনেক বেশি ওয়ান ডে খেলার সুযোগ পেয়েছি বলে এই ফর্ম্যাটে অনেক উন্নতিও করেছি। সে ভাবেই যত বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পাব, তত টেস্টেও উন্নতি করব। ভারতের বিরুদ্ধে এই টেস্টটা আমাদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ। বহুকাল ধরে এই ম্যাচটার জন্য অপেক্ষা করে আছি আমরা। এই টেস্টে জিতি-হারি, ভাল খেলতেই হবে।’’ সেই ম্যাচ দেখতে হায়দরাবাদে আসছেনও আকরাম।
বাংলাদেশি ক্যাপ্টেন মুশফিকুর অবশ্য ভারতে রওনা হওয়ার আগে বলেছেন, ‘‘কত বছর অপেক্ষার পর ভারতে টেস্ট খেলছি, সেটা বড় কথা নয়। আমরা ক্রিকেটবিশ্বকে দেখাতে চাই ভারতের মাটিতে আমরা কী করতে পারি। যাতে ভারত এর পর বারবার আমাদের টেস্ট খেলার জন্য ডাকে।’’ আগ্রাসন যেন পিছন থেকে উঁকি মারছে মুশফিকুরের এই বিবৃতিতে।
মুশফিকুর। হায়দরাবাদে পরীক্ষা বাংলাদেশ অধিনায়কের।
ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট মানেই এখন উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকা। সেটা মাঠেই হোক কী গ্যালারিতে কী সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রথম টেস্টের সময় এমনটা ছিল না, বলছেন প্রাক্তনরা। হাবিবুল বললেন, ‘‘সেই টেস্টে গ্যালারি প্রায় উপচে পড়ার উপক্রম ছিল। কিন্তু কোনও গোলমাল হয়নি কখনও। সৌরভ, সচিন, রাহুলদের সঙ্গে ভালই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আমরা একসঙ্গে খেতে গিয়েছি। জাভেদ উমরের বাসায় সৌরভ, সচিনের দাওয়াতও ছিল সে বার।’’
আকরাম বললেন, ‘‘১৯৯৮-এ কোকা কোলা কাপ খেলতে যাওয়ার আগে মুম্বইয়ে সচিনের কাছ থেকে প্রচুর মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছিলাম আমরা। ওকে অনুরোধ করার পর ও লোক দিয়ে আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলেছিল। এমনই সম্পর্ক ছিল আমাদের। তার পর যখন ওরা প্রথম টেস্ট খেলতে এল আমাদের দেশে, তখন তো প্রচুর খাতির করেছিলাম ওদের।’’
জেট গতির ক্রিকেটের যুগে সে সব প্রায় উধাও। সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব আগের মতো কোথায়? হাবিবুল বলছেন, ‘‘তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের কাছে এত প্রত্যাশা ছিল না, যা এখন আছে। সে জন্যই এখন হইচইটাও অনেক বেশি। আমাদের সমর্থকদের দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে জিততে হবে। তখন এই প্রত্যাশাটা ছিল না বলেই হইচইও ছিল না।’’ আকরাম দায় চাপাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ার ঘাড়ে, ‘‘এর জন্য দায়ী সোশ্যাল মিডিয়া। এত চর্চা, এত হইচই শুরু হয়ে যায় দুই দেশে যে, সেই থেকেই একে অপরের প্রতি প্রতিদ্বন্দিতার তীব্র মনোভাবটা চলে আসে। তবে আমার কিন্তু মনে হয় না, দুই দেশের সমর্থক বা কোন ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনও শত্রুতা আছে।’’
দুই প্রাক্তনের বিশ্বাস, বৃহস্পতিবার কলকাতা ছুঁয়ে হায়দরাবাদ যাওয়ার আগে মুশফিকুর যা বলেছেন, সেটা ফাঁকা আওয়াজ নয়। হাবিবুল বলেন, ‘‘ইন্ডিয়া মানে তো হোম কন্ডিশন। বিরাট কোহালিদের নিশ্চয়ই ভাল টিম। তবে হোম কন্ডিশনে আমাদের টিমও কিন্তু খারাপ খেলে না।’’ সম্প্রতি ঢাকায় ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারানোর কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। আকরাম বাস্তববাদী। তিনি ভারতকে এগিয়েই রাখছেন এই টেস্টে। তবে বলছেন, ‘‘ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো ক্রিকেটারও কিন্তু আমাদের দলে আছে। শাকিব, মুশফিকুর, তামিমরা মাঠে নিজেদের উজাড় করে দিতে তৈরি। হার-জিত যাই হোক, লড়াই করবে আমাদের টিম। এটাই তো দরকার।’’
নির্বাচক হাবিবুলের আফসোস, ‘‘মুস্তাফিজুরকে যদি দলে পেতাম, তা হলে খুব ভাল হত। হায়দরাবাদ আইপিএলে ওর হোম গ্রাউন্ড। ওই মাঠটা সম্পর্কে ও অনেক কিছু জানে। সেগুলো কাজে লাগত। এই মাঠে ও ভাল বলও করত।’’ আকরাম অবশ্য বলে দিলেন, ‘‘মুস্তাফিজুরের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্যই পেয়েছে আমাদের টিমের ছেলেরা। ও টিমে না থাকলেও সেগুলো ওদের সঙ্গে থাকবেই। আর সেগুলো কাজেও লাগবে। মুস্তাফিজুর সঙ্গে না থাকলেও ওর অভিজ্ঞতাকে আমাদের ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।’’
আগামী বৃহস্পতিবার থেকে শুরু টেস্টে মুস্তাফিজুর দলে না থেকেও মুশফিকুরদের সঙ্গে থাকছেন। তিনিই হয়তো হয়ে উঠবেন তাদের অদৃশ্য দ্বাদশ ব্যক্তি।