অলরাউন্ডার অশ্বিনের সঙ্গে ধূর্ত কুককে দেখল মোহালি

পয়েন্ট। কভার। এক্সট্রা কভার। মিড অফ। এবং চতুর্থ স্টাম্প লাইন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ দাখিলের আরও একটা দিনে ওই ফিল্ড প্লেসিং দিয়ে লেখা শুরু করার কারণ আছে।

Advertisement

চেতন নারুলা

মোহালি শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২৫
Share:

কোহালিকে ফিরিয়ে স্টোকসের ‘নীরব’ প্রতিশোধ।

পয়েন্ট। কভার। এক্সট্রা কভার। মিড অফ। এবং চতুর্থ স্টাম্প লাইন।

Advertisement

রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ দাখিলের আরও একটা দিনে ওই ফিল্ড প্লেসিং দিয়ে লেখা শুরু করার কারণ আছে। মোহালি টেস্টের দ্বিতীয় দিনের আকর্ষণীয় ঘটনাবলী পরপর লিখতে হলে অবশ্যই তাতে সর্বপ্রথম অশ্বিনের আরও একটা দামী হাফসেঞ্চুরির প্রসঙ্গ আসবে। বিরাট কোহালির টানা ফর্ম নিয়ে চতুর্দিকে এত আলোচনা চলছে। কিন্তু একদিক থেকে দেখলে, সমান প্রচারের তাজ অশ্বিনেরও প্রাপ্য। স্পিনের বিষ যে তাঁর দুর্বোধ্য, তা পাঁচ বছরের শিশুও জানে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে ব্যাটসম্যান অশ্বিনের যে বিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তার বিস্ময় আরও বেশি। গত এক বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচশো রান করে ফেললেন অশ্বিন! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দু’টো সেঞ্চুরি করেছেন। আর এই নিয়ে রবিবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চলতি সিরিজে তাঁর টানা তিন নম্বর হাফসেঞ্চুরি হল। সর্বাধিক আলোচনাটা এর পর অশ্বিন নিয়ে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আরও একটা ব্যাপার তো ভারতীয় অফস্পিনারের কীর্তির গায়ে-গায়ে চলে আসছে। ভুল হল। একজনের ছায়া সামনে চলে আসছে— অ্যাশলে জাইলস!

ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে প্রাক্তন ইংরেজ স্পিনারের আলাদা জায়গা আছে। মহান কীর্তি নয়, কলঙ্কের জন্য। আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে নাসের হুসেনের ইংল্যান্ড ভারতে এসে সচিন তেন্ডুলকরকে আটকাতে যে ন্যক্কারজনক স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল, তার রূপকার ছিলেন জাইলস। সচিনের বিরুদ্ধে লেগে ফিল্ডার-বেষ্টনী রেখে লেগস্টাম্পের বাইরে বল করে গিয়েছিলেন এই বাঁ হাতি স্পিনার। নেগেটিভ বোলিংয়ের সেই থিওরি ‘কুখ্যাত’ হয়ে যায় রাতারাতি। রবিবার জাইলস ছিলেন না মোহালিতে। লেগসাইডে ফিল্ডারের কর্ডন সাজিয়ে লেগস্টাম্পের বাইরেও এ দিন বল করেনি ইংল্যান্ড। কিন্তু তবু ‘নেগেটিভ বোলিং’ শব্দটা ফের ইংল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ে গেল।

Advertisement

জুড়ে দিলেন চেতেশ্বর পূজারা।

ভারতীয় ব্যাটিংয়ের তিন নম্বর সাধারণত বিতর্কিত কথা-টথা বলেন না। সে দিক থেকে রবিবারের মোহালি কিছুটা অ-পূজারাচিত। দিনের শেষে পূজারা এসে দুম করে বলে বসলেন যে, তাঁর আর বিরাটের পার্টনারশিপের সময় ইংল্যান্ড কিছুটা নেগেটিভ বোলিংয়ের স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল! চেষ্টা করেছিল তাঁদের রান তোলার গতিকে মন্থর করে দিতে।

ওকসের ক্যাচে ড্রেসিংরুমের পথে পূজারা।

নেগেটিভ বোলিং সরাসরি বলা না গেলেও ব্যাপারটা সত্যি। পূজারা-কোহালি জুটিতে ৭৫ রান উঠেছে। কিন্তু তা তুলতে বেশ সময় লেগেছে। চা বিরতির পর একটা সময় টানা পঁয়ত্রিশ মিনিট রান পাননি কোহালি। আসলে পূর্বসূরির মতো ন্যক্কারজনক স্ট্র্যাটেজি আমদানি না করেও একটা জিনিস মোহালিতে করলেন কুক। কার্যকারিতায় যা সমান। লেগসাইড নয়, কোহালি-পূজারাকে তিনি ছেড়ে দিলেন পুরো অফসাইড ঘিরে দিয়ে। স্লিপ-টিপ তুলে। পয়েন্ট। কভার। এক্সট্রা কভার। মিড অফ। এবং চতুর্থ স্টাম্প লাইন। প্ল্যানটা সোজা। আক্রমণ আমি করব না। কিন্তু তোমার ভুলের অপেক্ষায় থাকব। দেখি এ বার তুমি কী ভাবে রান পাও।

ক্রিস ওকস-বেন স্টোকস ওই সময়টা টানা চতুর্থ স্টাম্পের বাইরে করতে লাগলেন। লেগস্পিনার আদিল রশিদ এলেন, সবাইকে হতবাক করে তিনিও ফেলতে লাগলেন ওই চতুর্থ স্টাম্প লাইনে! মইন আলি, তিনিও বল ব্যাটসম্যানের শরীরের ভেতরে আনার চেষ্টায় গেলেন না। একটা সময় দেখা গেল, কোহালি একটার পর একটা ছেড়ে যাচ্ছেন। দুনিয়াকে দেখিয়ে দিচ্ছেন, টেস্ট ক্রিকেটে ‘আর্ট অব লিভিং’ বলে যে কথাটা আছে, তা তাঁর মজ্জাগত। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ও সব কূটনৈতিক ধূর্ততা তাঁর দেখা আছে। ইংল্যান্ড বুনো ওল হলে তিনি কোহালি, বাঘা তেঁতুল!

ভারত অধিনায়ক আরও একটা হাফসেঞ্চুরি করলেন। বেন স্টোকসের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধটাও দেখার মতো হল। নিজের ইনিংসের শুরুর দিকে স্টোকসকে পরপর দু’টো বাউন্ডারি মারলেন বিরাট। কিন্তু পরে স্টোকসই তুললেন তাঁকে। কোহালিকে আউট করার পর ইংরেজ অলরাউন্ডারকে দেখা গেল, নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে রয়েছেন! আর বেয়ারস্টো-অ্যান্ডারসন মিলে অবিকল সেই উল্লাসের ছবি তুলে আনছেন, যা সচরাচর কোহালি করে থাকেন! আসলে টেস্টের প্রথম দিনই লেগেছিল স্টোকস-কোহালির। আইসিসির ধাতানিও খেতে হয়েছে স্টোকসকে। কোহালি-বিদায়ের পর তাঁর এ হেন আচরণ নিয়ে জল্পনা চলল যে, আইসিসি সতর্ক করেছে বলে স্টোকস এ রকম নীরব নাটকীয়তা পেশ করলেন কি না।

জল্পনা এ দিন আরও একটা ব্যাপার নিয়ে চলেছে। অজিঙ্ক রাহানেকে নিয়ে। ভারতের মিডল অর্ডারের শ্রেষ্ঠ ভরসা আবার পারলেন না। পূজারা আউট হওয়ার পর রাহানের একটা ভাল ইনিংসের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল, ইংল্যান্ডের ভাল বোলিংয়ের সামনে প্রতিরক্ষার কোহালিকে সহায়তা দেওয়ার। কিন্তু রাহানে শূন্য রানে আউট হয়ে গেলেন। শেষ পাঁচ ইনিংসে মরাঠির যা রান, সমর্থকদের টেনশনে ফেলার মতো। ৬৩! যে পাঁচ ইনিংসে স্পিনের তিন প্রজাতিই তাঁকে আউট করেছেন। লেগস্পিনার, বাঁ হাতি স্পিনার এবং অফ স্পিনার। চা বিরতির পর রাহানে সমেত তিনটে উইকেট পরপর বেরিয়ে যায়। ১৪৮-২ থেকে ভারত দ্রুত ১৫৬-৫ হয়ে যায়। দু’শো পার করার পর ছ’নম্বর উইকেট পতন। বিরাট কোহালির।

অশ্বিনের ইনিংসের গুরুত্ব এতেই বোঝা যায়। প্রথমে কোহালির সঙ্গে ৪৮ রান জুড়লেন। পরে জাডেজার সঙ্গে তাঁর পার্টনারশিপে এখনও পর্যন্ত ৬৭। নিজে ৫৭ ব্যাটিং। আর সোমবার অশ্বিনদের রানের অঙ্কটা যত বাড়বে, তত সুবিধে। ইংল্যান্ডের সামনে লিডের ইমারত তত বাড়বে। কুকদের প্রথম ইনিংস স্কোর ছুঁতে চাই তো আর ১২ রান। মোহালি টেস্টে শেষ পর্যন্ত কী হবে না হবে, এখন থাক। ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে বরং বর্তমান নিয়ে কথা বলা ভাল।

মোহালি টেস্ট কিন্তু জমে গিয়েছে!

চোট পেলেন হার্দিক, হামিদ

স্টুয়ার্ট ব্রড, ঋদ্ধিমান সাহা, লোকেশ রাহুলের পর মোহালি টেস্টের চোট তালিকায় আরও দু’টো নাম যোগ হল রবিবার। ভারতের হার্দিক পাণ্ড্য এবং ইংল্যান্ডের হাসিব হামিদ। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে যন্ত্রণা হওয়ায় দ্বিতীয় দিন ফিল্ডিং করেননি হামিদ। তাঁর হাতে এক্স রে হবে। চোট গুরুতর হলে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি নামবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। শেষ দু’টো টেস্টের জন্য প্রয়োজনে নতুন ক্রিকেটারকেও ডাকতে হতে পারে ইংল্যান্ডকে। ভারত আবার এ দিন হার্দিককে ছেড়ে দিতে বাধ্যই হল। প্র্যাকটিসে কাঁধে চোট পাওয়ায়। বোর্ড সচিব অজয় শিরকে বলেছেন, ‘‘ডান কাঁধে চোট পেয়েছে হার্দিক। ওকে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তার পরে ওর রিহ্যাব প্রোগ্রাম ঠিক হবে। রাহুলের হাতে চোট। তবে চতুর্থ টেস্টের আগে রাহুল সুস্থ হয়ে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।’’

ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৬৮-৮): রশিদ ক পার্থিব বো শামি ৪, ব্যাটি এলবিডব্লিউ শামি ১, অ্যান্ডারসন ন.আ. ১৩, অতিরিক্ত ১২, মোট ২৮৩। পতন: ৩২, ৫১, ৫১, ৮৭, ১৪৪, ২১৩, ২৫৮, ২৬৬, ২৬৮। বোলিং: শামি ২১.৫-৫-৬৩-৩, উমেশ ১৬-৪-৫৮-২, জয়ন্ত ১৫-৫-৪৯-২, অশ্বিন ১৮-১-৪৩-১, জাডেজা ২৩-৪-৫৯-২।

ভারত প্রথম ইনিংস: বিজয় ক বেয়ারস্টো বো স্টোকস ১২, পার্থিব এলবিডব্লিউ রশিদ ৪২, পূজারা ক ওকস বো রশিদ ৫১, কোহালি ক বেয়ারস্টো বো স্টোকস ৬২, রাহানে এলবিডব্লিউ রশিদ ০, নায়ার রান আউট ৪, অশ্বিন ন.আ. ৫৭, জাডেজা ন.আ. ৩১, অতিরিক্ত ১২, মোট ২৭১-৬। পতন: ৩৯, ৭৩, ১৪৮, ১৫২, ১৫৬, ২০৪। বোলিং: অ্যান্ডারসন ১৬-৩-৩৬-০, ওকস ১৫-৫-৪৭-০, মইন ৯-১-১৯-০, রশিদ ২৪-৪-৮১-৩, স্টোকস ১৫-২-৪৮-২, ব্যাটি ৫-০-২৯-০।

ছবি: রয়টার্স

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন