উলমার্স টার্ফে পিচ নিয়ে দিনভর নাটক

ঘূর্ণির ইতিহাস পাল্টানোর ইঙ্গিত ঐতিহাসিক টেস্টে

সিভিল লাইনস মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গেলে যে মেটে লাল রংয়ের বাড়িটা পড়বে, তা আপাতদৃষ্টিতে এতটুকু আকর্ষণীয় মনে হবে না। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কানপুর শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:১১
Share:

টিমের সেরা অস্ত্রের সঙ্গে কোচ। মঙ্গলবার গ্রিনপার্কে অশ্বিন-কুম্বলে।

সিভিল লাইনস মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গেলে যে মেটে লাল রংয়ের বাড়িটা পড়বে, তা আপাতদৃষ্টিতে এতটুকু আকর্ষণীয় মনে হবে না। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। প্রায় একশো বছর বয়স। জায়গায়-জায়গায় নুন-ছাল উঠে গিয়েছে। ঝোপঝাড় চতুর্দিকে।

Advertisement

হাসপাতাল ওটা। ওটা, প্রয়াত ‘ল্যাপটপ কোচ’ বব উলমারের জন্মস্থল! নাম ম্যাকরবার্ট হসপিটাল।

সাধারণ বিচারে প্রয়াত বব, তাঁর জন্মস্থল প্রভৃতি আলোচ্য বিষয়বস্তু হওয়াই উচিত নয়। প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? ভারত-নিউজিল্যান্ড সিরিজের ঢাকে কাঠি, আর ঠিক আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশের মাঠে তেরো টেস্টের মহাসফরে নেমে পড়বে বিরাট কোহালির ভারত। তার মধ্যে এ সব আসে কোথা থেকে? আসে, হাসপাতাল-ফুটপাথের ওপারটাই নিয়ে আসে। স্টেডিয়ামের পোশাকি নামটা কানপুরবাসীর যে কেউ বলে দেবে গ্রিন পার্ক। কিন্তু তার আবার একটা ডাকনামও আছে।

Advertisement

উলমার্স টার্ফ। যার পিচ নিয়ে নাটক মঙ্গলবার দিনভর চলল।

দুপুর বারোটা নাগাদ নিউজিল্যান্ড কোচ মাইক হেসন যে কথাটা খুলে-আম সাংবাদিক সম্মেলনে বলে গেলেন, একটু চমকে দেওয়ার মতো। সকালের দিকে তাঁকে দেখা গিয়েছিল, পিচের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। বেশ কিছুক্ষণ কানপুর কিউরেটর শিব কুমারের সঙ্গে কথাবার্তাও বলতে দেখা গিয়েছে প্রেসবক্স থেকে। ব্যাপারটা কী? তা, নিউজিল্যান্ড কোচ সোজাসুজি বলে দিলেন যে, কিউরেটরের কাছে তিনি গোটা কয়েক টিপস চাইতে গিয়েছিলেন!

এবং মিডিয়া যতই চাপাচাপি করুক না কেন, ওই প্রসঙ্গে তিনি নাকি টুঁ শব্দও করবেন না। গোলগাল নিউজিল্যান্ড কোচ মিটিমিটি হেসে ‘না’ বলতে পারেন। কিন্তু কিউরেটরের তো সে সব বিধিনিষেধ নেই। শিব কুমারকে ধরা হলে তিনি অক্লেশে বলে দিলেন, “টিপস নয়। সাধারণ কথাবার্তা বলছিলাম। ওদের বলে দিয়েছি টার্ন নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা না করতে। উইকেটে টার্ন মারাত্মক কিছু থাকবে না।”

শেষ কবে এটা হয়েছে? শেষ কবে ভারত সফরে এসে বিদেশি টিম কিউরেটরকে বলতে শুনেছে যে, নিশ্চিন্ত থাকো। যতটা ভাবছ, অতটা টার্ন হবে না? মারণ-ঘূর্ণির বধ্যভূমিতে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে না তোমাদের?

সাম্প্রতিকে অন্তত শোনেনি নিশ্চিত। নিশ্চিত জয়ের লোভে ওঁত পেতে থাকা দেশজ সমর্থকের যদি এতে মেজাজ বিগড়োয়, কিছু করারও নেই। ভারতীয় কোচ কুম্বলে এবং তাঁর সেরা স্পিন-অস্ত্র রবিচন্দ্রন অশ্বিন— মাঠে ঢুকে পিচ তাঁরাও দেখতে গেলেন। সবুজ কভারের আচ্ছাদন তুলে-টুলে দেখলেনও। রোহিত শর্মা এলেন একটু পর, পিচ কভার উঠল আবার। নিশ্চিন্ত হলে বারবার উইকেট-চর্চা চলে না নিশ্চয়ই। পরে ভারতীয় কোচকে কানপুর উইকেট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে একটু শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে কুম্বলে বললেন যে, তিনি জানতেন প্রশ্নটা আসবে। “ভারতে খেলা, পিচ নিয়েই তো প্রথম প্রশ্নটা হবে। শেষ প্রশ্নটাও পিচ নিয়ে হবে। আমার মনে হয় পিচ নিয়ে নয়, কথাবার্তা হওয়া উচিত পিচের উপর যে খেলাটা হয়, সেটা নিয়ে। উইকেট নিয়ে বলতে পারি, গুড উইকেট। টিপিক্যাল কানপুর উইকেট।”

টিপিক্যাল কানপুর উইকেট!

কী যে তার সংজ্ঞা, কী যে তার চরিত্র, তা সঠিক নির্ণয় করা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরেরও দুঃসাধ্য। আজ থেকে আটান্ন বছর আগে এ মাঠে সুভাষ গুপ্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এক ইনিংসে ন’উইকেট তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার তার বছর পনেরো বাদে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের উপর যিনি অপমানের বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ম্যালকম মার্শাল। এ মাঠেই তো ক্যারিবিয়ান ‘মৃত্যুদূতে’র সুনীল মনোহর গাওস্করের হাত থেকে ব্যাট ছিটকে দেওয়া! আবার কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যাক। ২০০৮ কানপুর, ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট তিন দিনে শেষ, শাসকের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত।

শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে চলা ভারত-নিউজিল্যান্ড। যেখানে গতি এবং টার্ন দু’টো থাকারই সম্ভাবনা নাকি কম। “প্রথম দু’টো দিন কিছু হবে না। দশ ওভার মতো পেস থাকবে উইকেটে। তার পর স্লো হয়ে যেতে পারে। যা ঘুরবে, দু’দিনের পরে,” বলে যান কানপুর কিউরেটর। চোরা আক্ষেপও বেরিয়ে পড়ে যখন বলেন, “আরও সমস্যা করে দিল এর মধ্যেকার বৃষ্টি। কী করব আর?”

শোনা গেল, কারণ নাকি দু’টো। একটা প্রকৃতিগত। একটা নিয়মের রক্তচক্ষু। কানপুর-কিউরেটর শুধু নন, বোর্ডের এক নামী কিউরেটরও বললেন যে, সেপ্টেম্বরের উইকেট থেকে মারাত্মক ঘূর্ণি পাওয়া সম্ভব নয়। ডিসেম্বর হলেও হত। তার উপর মরসুমের শুরু। ম্যাচ-ট্যাচ খেলা হলে যে উইকেটের স্বাভাবিক ‘ওয়্যার অ্যান্ড টিয়ার’ হত, সেটা পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আর দ্বিতীয়ত, আইসিসি। দেশের মাটিতে গত দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজে র‌্যাঙ্ক টার্নার বানিয়ে যে ভাবে কলঙ্কিত হয়েছে মোহালি আর নাগপুর, তার পর বলে বলে ও সব পিচ দেওয়া আর নাকি সম্ভব নয়। তা ছাড়া কানপুর উইকেট এর আগে ‘ওয়ার্নিং’ খেয়েছিল। ফের কেচ্ছা হলে সামলাবে কে?

পাকেচক্রে যা দাঁড়াচ্ছে, নিষ্ঠুর ঘূর্ণির ফ্রাইং প্যানে ফেলে সাহেব-টিমকে ভাজা-ভাজা করার কাহিনি হয়তো এ বার নেই। হয়তো এ বার একটু অন্য রকম, তিন বা চারের বদলে পাঁচ দিন পর্যন্ত টেস্ট টেনে নিয়ে যাওয়ার গল্প। দেশের মাটিতে রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের একপেশে শাসনের দৃশ্য পাল্টে এ বার হয়তো কিছুটা প্রতিরোধ, কেন উইলিয়ামসন-রস টেলরদের উইলোর কিছুটা প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। কানপুর কিউরেটরের কথায় ভরসা করে এটুকু ভবিষ্যদ্বাণীতে দোষ কী?

ঐতিহাসিক টেস্টটা যদি একটু জমে, জমুক না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন