এশিয়াডে বাংলার মুখ

রাখি এখন ডোপিং-জুজু দেখছেন জলের বোতলেও

ভারোত্তোলনে বাংলা শুধু নয়, ভারতীয় মেয়ে দলের এক মাত্র মুখ রাখি হালদার ডোপিং নিয়ে এতটাই শঙ্কিত যে, কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। শুধু প্রতিদিনের খাবারেই নয়, জল-দুধের মুখ বন্ধ বোতল বা প্যাকেটেও বিশ্বাস নেই তাঁর। ‘‘সঞ্জিতা চানু ডোপে ধরা পড়েছেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য ভারোত্তোলক ডোপিংয়ের জন্য শাস্তির কবলে। তাই এশিয়াডে নামার আগে আমি ওটা নিয়ে প্রচণ্ড সতর্ক। কোনও কলঙ্ক যেন গায়ে না লাগে,’’ বলছিলেন ছাব্বিশ বছরের রাখি। 

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৮ ০৪:১৩
Share:

নজরে: এশিয়াড ভারোত্তোলনে ভারতের ভরসা রাখি। ফাইল চিত্র

জলের বোতল কিনলে সেটা চেপে ধরে দেখছেন কোথাও ফুটো আছে কি না। খাবার জন্য দুধের প্যাকেট এনেও পরীক্ষা করছেন কোনও ছিদ্র দিয়ে দুধ পড়ছে কি না। জিনিসপত্র এনে নিজে রান্না করে খাচ্ছেন।

Advertisement

ভারোত্তোলনে বাংলা শুধু নয়, ভারতীয় মেয়ে দলের এক মাত্র মুখ রাখি হালদার ডোপিং নিয়ে এতটাই শঙ্কিত যে, কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। শুধু প্রতিদিনের খাবারেই নয়, জল-দুধের মুখ বন্ধ বোতল বা প্যাকেটেও বিশ্বাস নেই তাঁর। ‘‘সঞ্জিতা চানু ডোপে ধরা পড়েছেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য ভারোত্তোলক ডোপিংয়ের জন্য শাস্তির কবলে। তাই এশিয়াডে নামার আগে আমি ওটা নিয়ে প্রচণ্ড সতর্ক। কোনও কলঙ্ক যেন গায়ে না লাগে,’’ বলছিলেন ছাব্বিশ বছরের রাখি।

এশিয়াডের পদকের জন্য লড়াই না, পরীক্ষায় বসে স্নাতক হওয়া? কোনটা অগ্রাধিকার হিসাবে নেবেন সেটা ভাবতে রাখি সময় নিয়েছিলেন কয়েক মিনিট। শেষ পর্যন্ত নদিয়ার হাজিপুরের মেয়ে ভারোত্তোলক বেছে নিয়েছেন, এশিয়াডকেই। পাতিয়ালার শিবির থেকে ফোনে রাখি বলছিলেন, ‘‘স্নাতক হওয়ার সুযোগ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু পনেরো জনের সঙ্গে লড়াই করে এশিয়াডে নামার যে দুর্লভ সুযোগ অর্জন করেছি তা হয়তো আর কোনও দিন পাব না। সে জন্যই জাতীয় শিবিরে গিয়ে যখন শুনলাম পরীক্ষার জন্য ছুটি পাওয়া যাবে না, তখন ঠিক করলাম পরীক্ষা দেব না।’’

Advertisement

মেয়েদের ভারোত্তোলনে এ বার ভারত থেকে দু’জন ছাড়পত্র পেয়েছিলেন জাকার্তা যাওয়ার। তার মধ্যে একজন মীরাবাই চানু কমনওয়েলথ গেমসের সোনা জেতার সুবাদে সরাসরি সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পিঠের ব্যথার জন্য নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন চানু। তিনি নামতে না পারায় রাখিই এখন ভারতের একমাত্র আশার প্রদীপ। সেটা যেন তাঁকে আরও বেশি জেদি করে তুলেছে। বলছিলেন, ‘‘বাড়ি থেকে নয় কিলোমিটার হেঁটে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে রোদ-ঝড় বৃষ্টিতে অনুশীলনে যেতাম রানাঘাট হার্ভে ক্লাবে। কোনওদিন ফাঁকি দিইনি। সবাই বলত, ঝড় বৃষ্টিতেও এ ভাবে যাচ্ছিস, কোন দিন গাছ মাথায় পড়ে মারা যাবি। আমি বলতাম, মরতে হয় মরব। জীবন তো একটাই। এখন বলছি, এশিয়াড পদকের জন্য জীবন দিতেও রাজি। এ রকম সুযোগ আর পাব না।’’ এশিয়াডের মঞ্চে রাখির সুযোগ পাওয়ার রাস্তাটা যেন সত্যিই জীবনকে বাজি রেখে পাওয়া। বিজয়ওয়াড়ার সি ভি আর অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করতে গিয়ে শুনেছিলেন, থাকা-খাওয়ার টাকা লাগবে। গরিব পরিবার। কোথা থেকে পাবেন টাকা? হার না মানা মনোভাবের বঙ্গ তনয়া রাস্তাও বের করে ফেলেন শেষ পর্যন্ত। ওখানকার একটি স্কুলের পাঁচশো ছাত্র-ছাত্রীর জন্য রান্না করে টাকা জোগাড় করে অনুশীলনের খরচ চালিয়েছেন এক সময়। সারা দিন রান্নার পাশাপাশি চলত হাড়ভাঙা অনুশীলন। সেই পরিশ্রমের ফল পান তিনি। হয়ে যান জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সিনিয়র ও জুনিয়র মিলিয়ে পর পর সাত বার।

গত বছর কর্নাটকে জাতীয় প্রতিযোগিতায় নেমে কর্ণম মালেশ্বরীর কুড়ি বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পরেই এশিয়াডের দরজা খুলে যায় রাখির সামনে। ৬৩ কেজি বিভাগে জাকার্তায় নামবেন তিনি। ‘‘আমরা মাত্র দু’জন মেয়ে সুযোগ পেয়েছিলাম। এখন শুনছি চানু নাকি যাবে না। যে ভাবেই হোক পদক আনতেই হবে দেশের জন্য। চানু এখন পাতিয়ালায় নেই। ও শুনলাম দিল্লিতে রয়েছে,’’ বলে দেন রাখি।

কিন্তু একমাত্র মেয়ে হিসেবে নেমে ভারোত্তোলনে নেমে রাখির পদক পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? রাখির মন্তব্য, ‘‘পদক পাব কি না সেটা কোচই জানেন। উনিই সব হিসাব রাখেন। আমি এখন স্ন্যাচে ৯৫ কেজি আর ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১২০ কেজি ওজন তুলছি। আশা করছি এর চেয়ে ভাল তুলতে পারব জাকার্তায় গিয়ে।’’

দিনে তিন দফায় মোট নয় ঘণ্টা অনুশীলন করছেন পাতিয়ালায় জাতীয় কোচ বিজয় শর্মার কাছে। ছোটবেলার কোচ নবীনকুমারকে নিয়মিত পাঠাচ্ছেন অনুশীলনের ভিডিয়ো। কোথায় ভুল হচ্ছে জেনে নিচ্ছেন ফোনে। এশিয়াডের পদকের জন্য বাংলার রাখি যেন ক্লান্তিহীন। তাঁর পাখির চোখ যে, বিজয় মঞ্চে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন