ফুটবলারদের বিদ্রোহ মোহনবাগানে

মঙ্গলবার সকালে কোচ-ফুটবলারদের বিদ্রোহে উত্তাল হয়ে উঠল মোহনবাগান তাঁবু। দিপান্দা ডিকা থেকে শিল্টন পাল, হেনরি কিসেক্কা থেকে আজহারউদ্দিন মল্লিক— একযোগে জানিয়ে দিলেন, বকেয়া বেতন না পেলে আজ বুধবার থেকে তাঁরা আর অনুশীলনে নামবেন না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০৪:৫৪
Share:

ঝামেলা:  বেতন না পেলে আর মাঠে নামবেন না ডিকারা। ফাইল চিত্র

ঘরোয়া লিগে পালতোলা নৌকো চলছে তরতরিয়ে। গ্যালারিতে উপচে পড়া সদস্য-সমর্থক। দলের এক একটা জয় দেখে উঠছে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। সবুজ-মেরুণ আবির উড়ছে আকাশে। আট বছরের অধরা কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ জেতার লড়াইতে দারুণ ভাবে রয়েছে মোহনবাগান।

Advertisement

এই আবহে হঠাৎ-ই মঙ্গলবার সকালে কোচ-ফুটবলারদের বিদ্রোহে উত্তাল হয়ে উঠল মোহনবাগান তাঁবু। দিপান্দা ডিকা থেকে শিল্টন পাল, হেনরি কিসেক্কা থেকে আজহারউদ্দিন মল্লিক— একযোগে জানিয়ে দিলেন, বকেয়া বেতন না পেলে আজ বুধবার থেকে তাঁরা আর অনুশীলনে নামবেন না। কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী এবং ফুটবল বিভাগের এক কর্তার মাধ্যমে তা সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয় ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্রকে। পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যে, ফুটবলারদের চাপে বাধ্য হয়ে ক্লাবের ক্ষমতাসীন কর্তারা বুধবারের অনুশীলন স্থগিত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবর্তে আজ বিকেল তিনটেয় ডাকা হয় অনুশীলন। কোচ ও ফুটবলারদের ক্লাবের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘‘বুধবার বিকেলে সচিব এসে ফুটবলারদের সঙ্গে বকেয়া বেতন নিয়ে আলোচনা করবেন।’’ মঙ্গলবার রাতে অবশ্য মোহনবাগান সচিব বলে দেন, ‘‘আমি হয়তো আসতে পারব না। তবে অন্য কর্তারা কথা বলবেন, ফুটবলারদের সঙ্গে।’’ কিন্তু ফুটবলাররা তাদের বকেয়া বেতন কবে পাবেন? অঞ্জনবাবু জানান, ‘‘ক্লাবের আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ। আমাদের হাতে কোচ ও ফুটবলারদের এক মাসের বেতন দেওয়ার টাকা আছে। শনিবার আদালত নিযুক্ত কমিটির সভা আছে। ওই সভার পর জুলাইয়ের বেতন দিতে পারব। তার পরে কী হবে বলতে পারছি না।’’

ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার সকালে। গত কয়েকদিন ধরেই বেতন না পেয়ে উদ্বিগ্ন ফুটবলাররা দরবার করছিলেন কোচ ও ফুটবল বিভাগ দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক কর্তার কাছে। এ দিন জিম সেশন ছিল ডিকা, শিল্টন ডি’সিলভাদের। ঘণ্টা খানেকের নির্ধারিত অনুশীলন শেষে ক্লাব তাঁবুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন জোটবদ্ধ ফুটবলারেরা। তাঁবুর ভিতরেই দরজা বন্ধ করে সভা শুরু করেন ডিকা, কিংগসলে ওবুমেনেমেরা। এক সিনিয়র ফুটবলার সেখানে নাকি বলেন, ‘‘জুন মাসে চাপ দিয়ে বিনা পয়সায় খেলতে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের। সেই বেতন আমরা নিইনি। কিন্তু জুলাই মাসের বেতন দেওয়ার কথা ছিল ১৫ অগস্টের মধ্যে। আজও আমরা তা পাইনি। টাকা না পেলে মাঠে নামব না।’’ বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, আর এক ফুটবলার আরও উত্তেজিত হয়ে সেখানে বলেন, ‘‘আমরা খেলে যাচ্ছি। অনুশীলন করছি। অথচ আজ পর্যন্ত সচিব বা কোনও বড় কর্তা টাকা-পয়সা নিয়ে আলোচনাতেই বসেননি। ম্যাচের পর দেখা হলে ওঁরা বলছেন, দু’একদিনের মধ্যেই টাকা পেয়ে যাবে। তার পর সবাই উধাও হয়ে যাচ্ছেন। এ রকম চলতে পারে না। বেতন কবে দেওয়া হবে সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরই অনুশীলনে নামব।’’

Advertisement

ফুটবলারদের কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তাঁরা প্রকাশ্যে এই বিদ্রোহের কথা তাই সংবাদমাধ্যমকে বলতে চাইছেন না। তবে কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী স্বীকার করে নিয়েছেন এই সভার কথা। ফোনে বলে দিলেন, ‘‘ফুটবলার শুধু নয়, আমরা কোচিং স্টাফও তো বেতন পাচ্ছি না। আজ সকালে সবাই মিলে নিজেদের উদ্বেগের কথা ক্লাব সচিবকে জানিয়েছি। উনি বলেছেন কথা বলবেন। দেখা যাক কী হয়।’’

অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও শঙ্করলাল এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি। কারণ, কয়েক বছর আগে এ রকম পরিস্থিতিতে ফুটবলারদের বেতনের কথা বলতে গিয়ে কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হতে হয়েছিল সুব্রত ভট্টাচার্যকে। বুদ্ধিমান শঙ্করলাল সেই রাস্তায় তাই হাঁটতে নারাজ।

কিন্তু মোহনবাগানের যা অবস্থা তাতে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ডিকা, শিল্টন, শঙ্করলালদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। চাপ দিয়ে জুলাই মাসের বেতন আদায় করলেও, অগস্ট মাস থেকে তাদের তা পাওয়ার সম্ভবনা নেই। কারণ, মোহনবাগানে কোনও স্পনসর নেই। মরসুম শুরুর মুখে সচিব অনুগামী এক কর্তা তাঁবুতে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘‘দশ কোটি টাকার স্পনসর পেয়ে গিয়েছি আমরা। ক্লাবের কোনও আর্থিক সমস্যা নেই।’’ তাঁকে অবশ্য এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সচিব অঞ্জনবাবু অসুস্থ। নিয়মিত ক্লাবে আসতে পারেন না। ফুটবল সচিব জাকার্তা চলে গিয়েছেন এশিয়াড দেখতে। বাকি যাঁরা কর্মসমিতির সদস্য আছেন, তাদের টাকা দেওয়ার বা আনার ক্ষমতা নেই। জানা গিয়েছে, ফুটবলারদের জুলাই মাসের মাইনে দিতে লাগবে সত্তর লাখ টাকা। ক্লাবের অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৬৫ লাখ। পাঁচ লাখ টাকা আছে অন্য ব্যাঙ্কে। ডিকাদের বেতন দিয়ে দিলে অনুশীলন চালানোর টাকাও আর থাকবে না।

সামনে নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট টুটু বসু এবং সচিব অঞ্জন মিত্র গোষ্ঠীর কর্তাদের মধ্যে কাজিয়া তুঙ্গে। দু’পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে নানা বিষয় নিয়ে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেরাল চেষ্টা করছেন। ক্লাব সচিব এ দিন বলে দিয়েছেন, ‘‘আদালত নিযুক্ত কমিটি অনুমতি না দেওয়াতেই বেতনের টাকা তুলতে পারিনি। নানাভাবে সমস্যা তৈরি করছে অনেকে।’’ এ কথা অবশ্য মানতে চাননি কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও কমিটির সদস্য অসীম কুমার রায়। তিনি বলে দেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ রয়েছে বড় কোনও টাকা খরচ করতে হলে কমিটিকে জানাতে হবে। আমাদের না জানিয়ে ৪১ লাখ টাকা তোলা হচ্ছিল। খবর পেয়ে সেটা বন্ধ করা হয়েছে। ফুটবলারদের বেতন বন্ধ হোক আমরা চাই না। কেন টাকা তোলা হচ্ছে তা জানালেই আমরা অনুমতি দিয়ে দেব।’’ সব মিলিয়ে ১২৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। চূড়ান্ত অচলাবস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন