কোর্ট যখন ব্যাট হাতে

বদলে গেল ক্রিকেট, বিতর্ক রেখেই শুরু নয়া যুগ

ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য দিন হিসেবে অবিসংবাদী স্বীকৃত ২৫ জুন। কপিলদের বিশ্বজয়! কাছাকাছির মধ্যে ২ এপ্রিল, ২০১১। ধোনির ছক্কায় বিশ্বজয়! তার কিছু পর পঁচাশির ১০ মার্চ। মেলবোর্নে জাভেদ মিয়াঁদাদের পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতা আর অডি নিয়ে ঘুরপাক। এমন এক জন ফ্যানও হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সোমবার, ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটের বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যের ফিকে ভাগ দেখছেন।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৬ ০৪:৩৮
Share:

নেপথ্যে যাঁর কমিটি। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢা। — ফাইল চিত্র।

ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য দিন হিসেবে অবিসংবাদী স্বীকৃত ২৫ জুন। কপিলদের বিশ্বজয়!

Advertisement

কাছাকাছির মধ্যে ২ এপ্রিল, ২০১১। ধোনির ছক্কায় বিশ্বজয়!

তার কিছু পর পঁচাশির ১০ মার্চ। মেলবোর্নে জাভেদ মিয়াঁদাদের পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতা আর অডি নিয়ে ঘুরপাক।

Advertisement

এমন এক জন ফ্যানও হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সোমবার, ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটের বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যের ফিকে ভাগ দেখছেন। কারও কারও বরং মনে হচ্ছে, দিনটা ধূসর আর ভীষণ মর্মান্তিক।

কিন্তু এ দিন দুপুরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ক্রিকেট-রায়কে পরবর্তী সময় অবিসংবাদী স্বীকৃতি দিচ্ছে ক্রীড়া প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী দিন হিসেবে! বলা হচ্ছে, দেশের প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর এবং ইব্রাহিম কলিফুল্লার সম্মিলিত রায়ের পর ভারতীয় ক্রিকেট আর সাবেকি চেহারায় থাকল না।

এ বার নাকি বদলে যেতে বাধ্য দেশের বাকি সব ক্রীড়া সংস্থাও। সম্ভবত নতুন টেমপ্লেট তৈরি হল জাতীয় ক্রীড়া প্রশাসনের। ওপেনার হিসেবে যা প্রথম প্রত্যক্ষ করল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড।

রায়ের তাৎক্ষণিক প্রকোপ হিসেবে যা দাঁড়াল— নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন, শরদ পওয়ার, এ সি মুথাইয়া, ফারুক আবদুল্লারা ক্রিকেট প্রশাসন থেকে চিরনির্বাসিত হয়ে গেলেন। লোঢা কমিটির সুপারিশ মেনে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল, বয়স সত্তরের বেশি হয়ে গেলে স্ট্রেট বাড়ি যাও। ক্রিকেট প্রশাসন তোমার জন্য নয়। ক্রিকেটমহলের একাংশে তীব্র বিরুদ্ধাচরণ শোনা গেল। দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর জন্য সত্তর বছরের আইন নেই। ক্রিকেট বোর্ডে কেন? কিন্তু সেটা শুনছে কে! সোমবারের পর আইন তো হয়েই গেল।

অরুণ জেটলির মতো মন্ত্রীদের ভবিষ্যতে কোনও ক্রিকেট পদ অলঙ্কৃত করার উপায় খোলা থাকল না। আই এস বিন্দ্রার মতো আমলারও না। আদালতের নির্ঘোষে মন্ত্রী বা আমলারা কোনও পদের অধিকারী হওয়া থেকে ব্রাত্য হয়ে গেলেন। মাধবরাও সিন্ধিয়া, এন কে পি সালভে বা পওয়াররা যে জবরদস্ত বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সেটা এ বার থেকে শুধুই ইতিহাসের পাতা।

বর্তমান বোর্ড প্রধান অনুরাগ ঠাকুরকে এত দক্ষ ভাবে শাসনব্যবস্থা চালিয়েও দু’হাজার সতেরোর সেপ্টেম্বরে তিন বছরের স্বেচ্ছাবসর নিতে হবে। কারণ তখন বোর্ডে তাঁর নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই চলে যেতে হবে সমপরিমাণ অর্থাৎ তিন বছরের কুলিং-অফ পিরিয়ডে। সেই ক্রিকেট বনবাস কাটিয়ে তবেই ফেরত আসতে পারবেন।

এ দিন কোর্ট যা বলে দিয়েছে তার মর্মার্থ, তোমার নাম অনুরাগ ঠাকুর হোক কি বিশ্বরূপ দে— সকলের জন্য এক নিয়ম। রাজ্য বা জাতীয় ক্রীড়া সংস্থায় যদি ন’বছর কাটিয়ে ফেলো, তা হলে চলে যেতে হবে। আর ফেরার কোনও ব্যাপার নেই।

অনুরাগকে যদি পরের বছর বনবাসে চলে যেতে হয়, তা হলে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে মনোনয়ন পাবেন, সেই আলোচনাও এ দিন উঠল। পশ্চিমাঞ্চল লবি-সহ অনেকের মনে হচ্ছে, অজয় শিরকে হতে পারেন সেই ব্যক্তি। সে ক্ষেত্রে সচিব পদে? হট ফেভারিট দেখাচ্ছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। সিএবি সংবিধান না বদলালে সৌরভকে অবশ্য এমনিতেই এক বছরের মেয়াদ শেষে তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এ বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতলেও তাঁর মেয়াদ হবে ২০১৭-র জুলাই অবধি।

জটিল সব অঙ্ক আর তাকে ঘিরে এ বার সেই ক্ষেত্রটাই উপড়ে গেল।

মুম্বই থেকে আর এক ভারতীয় ওপেনার তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘‘সিসিআই-এর এত অবদান ভারতীয় ক্রিকেটে। ব্রেবোর্ন স্টেডিয়াম হল ভারতীয় ক্রিকেটের পীঠস্থান। তারা ভোট দেবে না! ভোট দেবে এমন সব রাজ্য, যারা ক্রিকেটের জন্য কিছুই করেনি। এটা কোন ধারার বিচার?’’

আদালত চায় ক্রিকেটারেরা আরও বেশি করে প্রশাসনে আসুন। ওয়ার্কিং কমিটিতে তারা বাধ্যতামূলক ভাবে এক জন করে পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেটার রাখতে বলেছে। প্রশ্ন হল, এই রায়ে ক্রিকেটারেরা কি খুব উল্লসিত? এক জন বললেন, ‘‘বোর্ডের পদ অবৈতনিক। এত দিন বোর্ডের পদে থেকে যে কোনও ক্রিকেট-চাকরি করা যেত। এখন সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘স্বার্থের সঙ্ঘাত’। তা হলে লোকে মাস মাইনে ছেড়ে ক্রিকেট প্রশাসনে যাবে কেন?’’ আগামী দিনে এই প্রশ্ন আরও বাড়তে বাধ্য। কীর্তি আজাদ ব্যতিক্রমী, যিনি তাঁর তীব্র বিরোধী দিল্লি ক্রিকেট সংস্থার আসন্ন দুর্দশা ভেবে উল্লসিত। আর সৌরভ ব্যতিক্রমী, যিনি ব্যক্তিগত রোজগারের ক্ষতি করেও সিএবি নিয়ে পড়ে রয়েছেন।

এই রায় মুখ্যত যাঁর সুপারিশ মেনে, সেই বিচারপতি লোঢা একগাল হেসে টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, ‘‘আমার এক বছরের মেহনত সার্থক। এই মেহনত রং নিয়ে এল ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর জীবনে।’’

সত্যি কি তাই? এমন তীব্র মেরুকরণে কোনও একটা উত্তরে পৌঁছনো অসম্ভব। এটুকু বলা যায়, অসংখ্য প্রশ্ন, বিহ্বলতা, আলোচনা আর দীর্ঘশ্বাসে ভরা অভিনব এক ক্রিকেট-দিন। যা ম্যাচ গড়াপেটা-বিদ্ধ সময়েও ভারতীয় ক্রিকেটে আসেনি।

হাজারো তর্ক আর অস্বীকারের মধ্যেও তাই একটা ব্যাপার মেনে নিতে সমস্যা নেই।

৮৮ বছরের ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর সাবেকি চেহারায় থাকল না। মৌরসিপাট্টা শব্দটা ওই ১৪৩ পাতার রায়ের পর আজ থেকে কেবল নথিতে পাওয়া যাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন