সাহেব: নতুন স্বপ্ন।
জেলের অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে চাইছেন তিনি।
বারো বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কাটিয়ে এখন ‘শুদ্ধ’ হতে চাইছেন সবুজ ঘাসে নেমে! গারদের ভিতর প্রতিদিনের পুলিশি হুইসল শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া জীবনে শুনতে চাইছেন রেফারির বাঁশি।
চাইছেন খুনের মহাপাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে।
তিনি সাহেব পিয়াদা।
বাংলার ফুটবল বহু চমকপ্রদ ঘটনার সাক্ষ্মী। তাতে নতুন সংযোজন এ বার দক্ষিণ দূর্গাপুরের দাশ পাড়ার বাসিন্দা সাহেব পিয়াদার কাহিনী। যাঁকে এ বছর খেলতে দেখা যাবে কলকাতা লিগে।
লিগের প্রথম ডিভিশনের ক্লাব মিলনবীথিতে মঙ্গলবারই সই করতে চলেছেন নিজের স্ত্রীকে হত্যা করার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা খেটে আসা ত্রিশোর্ধ্ব এই আসামি।
কী করে সম্ভব হল এটা?
কঠিন লড়াইয়ের গল্পটা নিজেই বলছিলেন সাহেব। ‘‘জেলের দিনগুলো যতটা যন্ত্রণার ছিল, জীবন তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণার হয়ে উঠেছিল জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। ভাল ব্যবহার আর ভাল খেলার জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই রেহাই করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, পৃথিবীটাই পাল্টে গিয়েছে। কেউ কোনও কাজ দেয় না। খুব পরিচিতরাও পারলে এ়়ড়িয়ে চলে,’’ বলছিলেন জেল টিমের সফলতম স্ট্র্ইকার সাহেব। বলতে বলতে গলাও ধরে আসে তাঁর। ‘‘আমরা সাত ভাইবোন। বড় দাদা আলাদা হয়ে গিয়েছে। মেজদা অসুস্থ। মা-বাবা মুটে মজুরের কাজ করে এখনও। এক বোনের বিয়ে হয়নি। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার পাশে যদি মিহির স্যার (দাস) না দাঁড়াতেন, কিছু সম্ভব হত না।’’
এটা ঘটনা, পুরনো কলঙ্ক সহজে পিছু ছাড়ে না! মাস তিনেক আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন সাহেব। কিন্তু কোথাও কোনও কাজ না পেয়ে ক্রমে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন জেল টিমের হয়ে দশ গোল করা ছেলেটি। কিন্তু হাল ছাড়তে দেননি জেলের ফুটবল টিমের কোচ মিহিরবাবু।
এখন পাড়ায় পাড়ায় খেপ খেলে সাহেব সংসার চালাচ্ছেন কোনও মতে। মিলনবীথির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন মিহির। জেল টিমের কোচ বলছিলেন, ‘‘জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এদের জীবনটা খুবই কষ্টের হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে সেটা সম্ভব হয় না। তখন পেটের দায়ে অনেকেই আবার অন্যায় করে বসে। কারণ জেল খাটার পর এদের মনে ভয় বলে আর কিছু থাকে না। তবে সাহেব চেয়েছে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে। আর ফুটবলই ওকে সেই পথে ফিরতে সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয়।’’
অনেক সময় ক্ষণিকের তীব্র আবেগে বা ঝোঁকের বশে ভয়াবহ অপরাধ করে বসেন বহু মানুষ। নিজের গোটা জীবন দিয়েও সেই অপরাধের ক্ষমা মেলে না। কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে কেটে যায় জীবনের বাকিটা। কিন্তু সাহেবের গল্পটা একটু আলাদা।
খুনের মতো জঘন্য অপরাধে যাবজ্জীবন জেল হয়েছিল। তার পর কারাবাসের অসহ্য কষ্টের দিনগুলোতে খেলাই হয়ে উঠেছিল তাঁর একমাত্র অক্সিজেন। জেলের যে ফুটবল টিমটি জেলা লিগ খেলে, সেই টিমের অধিনায়ক হয়ে ওঠেন সাহেব। শুধু ফুটবলই নয়, দারুণ কবাডিও খেলেন। জেলের টিমে দাপটের সঙ্গে কাবাডি খেলেছেন। তবে ফুটবলই সাহেবের প্রথম পছন্দ। বলছিলেন, ‘‘তখন জেলে বসে মনে হত, যে অন্ধকারে পা দিয়েছি, সেখান থেকে মুক্তি নেই। বড় অসহায় ছিল সেই দিনগুলো। ফুটবলই তো আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।’’
একটি ম্যাচে জেলের ফুটবল টিম খেলতে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল মাঠে। সেখানে সাহেবের খেলা দেখেন রঞ্জন ভট্টাচার্য। সাহেবকে পছন্দও হয় তাঁর। এই রঞ্জনই এখন মিলনবীথির কোচ। সাহেবকে সই করাতে আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি রঞ্জন। তিনি এ দিন বলছিলেন, ‘‘ফুটবলই তো পারে সব কালো দিক মুছে ফেলতে। ফুটবলের হাত ধরে একটা ছেলে যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, এর থেকে ভাল প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!’’
বারো বছর জেল খাটা আসামিকে কলকাতা লিগ যদি অপরাধের অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে সেটা কিন্তু সমাজিক ক্ষেত্রেও হবে বড় ঘটনা!