সেই অভিমানী ধোনি রক্ষা করলেন বাংলাওয়াশ থেকে

মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কেউ যদি বুধবার রাতে গত সাত দিনের মীরপুর-সংকলন নোটবুকে তুলে রাখতে বলত, ভারত অধিনায়ক কী কী লিখতেন?বোধহয় লিখতে পারতেন টিমের কাছে যা যা চেয়েছি, এত দিনে পেলাম। প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে নিত্য শুনতে হত, ক্যাপ্টেন তোমার টিম পার্টনারশিপ বলতে কিছু বোঝে? আজ একটা নয়, টিম দু’টো দিয়েছে। লোয়ার অর্ডারও রান দিয়েছে।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

মীরপুর শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

মীরপুরে ধোনির পাল্টা। ছবি: এএফপি।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কেউ যদি বুধবার রাতে গত সাত দিনের মীরপুর-সংকলন নোটবুকে তুলে রাখতে বলত, ভারত অধিনায়ক কী কী লিখতেন?

Advertisement

বোধহয় লিখতে পারতেন টিমের কাছে যা যা চেয়েছি, এত দিনে পেলাম। প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে নিত্য শুনতে হত, ক্যাপ্টেন তোমার টিম পার্টনারশিপ বলতে কিছু বোঝে? আজ একটা নয়, টিম দু’টো দিয়েছে। লোয়ার অর্ডারও রান দিয়েছে। ফিনিশারের ভূমিকা ছেড়ে ব্যাটিং-অর্ডারের সিঁড়ি ভাঙতে হয়েছিল রানের প্রত্যাশায়, প্রায় রুগ্নশিল্পে পরিণত হওয়া ব্যাটিংকে বাঁচানোর আশাবাদে। বুধবারের মীরপুর দু’টোই দিল। মিডিয়ার আক্রমণে অভিমানে বলে ফেলেছিলাম, অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিন। মনে হয়, আজকের মীরপুরের পর জাতীয় মিডিয়া আপাতত কয়েক দিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে। এখনই আর হিংস্র মূর্তি ধরবে না।

বুধবারের শের-ই-বাংলা থেকে মনে রাখার মতো গোটা কয়েক বিষয় পেয়ে গেলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সিরিজ অবশ্যই রক্ষা হয়নি, তার প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু মানসম্মান সম্পূর্ণ পদ্মায় ভেসে যেতে পারত, এটাতেও হেরে গেলে। শেষ ম্যাচ জিতে টিমের প্রচুর লাভ হয়েছে এমনও নয়। কিন্তু নিজেদের উপর বিশ্বাসটা ফিরেছে। যা ওয়ান ডে র‌্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে থাকা টিমের কাছে নিত্য দুরমুশ হতে হতে প্রায় উধাও হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সান্ত্বনার জয় সেটা ফিরিয়েছে। ফিরিয়েছে সুরেশ রায়নাদের মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি, গত কয়েক দিনে যা সম্রাট বাবরের আমলে শেষ ঘটেছে বলে মনে হচ্ছিল। সম্ভবত ক্রিকেটজীবনের কঠিনতম সময়ে বুধবারের মীরপুরকে মনে রাখবেন এমএসডি। মীরপুরও মনে রাখবে ভারত অধিনায়ককে। পাকিস্তান যা পারেনি, ভারত অধিনায়ক তা করে গেলেন।

Advertisement

অভিমানী ধোনির ব্যাটেই রক্ষা পেল ‘বাংলাওয়াশ’!

এমএসডির বোলিংয়ের যা দশা, তাতে এত দিন ধরে তাঁকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করে যাওয়াটা এক এক সময় অতীব অন্যায় মনে হবে। বিশেষ করে, পেস বোলিং। এটাই যদি ভারতীয় পেসের আসল চরিত্র হয়, তা হলে তো এত দিন ধরে দেশকে এত ট্রফি দেওয়ার জন্য অধিনায়ককে অবিলম্বে ‘নাইটহুড’ দেওয়া উচিত! তিনশো প্লাস যে টিম তুলবে তার বোলিংয়ের লক্ষ্য থাকবে বিপক্ষকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দেওয়া। অথচ উমেশ যাদব-স্টুয়ার্ট বিনিরা প্রথম দিকে যা বোলিং শুরু করলেন তাতে আট ওভারের মধ্যে চার জন বোলার নামিয়ে দিতে হল ধোনিকে! উমেশ যাদবের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। প্রথম ম্যাচে এতটাই ‘মহার্ঘ্য’বোলিং করেছিলেন যে, দ্বিতীয় ম্যাচে তাঁকে আর নামানোর সাহস পাননি এমএসডি। এ দিন নামালেন, আর প্রথম বল থেকে বোঝা গেল কেন তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম ওভারে চোদ্দো, শেষ পর্যন্ত চার ওভারে তেত্রিশ। ভাবা যায়, দেড়শোর মধ্যে পাঁচটা বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশ সাতচল্লিশ ওভার পর্যন্ত ম্যাচটাকে নিয়ে গেল!

বাংলাদেশ সাংবাদিকদেরও দোষারোপ করা বোধহয় যায় না। দুপুরে তাঁদের কেউ কেউ আক্ষেপ করছিলেন যে, তেন্ডুলকর-গাঙ্গুলির ভারতের থেকে এ জিনিস ভাবা যেত না। যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ধোনির বর্তমান টিম একটা মুস্তাফিজুর রহমানের কাছে দিনের পর দিন করে চলেছে। মুস্তাফিজুর ততক্ষণে রোহিতকে আবার গিলে নিয়েছেন, সিরিজে তৃতীয় বারের মতো। আবার মারণ কাটার বেরোচ্ছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে লিখে ফেলা হচ্ছে, এর চেয়ে বাংলাদেশ ‘এ’-কে নামালে তুল্যমূল্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা বেশি হত!

অভিভূত হয়ে পড়ার মতো কথাবার্তা। যে টিম এই সে দিন বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলেছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাদের দু’টো হারে এত মর্যাদাহানি? বিদ্রুপের এত বিষ-শলাকা? কিন্তু চতুর্দিকের এমন নিরন্তর বিদ্রুপ সম্ভবত এমএসডির কানেও ঢুকেছিল। এবং ক্রমবর্ধমান অপমানের প্রত্যুত্তর দেওয়ার ইচ্ছেতেই হোক বা আত্মসম্মান বাঁচানোর তাগিদ, ভারতীয় ব্যাটিংকে এ দিন শেষ পর্যন্ত আসল ভারতীয় ব্যাটিংয়ে উত্তরণ ঘটাতে দেখা গেল।

শিখর ধবন: ৭৩ বলে ৭৫।

এমএস ধোনি: ৭৭ বলে ৬৯।

সুরেশ রায়না: ২১ বলে ৩৮।

তিনশোর উপকণ্ঠে টিমকে পৌঁছনোর প্রভাবে দ্বিতীয় জনের ইনিংসের অবদান অনেক বেশি। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল টিম হারার পর থেকেই আওয়াজটা উঠছিল যে, তিনি নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে তুলে আনছেন না কেন? যেখানে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এখনও তাঁর মতো ভরসার নাম টিমে খুব কমই আছে। এমএসডি শুনলেন, বাংলাদেশ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে। দ্বিতীয়টায় পারেননি, কিন্তু সম্মান বাঁচানোর ম্যাচটা জিতিয়ে চলে গেলেন।

আক্রমণে নয়, সংযমে।

মুস্তাফিজুর রহমানকেই জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সিরিজে প্রত্যেক বার দেখা গিয়েছে যে, দ্বিতীয় স্পেল এলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন মুস্তাফিজুর। শেষ দু’টো ম্যাচে এমন হয়নি যেখানে দ্বিতীয় স্পেল করতে এসে উইকেটহীন থেকে গিয়েছেন বঙ্গ এক্সপ্রেস। এ দিন থাকলেন। বলা ভাল, তাঁকে উইকেটহীন রেখে দিলেন স্বয়ং ভারত অধিনায়ক। এমন নয় যে কাটারের বিষ দিয়ে তাঁকে বিব্রত করতে চেষ্টা করেননি মুস্তাফিজুর। করেছেন। ভাল রকম করেছেন। স্টুয়ার্ট বিনির একটা সময় এমন হাল করেছেন যে মনে হচ্ছিল মাঠের চেয়ে ড্রেসিংরুম অনেক বেশি নিশ্চিন্তের আশ্রয় হতে পারে বিনির। যে ক’টা রান কুড়িয়েটুড়িয়ে মুস্তাফিজুরের ওভার থেকে বার করেছেন বিনি, তার অধিকাংশে উইলোর মধ্যভাগের চেয়ে কাণার অবদান বেশি থেকেছে। ধোনিকে দেখা গেল, মুস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে সিঙ্গলসে চলে গেলেন। হেলিকপ্টার নয়, দানবীয় ছক্কায় উনিশের প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয়, স্রেফ সিঙ্গলস। সেটা এলে ভাল। না হলে স্রেফ ছেড়ে দাও। আসতে দাও বাকিদের।

পরিবর্তনের যে এমএসডিকে সামলাতে পারল না বাংলাদেশ। ‘বাংলাওয়াশের’ স্বপ্ন বাংলার মাঠেই থেকে গেল। আর কোথাও গিয়ে মনে হবে, এমএসডির মীরপুর-নোটবুকে এটাই সম্ভবত সেরা প্রাপ্তি হয়ে থাকল। সিরিজ হার তিনি আটকাতে পারেননি। কিন্তু এটা পেরেছেন।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বুধবার পুনর্জন্ম ঘটিয়ে দেশকে বুঝিয়ে গেলেন, তাঁর ক্রিকেটের আজও মৃত্যু ঘটেনি। অন্তত দেশের সম্মান বাঁচানোর প্রশ্ন এলে আজও তাঁর ব্যাটের সিংহগর্জন অল্পস্বল্প শোনা যায়!

মীরপুরের স্কোর

ভারত

রোহিত ক লিটন বো মুস্তাফিজুর ২৯

শিখর ক নাসির বো মাশরফি ৭৫

কোহলি বো সাকিব ২৫

ধোনি ক মুস্তাফিজুর বো মাশরফি ৬৯

রায়ডু ক লিটন বো মাশরফি ৪৪

রায়না বো মুস্তাফিজুর ৩৮

বিনি ন.আ. ১৭

অক্ষর ন.আ. ১০

অতিরিক্ত ১০

মোট (৫০ ওভারে) ৩১৭-৬।

পতন: ৩৯, ১১৪, ১৫৮, ২৫১, ২৬৮, ৩০১।

বোলিং: মুস্তাফিজুর ১০-০-৫৭-২, মাশরফি ১০-০-৭৬-৩, আরাফত ৬-০-৪২-০,

রুবেল ৯-০-৭৫-০, নাসির ৬-০-২৭-০, সাকিব ৯-১-৩৩-১।

বাংলাদেশ

তামিম এলবিডব্লিউ ধবল ৫

সৌম্য ক অশ্বিন বো ধবল ৪০

লিটন বো অক্ষর ৩৪

মুশফিকুর ক ধোনি বো রায়না ২৪

সাকিব ক ধবল বো রায়না ২০

সাব্বির বো বিনি ৪৩

নাসির ক রায়ডু বো অশ্বিন ৩২

মাশরফি বো অশ্বিন ০

আরাফত ন.আ. ১৪

রুবেল ক অক্ষর বো রায়না ২

মুস্তাফিজুর এলবিডব্লিউ রায়ডু ৯

অতিরিক্ত ১৭

মোট (৪৭ ওভারে) ২৪০ অলআউট।

পতন: ৮, ৬২, ১১২, ১১৮, ১৪৮, ১৯৭, ২০৫, ২১৬, ২২২।

বোলিং: বিনি ৬-০-৪১-১, ধবল ৮-০-৩৪-২, উমেশ ৪-০-৩৩-০,

অশ্বিন ১০-১-৩৫-২, অক্ষর ৯-১-৪৪-১, রায়না ৮-০-৪৫-৩, রায়ডু ২-১-৫-১।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন