যুযুধান: ডার্বিতে দ্বৈরথ সনি ও ওয়েডসনের। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
জোড়া ইলিশ নিয়ে স্টেডিয়ামের লাউঞ্জে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলার সময় ট্রেভর জেমস মর্গ্যান হাসি মুখ করে প্রশ্ন করছিলেন, ‘‘দিস ইজ হিলসা ফিশ? গুড ফিশ?’’
ঠিক তখনই কয়েক ফুট দূরে মোহনবাগান ড্রেসিংরুম থেকে ভিডিও ক্লিপিংস পাঠানো হচ্ছিল লাল-হলুদ কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে। ম্যাচ কমিশনার রবিশঙ্করের কাছে। ডার্বির আগে শনিবার সকালের শেষ প্রস্তুতিতে নির্ধারিত সময়ের বত্রিশ মিনিট আগে দলবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন মর্গ্যান। তা নিয়েই অভিযোগ। অভিযোগ সত্যি প্রমাণ হলে, কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হবে ইস্টবেঙ্গলের। সেটা নিয়ে সবুজ-মেরুন শিবির এমন উচ্ছ্বসিত যে, মনে হচ্ছিল ডার্বির ফলটা তাদের দিকেই গিয়েছে।
সঞ্জয় সেন স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে ইস্টবেঙ্গল কোচকে ঘুরিয়ে কটাক্ষ করলেন, ‘‘ক্লোজ্ড ডোর অনুশীলনে কী রহস্য ভেদ হয় জানি না। সবাই করছে বলে করেছিলাম গত ডার্বিতে। এ বার করিনি। যে করে করুক, আমার মাথাব্যথা নেই।’’ তখনই ওয়েডসন আনসেলমে-দের টিম বাসের চারপাশে ঘিরে জ্বলছে ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক মশাল। তীব্র রোদের তাপে তা যেন আরও গনগনে।
সনি নর্দের পিছনে ছুঁটছেন কয়েকশো মোহনবাগান সমর্থক। ভীমরুলের চাকের মতো দেখাচ্ছে দৃশ্যটা। আর্জি, ‘‘সনি দা, শিলিগুড়ির মাঠে আপনার গোল দেখতে চাই।’’ তার ঘণ্টা দু’য়েক পরে ওয়েডসন আর মেহতাব হোসেন-দের ঘিরে একই আর্তি। পাল্টা শিবিরের সমর্থকদের।
শিলিগুড়ির আই লিগের তিন নম্বর ডার্বিতে স্টেডিয়াম ভর্তি হবে কি না সেটা রবিবার সন্ধের আগে বলা কঠিন। টিকিটের চাহিদা বাড়লেও তা আগের মতো আকাশ ছোঁয়া হয়নি এখনও।
সেবক রোডের শুরু যেখানে, সেখানেই মোহনবাগানের টিম হোটেল। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে একই রাস্তায় ইস্টবেঙ্গলের ঘাঁটি। মর্গ্যানের হোটেলে একা কুম্ভের মতো সব চাপ যেন কোচের উপর। জরিমানা হবে জেনেও কেন আগে মাঠে নামলেন, প্রশ্ন করায় ক্ষেপে গেলেন। কেন ক্লোজ্ড ডোর অনুশীলন আপনার পছন্দ? বিরক্তি প্রকাশ করে মর্গ্যানের জবাব, ‘‘ওটা ম্যাচের বিষয় নয়। আমার নিজস্ব বিষয়। অন্য প্রশ্ন করুন। ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করুন।’’ কোচের আশেপাশে দু’চারজন লাল-হলুদ কর্মী ছাড়া তখন কেউ নেই। উল্টো আবহ মোহনবাগান শিবিরে। ক্লাবের শীর্ষ কর্তারা অনেকেই হাজির।
আরও পড়ুন: এ বার না জিতলে আর খেলব না
এটা একেবারে বহিরঙ্গের আবহ। আসলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের অন্দর মহলে কিন্তু চলছে ধুন্ধুমার প্রস্তুতি আর নানা অঙ্ক। মরণ-বাঁচন ম্যাচ। ঘাড়ের ওপর উঠে পড়েছে পাহাড়ের দল আইজল এফ সি। ম্যাচ জিতলেই খেতাবের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া যাবে। এই অবস্থায় দুই কোচের অনুশীলনেই ‘প্ল্যান বি’ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা। রক্ষণ অপরিবর্তিত রেখে সঞ্জয় অন্তত তিনবার বদল ঘটালেন মাঝমাঠে। কখনও মাঝমাঠে কাতসুমিকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে রাইট উইংয়ে অনূর্ধ্ব ২২ কোটার আজহারউদ্দিনকে খেলালেন। কখনও কাতসুমিকে রাইট উইং করে দিয়ে আজহারকে জুড়ে দেওয়া হল ড্যারেল ডাফির সঙ্গে। কখনও বিক্রমজিৎ সিংহ আর শৌভিক চক্রবর্তী ডিফেন্সিভ স্ক্রিন, কখনও বিক্রমজিৎ-শেহনাজ। কোনটা দিয়ে শুরু করবেন সঞ্জয়? ‘‘এখনও হাতে চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে। দেখি,’’ বললেন মোহনবাগান কোচ। আর লাল-হলুদের অনুশীলনে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল সামনে কখনও উইলিস প্লাজার সঙ্গে ক্রিস পেইন, কখনও রবিন সিংহ। মাঝমাঠে বা রাইট ব্যাকে বারবার টিম বদলালেন মর্গ্যান। সন্ধ্যার সাংবাদিক সম্মেলনে লাল-হলুদ কোচকে প্রশ্ন করা হল, ওয়েডসন কী শুরু থেকেই? ‘‘আঠারো জনের দলে থাকবে।’’
দুই কোচই নিজের তুরুপের তাস লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। সেটা হতেই পারে। কিন্ত খেতাবি যুদ্ধে থাকতে গেলে ইস্টবেঙ্গলকে জিততেই হবে। ড্র করলেও সমস্যায় পড়বে তারা। মোহনবাগানের চাপ একটু কম। কারণ সনি-দেবজিৎরা একটি ম্যাচ কম খেলেছেন। ডার্বি হয়ে গেলে ইস্টবেঙ্গলের বাকি থাকবে তিনটি ম্যাচ। আর মোহনবাগানের থাকছে চারটি ম্যাচ। ড্র হলেও ক্ষতি নেই, এই অঙ্কে বিপক্ষের উপর চাপ বাড়াতে রক্ষণের সামনে জোড়া ব্লকার খেলানোর চিন্তা ঘুরছে মোহনবাগান কোচের মাথায়।
কিন্তু ডার্বির ইতিহাস বলছে, এই ম্যাচটায় এত চাপ থাকে দু’দলের ওপর যে, অনেক বড় কোচও আসল দিনে ধোঁকা খেয়ে যান। অনেক তারকা ফুটবলারকে দেখায় ফ্যাকাশে। সেজন্যই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয় স্নায়ু যুদ্ধে কে জিতল তার ওপর। রিজার্ভ বেঞ্চে কোচেদের হাতে থাকা রিমোটের সঠিক প্রয়োগও গড়ে দেয় ম্যাচের ফল।