লিলের রাস্তায় মশাল জ্বালিয়ে চলছে তাণ্ডব।
কপালে ঘাম মোছারও সময় পাচ্ছেন না ব্রুনো ত্রানি! আসলে বুঝে উঠতেই পারছেন না কি ভাবে বোঝাবেন ব্যাপারটা।
মিলিয়ে-মিশিয়ে যা বললেন, তার মোদ্দা বক্তব্য, এরা কি গুন্ডা তৈরির কারখানা থেকে বেরিয়েছে? নাকি ফুটবল-গুন্ডাদের আকাশে রুশ সূর্যোদয়?
যার জেরে ইউরোর ভরা বাজারে ব্রুনো ত্রানির মতো ফরাসি পুলিশ-কর্তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদীদের রক্তচক্ষুও আপাতত দু’নম্বরে! বদলে ‘গব্বর’ সিংহের মতোই তাঁদের হৃদস্পন্দন বাড়াচ্ছে ‘মিউজিক হল’, হ্যাপি গাইজ’ বা ‘এলিয়েনস’ শব্দগুলি। রাশিয়া থেকে আসা দাঙ্গাবাজদের এই নামগুলো শুনলেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দাঙ্গা রুখতে পথে নেমে পড়তে হচ্ছে ফরাসি পুলিশকে।
মার্সেইয়ে গত সপ্তাহে যাদের দাপট দেখেছিলেন ‘রায়ট পুলিশ’-এর কর্তা ব্রুনো ত্রানি। ‘‘রুশ ফুটবল সমর্থকরা ঝামেলা পাকাতে পারে বলে আগে থেকেই খবর ছিল। আমরা তৈরিও ছিলাম। কিন্তু যে ভাবে পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে এলাকা ঘিরে তাণ্ডব চালিয়ে পলকেই ওরা পালাল, তা দেখার পর এটা এখন পরিষ্কার যে, এই ধরনের হাঙ্গামার জন্য ওরা পুরোদস্তুর প্রশিক্ষিত!’’
মার্সেইয়ের আর এক রায়ট পুলিশ অফিসার দমেনেক মেসকুইডা-র অভিজ্ঞতাও চমকে দেওয়ার মতো। ‘‘কারও খালি গা। কারও গায়ে আবার কালো জামা। পেটানো চেহারার ওই রুশ সমর্থকরা দলবদ্ধ সব সময়েই। প্রত্যেকের হাতে ঘুসোঘুসি করার জন্য লোহার ‘নাকলডাস্টার’। আর সকলেই মিক্সড মার্শাল আর্টসে রীতিমতো পটু। আর ওরা জানে ঠিক কী জন্য ওদের পাঠানো হয়েছে।’’
গোটা দুনিয়ার ফুটবল মাঠে আতঙ্ক ছড়াতে এর আগে আর্জেন্তিনার ‘বারা ব্রাভোস’, ব্রিটিশ, ডাচ বা জার্মান ‘হুলিগান’রা ছিল রাজার আসনে। কিন্তু গুন্ডামির সেই রাজ সিংহাসন পুতিনের দেশের ‘আল্ট্রা’-র আগমনে প্রায় যায় যায় অবস্থা!
গত ইউরোতে রাশিয়া-পোল্যান্ড ম্যাচের পর এই রুশ ফুটবল গুন্ডাদের সম্পর্কে জেনেছিল দুনিয়া। আর চার বছরের মধ্যেই তাদের এতটাই বাড়বাড়ন্ত যে এ বারের ইউরোয় একদা দাপুটে ইংরেজ গুন্ডাদের পিটিয়ে রুশদের চিমটি, ‘‘ইংরেজগুলো একদম মহিলাদের মতো!’’
আর তার পরেই বেরিয়ে এসেছে ইংল্যান্ডের মিডিয়ার অন্তর্তদন্ত। ইংরেজদের দাবি অনুযায়ী, রাশিয়ার প্রকৃত সম্পদ আল্ট্রারা। যেমন জেনিথ সেন্ট পিটার্সবার্গের ‘মিউজিক হল’ বা স্পার্টাক মস্কোর ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ ও ‘এলিয়েনস’। বিপক্ষকে বেধড়ক মারধর করার জন্য এদের যেমন সুনাম, তেমনই ইউএসপি চোখের পলকে এলাকা ছেড়ে পালানোর জন্য।
ইংরেজদের দাবি অবশ্য এখানেই থেমে নেই। রীতিমতো ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে তারা জানিয়েছে, এই ফুটবল গুন্ডাদের কয়েক প্রস্ত মারামারির
‘অডিশন’-এর পর রীতিমতো ঝাড়াইবাছাই করে পাঠানো হয়েছে ইউরোতে! প্রমাণ হিসেবে সেই মারপিটের প্রস্তুতি পর্বের ফুটেজও প্রকাশ করেছে ‘দ্য ডেইলি মেল’।
সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মারপিটের এই প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হলে পরের ধাপে আরও তুখোড় ‘স্ট্রিট ফাইটার’দের সঙ্গে লড়তে হয় তাদের। সেখানে নজর কাড়তে পারলে তবেই নাকি মেলে রাশিয়ান ফুটবল টিমের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত!
আরও চাঞ্চল্যকর ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘সান’। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা প্রথম ধাপেই হেরে যায়, তাদের আরও একবার বেধড়ক পিটিয়ে তার পর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জানা গিয়েছে, নয়া নাৎসিবাদে দীক্ষিত এই রুশ ফুটবল গুন্ডারা দেশে বিভিন্ন ফুটবল দলের সমর্থক হিসেবে গলা ফাটালেও ইউরোতে দেশের প্রয়োজনে পুরো একজোট হয়েই মারামারি করছে।
এ বারের ইউরোতে ফ্রান্সে খেলা দেখতে এসেছে প্রায় পনেরো হাজার রুশ সমর্থক। এদের মধ্যে হাজার খানেক এই রুশ আল্ট্রা। কবিতার দেশে ‘হুলিগানস হলিডে’ পালন করতে এসেছে নাকি! মজার তথ্য এটাই যে, গত ডিসেম্বরে ইউরোর কথা ভেবেই নাকি নতুন সনদ তৈরি হয় আল্ট্রাদের। যেখানে জোর দেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকটি বিষয়ে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—১) রাশিয়ার ম্যাচের সময় নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য ভুলে সবাইকে একজোট হয়ে থাকতে হবে ২) নিজের দেশের মধ্যে কোনও ভাবেই নয়, মারতে হবে বিরোধী সমর্থকদের ৩) মাটিতে যে পড়ে রয়েছে, তাকে মারবে না। মারবে তখনই, যখন সে উঠে দাঁড়িয়ে তোমাকে পাল্টা মারতে আসবে। ৪) ছুরি নিয়ে মাঠে নৈব নৈব চ। মার্সেইতে রুশ গুন্ডাদের মারপিটের যে ছবি ধরা পড়েছে, তাতেও এই সনদের প্রভাব যথেষ্ট।
এই সনদ জানাজানি হওয়ার পর থেকেই উঠে আসছে প্রশ্নটা—তা হলে কি সরকারি মদতেই বাডা়বাড়ি এই রুশ ফুটবল গুন্ডাদের? কারণ হিসেবে সামনে আসছে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য। ইউরো শুরুর আগে দাঙ্গাবাজ চিহ্নিত করে তিন হাজার দর্শককে আটকেছিল ইংরেজরা। জার্মানরাও আটকেছে আড়াই হাজারের একটা দলকে। কিন্তু সেখানে রাশিয়া ৩০ জনের একটা দলকে আটকেই এ কাজ সেরেছে নমো নমো করে। বৃহস্পতিবার তদন্তের পর রুশদের একটি ২০ জনের দলকে দেশে ফেরাচ্ছে ফরাসি বিদেশ মন্ত্রক। যার মধ্যে রয়েছেন রুশ সমর্থক অ্যাসোসিয়েশনের নেতা আলেকজান্ডার স্প্রিগিন। পাঁচ দিনের মধ্যে ফ্রান্স ছাড়তে বলা হয়েছে এদের।
তবে ইউরো যে কেবল আল্ট্রারাই দাপাচ্ছে, তা ঠিক নয়। বুধবারই লিলে-তে দাঙ্গা বাধানোর জন্য ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ফরাসি পুলিশ। যাদের মধ্যে ১৬ জন ইংরেজ। কিন্তু রাশিয়ান ফুটবল ‘আল্ট্রা’দের ভয়ে জুজু ইংরেজ ফুটবল গুন্ডারাও। এদেরই একজন জেসন মেরিনার। এক সময় ‘চেলসি হেডহান্টার’ নামক একটি ফুটবল-গুন্ডাবাহিনীর মাথা বলা হত তাঁকে। তাঁর কথায়, ‘‘ইংরেজ সমর্থকদের মহিলা বলছে রুশ আল্ট্রারা। আসলে ইংরেজরা নীতি মেনে চলে। তাই কাউকে মাটিতে ফেলে তার মাথায় বা বুকে লাথি মারে না। এই রুশরা বাড়াবাড়ি করছে কোনও নীতি না মেনেই।’’
ছবি: টুইটার।