চল্লিশ সেকেন্ডে ভেস্তে গেল কলকাতার বোর্ড বৈঠক

শ্রীনির ভাগ্য স্থির হবে সেই সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে

নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন সমাজসেবামূলক কাজকর্মে তাঁর ব্যক্তিগত যোগদানের কথা বলছিলেন আনন্দবাজারের সাংবাদিককে। কী ভাবে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন মন্দির পুনর্নির্মাণে তাঁর সংস্থা সাহায্য করে থাকে। সিমেন্ট দিয়ে থাকে এই সব। কিন্তু আর পাঁচ দিনের মতো তাঁর চোখেমুখে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই যা নিয়ম করে প্রতিটি বোর্ড বৈঠকের পর থাকে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

বৈঠকের পর সন্ধের আতঙ্কের শ্রীনি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন সমাজসেবামূলক কাজকর্মে তাঁর ব্যক্তিগত যোগদানের কথা বলছিলেন আনন্দবাজারের সাংবাদিককে। কী ভাবে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন মন্দির পুনর্নির্মাণে তাঁর সংস্থা সাহায্য করে থাকে। সিমেন্ট দিয়ে থাকে এই সব। কিন্তু আর পাঁচ দিনের মতো তাঁর চোখেমুখে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই যা নিয়ম করে প্রতিটি বোর্ড বৈঠকের পর থাকে।

Advertisement

শুক্রবার সন্ধ্যায় কলকাতার পাঁচতারা হোটেলের এই শ্রীনির মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একগাদা অস্বস্তিতে ভরপুর। পরিস্থিতির ওপর সেই পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নেই নিয়ম করে যা ভারতীয় ক্রিকেটমহল দেখে এসেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে মিনিট দশেক আগে কলকাতার বোর্ড বৈঠক থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যে বৈঠক চলেছে এমন নয়। বরঞ্চ সভায় তাঁর যোগ দেওয়া উচিত না নয়, এই নিয়ে আইনি বিতণ্ডায় সভাই মুলতুবি করে দেওয়া হয়।

রক্ষণশীল হিসেবে— কার্যনির্বাহ কমিটির সদস্যদের যাতায়াত ভাড়া, টিএ-ডিএ নিয়ে শুধুই এই বৈঠকের জন্য খরচ হয়েছে অন্তত পঞ্চাশ লাখ টাকা। পশ্চিমাঞ্চলের কর্তা বলছিলেন, ‘‘শুধু তো টাকা নয়, এক-একজন ব্যস্ত মানুষের সময়টা হিসেব করুন। কোথায় গিয়ে তা হলে দাঁড়ায়।’’ তা মোট হিসেবে যা-ই দাঁড়াক, শুক্রবারের বহুপ্রতীক্ষিত সভা শেষ হয়ে গেল মাত্র চল্লিশ সেকেন্ডে।

Advertisement

শুরুও হয় ৩৬ মিনিট দেরিতে। দেরির কারণ শ্রীনির অংশগ্রহণ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা। দু’দিন আগের আনন্দবাজারে প্রথম আভাস দেওয়া হয়েছিল, শ্রীনিকে কলকাতার বৈঠকে ঢুকতে দেওয়া নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হবে।

কিন্তু তখনও ভাবা যায়নি যে সেটা এই রকম বিকট চেহারা নেবে। আর সাতাশি বছরের বোর্ডের ইতিহাসে প্রথম নজির হয়ে দাঁড়াবে যেখানে কোনও একটি ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিয়ে সমঝোতায় আসতে না পারা কি না গোটা বৈঠক স্থগিত করে দেবে!

প্রেসিডেন্ট ডালমিয়া আগেই ঠিক করেছিলেন তিনি শ্রীনিকে সভায় ঢুকতে দেবেন না। বোর্ডের কাছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারকদের পরামর্শ নেওয়া ছিল যে শ্রীনিকে ঢুকতে দিলে আদালত অবমাননা হবে। সভাও অবৈধ ঘোষণা হবে। কিন্তু শ্রীনি আবার তাঁর তুরুপের তাস হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শ্রীকৃষ্ণর আইনি মতামত নিয়ে শহরে হাজির হন। যেখানে বিচারপতি বলছেন, শ্রীনির বৈঠকে যোগ দেওয়া নিয়ে কোনও আইনি বাধা নেই।

পরস্পরবিরোধী আইনি মতামতের জাঁতাকলে পড়ে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরা আজ বৈঠক করবে না। সর্বোচ্চ আদালতকেই আবেদন করবে যে আপনারা নিষ্পত্তি করে নিন শ্রীনি তামিলনাড়ুর প্রতিনিধি হিসেবে সভায় থাকতে পারবেন কি না? বোর্ডের তরফে আইনজীবী ঊষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি ঠাকুর ও খলিফুল্লাহর বেঞ্চে আবেদন করবেন দ্রুত রায় দেওয়ার জন্য। ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বার্ষিক সাধারণ সভা হবে ঠিক আছে। তার আগে ওয়ার্কিং কমিটি করতেই হবে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায় পেতে দেরি হলে বোর্ডের এজিএম পিছিয়ে অক্টোবরে চলে যেতে পারে।

শ্রীনি বৈঠকে ঢোকা নিয়ে এমন অনমনীয় জেদ দেখাতে পারেন তাঁর ঘনিষ্ঠরাও ভাবেননি। সকালে তিনি হোটেল পৌঁছনোর পরে ঘনিষ্ঠরা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, আপনি হলেন আইসিসি প্রেসিডেন্ট। এই ছোট বৈঠকে ঢোকা নিয়ে ঝামেলা করা আপনার শোভা পায় না। ছেড়ে দিন না ওরা যদি জোরজার করে। শ্রীনি শুনতেই রাজি হননি। বলতে থাকেন, ‘‘এখানে যদি ওরা আমাকে আটকে দেয়, তা হলে এজিএমের দিনেও একই অসভ্যতা করবে। যে করে হোক আমাকে আজ ঢুকতেই হবে।’’

এর পর শ্রীনি যান শরদ পওয়ারের কাছে। তিনি আজ কতটা মরিয়া তখনই সবাই বুঝে যান। কারণ, পওয়ার হলেন বোর্ড রাজনীতিতে শ্রীনির ঘোষিত, কট্টর শত্রু। পওয়ারকে তিনি বলেন, ‘‘আমি বৈঠকে ঢুকব নিজের ঝুঁকিতে। বোর্ডকে গ্যারান্টি দেব যে শাস্তি হলে সেটা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাবে।’’ এই ফর্মুলা রাজীব শুক্লর মতো বেশ কিছু বোর্ড সদস্য মেনেও নেন।

শ্রীনির ধারণা ছিল বাকিদেরও তিনি রাজি করিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু আপসসূত্র যে প্রত্যাখ্যাত হবে আর এত বছর তাঁর নিজের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত ক্রিকেট বোর্ডের বৈঠকে তাঁকে বসতেও দেওয়া হবে না, স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

রাতে হোটেলের লবিতে বসে থাকা শ্রীনিকে তাই কখনও কখনও গুলি খাওয়া বাঘের মতো লাগছিল। এ দিন রাতে চেন্নাই ফেরা বাতিল করেছেন। সদস্যদের সঙ্গে নাকি দফায় দফায় বৈঠক করবেন।

ক্রিকেট পর্যবেক্ষকদের মনে হচ্ছে শুক্রবারের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলির পরে বোর্ড প্রকাশ্য ভাগ হয়ে গেল। শ্রীনির দিকে ও শ্রীনির বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধপক্ষে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ডালমিয়া ও সচিব অনুরাগ ঠাকুর।

শ্রীনির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আদালত ও আদালতের বাইরে হাওয়া তোলা আদিত্য বর্মা এ দিন একই হোটেলে বহুক্ষণ বসেছিলেন। কিন্তু শ্রীনির সমস্যা এই মুহূর্তে আদিত্য নন। তাঁর সমস্যা হাতে যত বেশি সংখ্যক ভোটার নেওয়া। যাতে সেপ্টেম্বরের বৈঠকে তাঁর আইসিসি যাওয়া কোনও ভাবে না আটকায়।

শুক্রবার রাতের শ্রীনি যথেষ্ট শঙ্কিত, এটা বুঝে যে নিছক প্রেসিডেন্ট-সচিবের হাতে থাকলে তাঁকে পরিষ্কার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে। সেই গুলিটা ধেয়ে আসার আগে শ্রীনি চান পাল্টা গুলি করতে।

শুক্রবার রাত থেকেই তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা প্রেসিডেন্ট ডালমিয়ার বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকানো শুরু করে দিয়েছেন। একটা ক্যাম্পেনের জন্ম দিচ্ছেন যে প্রেসিডেন্টের শরীর স্বাস্থ্য এত কঠিন দায়িত্ব পালনের মতো অবস্থায় নেই। তাই সেপ্টেম্বরে নতুন লোকের কথা ভাবা হোক।

ডালমিয়া? তিনিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। শ্রীনি ইস্যুতে এত দূর চলে এসেছেন যে ফেরার রাস্তা নেই। রাস্তা নেই সমঝোতারও।

সুপ্রিম কোর্টের এজলাস আপাতত স্থির করবে রক্তপাতহীন অথচ নৃশংস বোর্ড রাজনীতির শেষ দৃশ্য কী হবে। শ্রীনি যদি বৈঠকে ঢোকার অনুমতি পেয়ে যান, তা হলে অনেক হিসেব সেপ্টেম্বরে উল্টে যাবে।

আর যদি তাঁকে আদালত আটকে দেয়, তা হলে বোর্ডে এত দিনকার শ্রীনি রাজ্যপাট শুক্রবারের সভার মতো স্থগিত হবে না। স্রেফ নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে এগোবে।

এজলাসই এখন শ্রীনির চূড়ান্ত বাইশ গজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন