ঠিক করেই রেখেছিলাম হারলে সরে যাব: সঞ্জয়

হারের দায় মাথায় নিয়ে যখন সঞ্জয় সেন হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছেন, ‘‘আমি আর মোহনবাগানের কোচ থাকছি না। সব দায় নিয়ে পদত্যাগ করছি।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১০
Share:

পদত্যাগ: তাঁবুতে ফেরার পথে তা দেখছেন সঞ্জয় সেন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

হঠাৎ-ই উড়ে এল ইট। সেটা আবার সাংবাদিক সম্মেলন চলার সময়ই। ইট-টা অবশ্য লক্ষ্যভ্রস্ট হল। কিন্তু সদস্য গ্যালারির উপর থেকে ছেটানো থুতু পড়ল কোচের গায়ে। সঙ্গে অশ্রাব্য গালাগালি!

Advertisement

হারের দায় মাথায় নিয়ে যখন সঞ্জয় সেন হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছেন, ‘‘আমি আর মোহনবাগানের কোচ থাকছি না। সব দায় নিয়ে পদত্যাগ করছি।’’ তখনও চলছে একই রকম অভব্যতা।

যে গ্যালারি টিম পিছিয়ে পড়ার পরও গান গেয়েছে, সাড়ে তিন সপ্তাহ আগে ডার্বি জোতার পর আকাশে আবির উড়িয়েছে, কোচের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে, পয়েন্ট নষ্টের পরও সবুজ-মেরুন পতাকা উড়িয়ে টিমকে সাহস জুগিয়েছে, সেই গ্যালারির এই চরিত্র! অবাক হচ্ছিলেন প্রবীণ অনেক সদস্যও। সবথেকে যেটা চোখে পড়ার তা হল, গত সাড়ে তিন বছরে কোচকে হেনস্থার সময় কোনও কর্তা বা পুলিশ উগ্র সমর্থকদের আটকায়নি এ দিন। সে জন্যই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে এটা কি আদৌ সদস্য-সমর্থকদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ না কি পূর্ব পরিকল্পিত? ইন্ডিয়ান অ্যারোজ ম্যাচে টিম ড্র করার পরও বিশেষ একটি ফ্যানস ক্লাবের জার্সি পরে ক্লাব তাঁবুর বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন কিছু সমর্থক। তাদের অনেককেই দেখা গিয়েছে এ দিন। দু’একজন পরিচিত নিয়মিত ক্লাবে আসা সদস্য-কর্মী, যাঁদের নিয়মিত মাঠে দেখা যায় তাঁরা ছিলেন ওঁদের আশেপাশে। নানাভাবে উস্কানি দিচ্ছিলেন তাঁরা, ক্ষিপ্ত সমর্থকদের।

Advertisement

আরও পড়ুন: দশ জনের চেন্নাইয়ের কাছে হার বাগানের

তা হলে কী সঞ্জয়কে চাপ সৃষ্টি করে সরানোর নীল নকশা তৈরিই ছিল? ময়দানি গুঞ্জন অবশ্য এ রকমই। কিন্তু তা বলে এভাবে? তিনটে ম্যাচ ড্র করার পরও সনি নর্দেদের কোচকে লক্ষ্য করে এমনভাবে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তুলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল হারের হ্যাটট্রিক হয়েছে। টিম খেতাব থেকে ছিটকে গিয়েছে। যা মানতে পারছিলেন না সঞ্জয়।

মোহনবাগানে কোচ তাড়ানোর অপমানের সংস্কৃতি বহুদিনের। অমল দত্তকে হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। সৈয়দ নইমুদ্দিনকে গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘কাল থেকে আসার দরকার নেই।’ পয়লা বৈশাখের দিন কোচের পদ থেকে সরানো হয়েছিল ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্যকে। শুধু তাই নয়, ক্লাবকে দু’বার আই লিগ-সহ অসংখ্য ট্রফি দেওয়া সুব্রতকে ক্লাব লনে হেনস্থারও স্বীকারও হতে হয়েছিল। এরপর করিম বেঞ্চারিফা বা স্টিভ ডার্বিকে সরানো হয়েছিল। তবে হাতে ফুল দিয়ে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে। সঞ্জয়ের বিদায়ে একশো সাতাশ বছরের ক্লাবে আবার ফিরে এল সেই অভব্য কোচ তাড়ানোর সংস্কৃতি। পরম্পরাও।

হারের পর গ্যালারিতে তাঁর বিরুদ্ধে সরব সমর্থকরা।

সঞ্জয় কয়েক দিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন কিছু একটা ঘটছে ড্রেসিংরুমে। তাঁর বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টাও হচ্ছে। নানা ভাবে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যাতে তিনি নিজেই সরে যান। কারণ, তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন, এক শ্রেণীর ক্লাব কর্তা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, ‘ড্রেসিংরুম এখন কোচের সঙ্গে নেই,’ ‘অস্ত্রোপচারের পর সঞ্জয় আর পারছেন না,’ ‘কোচের প্ল্যান বি, সি, ডি কিছু নেই’-এর মতো কথাগুলো।

সঞ্জয়ের মোহনবাগান কোচিংয়ের ট্র্যাক রেকর্ড দুর্দান্ত। তিন বছরে আই লিগে একবার চ্যাম্পিয়ন, দু’বার রানার্স সঙ্গে একটি ফেড কাপ। বেঙ্গালুরুর প্রাক্তন কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড ছাড়া দেশের আর কোনও কোচের তিন বছরের কোচিংয়ে এই রেকর্ড নেই। সবথেকে বড় কথা আই লিগে ঘরের মাঠে মঙ্গলবারের আগে পর্যন্ত ম্যাচ না হারার অসাধারণ রেকর্ড ছিল চেতলার কোচের। ডার্বিতে জেতা-সহ ছয় ম্যাচে একটিও না হারার পরও যেভাবে শুধু ড্র করার জন্য বিক্ষোভ দেখানো চলছিল, তাতে তিনি প্রচন্ড বিরক্ত ছিলেন।

ঠিকই করে এসেছিলেন এ দিন না জিতলে সরে দাঁড়াবেন। মোহনবাগানকে তেরো বছর পর আই লিগ দেওয়া কোচ সেটা বলেও দিয়েছেন পদত্যাগের পর। ‘‘আমি আগেই ঠিক করে এসেছিলাম পরপর তিনটে ম্যাচ না জিততে পারলে সরে যাব। তাই সরে যাচ্ছি। অমলদা, নইমদা, বাবলুদা-কেও সরতে হয়েছিল। কলকাতা লিগ জেতার পর বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যকেও সরানো হয়েছিল। ময়দানে কী হয়, তা দেখাব বলেই আজ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম ক্লাবে।’’

কথাগুলো বলার সময় একই রকম ডাকাবুকো মেজাজে মোহনবাগান ক্লাবের ইতিহাসে সবথেকে বেশি সময় কোচের পদে থাকা সঞ্জয়। জানতেন, তাঁর যা পারফরম্যান্স তাতে তাঁকে সরানোর সাহস ক্লাব কর্তাদের নেই। সরলে তিনি নিজেই সরবেন। যাতে তিনি যে মোহ নিয়ে থেকে যাচ্ছেন, এটা কেউ বলতে না পারে। কিন্তু সবাই তো বলবে দলকে সমস্যায় ফেলে পালিয়ে গেলেন? প্রশ্ন শুনে সঞ্জয়ের উত্তর, ‘‘এখনও টিমের লিগ জেতার সম্ভবনা আছে। আর কে কি ভাবল, বলল আমার কিছু যায় আসে না।’’ কোচ পদত্যাগ করে সরে যাওয়ায় অবশ্য কর্তারা অবাক নন। ক্লাবের অর্থ সচিব দেবাশিস দত্ত বলে দিলেন, ‘‘যিনি মানসিকভাবে নিজে সরে যেতে চাইছেন তাঁকে তো ছেড়ে দিতেই হবে।’’

সঞ্জয়ের মতো কোচকেও তা হলে বাধ্য হয়ে সরে যেতে হয়। ময়দান যে বড়ই নিষ্ঠুর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন