‘পরের লক্ষ্য অলিম্পিক্স’, নিজের ডায়েরিতে লিখলেন স্বপ্না

সাইয়ের হস্টেলে শুয়ে পিঠের ব্যথায় যখন ছটফট করতেন স্বপ্না বর্মণ, তখন তিনি নিজেকে শান্ত রাখতেন নিয়মিত ডায়েরি লিখে।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৫২
Share:

সোনার মেয়ে: ঘরে ফিরলেন এশিয়াডে স্বর্ণপদকজয়ী স্বপ্না বর্মণ।

সাইয়ের হস্টেলে শুয়ে পিঠের ব্যথায় যখন ছটফট করতেন স্বপ্না বর্মণ, তখন তিনি নিজেকে শান্ত রাখতেন নিয়মিত ডায়েরি লিখে। কাঁদতে কাঁদতে লিখতেন পাতার পর পাতা।

Advertisement

এশিয়াড থেকে কলকাতায় ফেরার পরে শুক্রবার দুপুরে অসুস্থতার মধ্যেও সেই ডায়েরিতেই তিনি লিখে ফেলেছেন, ‘‘আমার পরের লক্ষ্য দু’বছর পরের টোকিয়ো অলিম্পিক্স।’’ দিল্লিতে সকালে বিমানে ওঠার আগে দু’বার বমি করেছিলেন স্বপ্না। বিকেলে সাইতে সংবর্ধনার পরও বমি করতে করতে হস্টেলের সেই ঘরেই ফিরলেন, যেখানে রাতে শুয়ে গত সাত বছর নিজের জীবনের উত্থান-পতন, রাগ-অভিমানের ডায়েরি লিখতেন রাজবংশী পরিবারের সোনার মেয়ে। এ দিন একান্তে কথা বলার সময় বলে ফেললেন তাঁর গোপন ডায়েরির কথা। ‘‘স্যর আমাকে প্রতিদিন একটা নতুন লক্ষ্য ঠিক করে দিতেন। কখনও তিনি বলতেন, হেপ্টাথলনের সাত ইভেন্ট মিলিয়ে ৫৬০০ করতে হবে। কখনও হাইজাম্পে এতটা লাফাতে হবে। কখনও জ্যাভলিনে কতটা ছুঁড়তে হবে। সেটাই লিখে রাখতাম।’’ বলতে বলতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দু’পায়ের বারো আঙ্গুল নিয়ে ইতিহাস তৈরি করা
বিস্ময় প্রতিভার।

জাকার্তায় তাঁর জ্যাভলিন থ্রো-র জেদি চেহারার ছবি নকল করে দক্ষিণ কলকাতায় একটি বড় পুজোর দুর্গা প্রতিমা তৈরি হচ্ছে এ বার। স্বপ্নার জীবন নিয়ে ছবি করার জন্য তাঁর কোচ সুভাষ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছেন টালিউডের এক নামী পরিচালক। সে সব কেউ স্বপ্নাকে এখনও বলেননি। শহরে পা দেওয়ার পরে তো বিমানবন্দর থেকে সাই, সব জায়গাতেই তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। ক্রীড়ামন্ত্রী, বিভিন্ন কর্তা, সতীর্থরা তাঁকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়।

Advertisement

এশিয়াডে গেলে পদক নিয়ে ফিরবই, যে ডায়েরিতে লিখেছিলেন তারই কিছু পাতায় তিনি একদিন লিখেছিলেন, ‘‘আমি আর পারছি না। বাড়ি ফিরে যাব। কোমরের এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। আর মনে হয় আমার এশিয়াডের পদক জেতা হল না।’’ ২০১৬ সালের এক দুপুরে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে লেখার সেই স্মৃতি বলতে বলতে তাঁর চোখের কোণে গড়িয়ে পড়ে জল। মা তাঁর পদকের জন্য প্রার্থনা করবেন বলে জলপাইগুড়ির ঘোষপাড়ার নিজের বাড়িতে ছোট্ট একটা কালীমন্দির তৈরি করে দিয়েছেন অফিস ভাতার পয়সা বাঁচিয়ে। ঠিক করেছেন, সামনের সপ্তাহেই সেখানে ফিরে পুজো করবেন। আর গাইবেন ভাটিয়ালি ও বাউল গান। ‘‘কত দিন যে গান গাই না। আমার গলাটা কিন্তু খারাপ নয়। এক বছর তো বাড়িই যাইনি। বাড়ির, পাড়ার সবার মুখগুলো খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। পদক জেতার আগের দিন দাঁতের ব্যথার জন্য রাতে ঘুমোতে পারিনি। পদক জেতার পরের রাতেও ঘুমাইনি। শুধু পুরনো দিনের কথা ভেবেছি। আমরা তো খুব গরিব। আমার দাদা-দিদিরা কিছু করতে পারেনি। আমি একটা চাকরি যদি পাই সেই আশায় আমাকে অ্যাথলেটিক্সের মাঠে পাঠিয়েছিলেন মা-বাবা। এত দূর যে যাব, এশিয়াডের পদক পাব ভাবিইনি,’’ বলতে বলতে ফিরে যান সাত বছর আগের গ্রামের জীবনে। যেখান থেকে তাঁকে তুলে এনেছিলেন সাই কোচ সুভাষ। ‘‘আমি ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপ করতাম বলে সুভাষ স্যর রাগ করতেন। বকা দিতেন। বলতেন, ‘এতে তোমার ফোকাস নষ্ট হবে’। রাগ করে কত বার ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি চলে যেতে চেয়েছি। স্যার আমাকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে না আনলে পদকটা হত না। উনিই আমার সব। শিক্ষক দিবসে আমার গুরুদক্ষিণা দিয়েছি। পদকটাই তো ওনার,’’ বলার সময় তাঁর চোখে সারল্য ফুটে বেরোয়।

দিল্লি থেকে কলকাতায় আসার পরে স্বপ্না বর্মণ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

সাইয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে বসানো হয়েছিল এশিয়াডে যোগ দেওয়া তিন জিমন্যাস্ট ও এক হ্যান্ডবলারকে। ছিলেন এশিয়াডে হেপ্টাথলনে দু’বারের রুপো জয়ী সোমা বিশ্বাস। পর্দায় জাকার্তায় স্বপ্নার বিভিন্ন ইভেন্টের ছবি দেখানো হচ্ছিল। দেখানো হল পদক জেতার মুহূর্তও। সেগুলো দেখতে দেখতে কখনও দু’হাতে মুখ ঢাকছিলেন বাংলার নতুন তারকা। কখনও তাঁকে দেখা গেল হাততালি দিচ্ছেন দর্শকদের মতোই। ‘‘এগুলো আমি করেছি! নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না ছবিগুলো দেখে। জানেন তো, প্রথম দিনের ইভেন্টের পর রাতে দাঁতের ব্যথার জন্য শুধু জল খেয়ে কাটিয়েছি। তরল খাদ্যও খেতে কষ্ট হচ্ছিল,’’ বলছিলেন স্বপ্না। সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘জাকার্তার প্লেনে ওঠার সময়ও ভাবিনি পদক জিতব। ভেবে রেখেছিলাম ডায়েরিতে লিখেছি, ছয় হাজার পয়েন্ট পেতেই হবে। সেটা করব। সুস্থ থাকলে ৬১০০ করে ফেলতাম। ’’

আরও পড়ুন: রাজ্য সরকারের কাছে কলকাতাতেই থাকার জায়গা চাইলেন স্বপ্না

স্বপ্নার সোনা হয়ে ওঠার পিছনে যিনি আসল কারিগর, সেই কোচ সুভাষ বলছিলেন, ‘‘স্বপ্নার চোটের কথা শুনে তাঁকে কলকাতায় ফেরত পাঠানোর কথা বলেছিলেন ফেডারেশনের কর্তারা। ইঞ্জেকশন নিয়েও স্বপ্না তখন বলত, ‘আমি পারব স্যার, আমাকে পারতেই হবে।’ ওঁর জেদই ওর সম্পদ।’’

দ্রোণাচার্যের কথা শুনে সোনার মেয়ের হাসিতে ঝরে পড়ে রোদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন