দল নির্বাচন সম্প্রচারিত হবে না কেন

সব চেয়ে বড় উদাহরণ ২০০১-এর ইডেনে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ। যেখানে ফলো-অন করার পরেও ভি ভি এস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়ের সারা দিন ধরে ব্যাটিং করে যাওয়ার দৌলতে আমরা অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট জিতি

Advertisement

অশোক মলহোত্র

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:২৬
Share:

নির্বাচকদের ভূমিকাটা এমনিতেই গোলকিপারের মতো ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। অনেক নতুন নতুন ক্রিকেটার আবিষ্কার করলেও তাঁদের ভাগ্যে কখনওই কৃতিত্ব জোটে না। কিন্তু দল খারাপ করলেই তাঁরা সহজ ‘টার্গেট’।

Advertisement

সব চেয়ে বড় উদাহরণ ২০০১-এর ইডেনে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ। যেখানে ফলো-অন করার পরেও ভি ভি এস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়ের সারা দিন ধরে ব্যাটিং করে যাওয়ার দৌলতে আমরা অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট জিতি। ওই ম্যাচেই প্রথম ইনিংসে যখন অল্প রানে আউট হয়ে গেল ভারত, আমরা নির্বাচকেরা ক্লাব হাউসে ভি আই পি বক্সে বসে ছিলাম। অনেক দর্শকই সেই সময়ে আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে প্রতিবাদী মন্তব্য করতে শুরু করেছিলেন। এমনও মন্তব্য উড়ে আসে যে, এ কী ব্যাটিং লাইন-আপ বেছেছেন আপনারা? অথচ, সেটাই ছিল আমাদের সেরা ব্যাটিং বিভাগ।

ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট খেলায় পুরো প্রতিক্রিয়াটাই ফলাফল নির্ভর। খেলোয়াড়রা তা-ও জিতলে কৃতিত্ব পান, নির্বাচকদের রাস্তায় শুধুই কাঁটা। যেমন, বীরেন্দ্র সহবাগকে খুঁজে বার করার জন্য কেউ কখনও সেই সময়কার নির্বাচক কমিটির সদস্যদের কৃতিত্ব দেয় না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বা বিরাট কোহালিকে প্রথম আবিষ্কার করা নির্বাচকদের কথা কেউ বলে না। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আগরতলায় একটা দলীপ ট্রফির ম্যাচে সহবাগ উত্তরাঞ্চলের হয়ে এক দিনের মধ্যে ২৮০ করেছিল। পূর্বাঞ্চলের নির্বাচক হিসেবে আমি সেই ম্যাচ দেখছিলাম। নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান তখন চাঁদু বোর্ডে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জানাই সহবাগের কথা। চেয়ারম্যান নিজে এর পর বীরুকে দেখতে ছুটে এলেন। কিন্তু ভাগ্য এমন খারাপ যে, সেই ম্যাচে দুই ইনিংসেই বাউন্স করিয়ে সহবাগকে আউট করে দিল জাহির খান। সেটা দেখে চাঁদু খুব প্রসন্ন হলেন না। তবুও ধৈর্য হারাননি তিনি। সে দিনই সহবাগকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেননি। সহবাগ আমাদের কাউকে নিরাশ করেনি।

Advertisement

বর্তমান নির্বাচক কমিটিকে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে দেখে আমার পুরনো অভিজ্ঞতাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত কখনওই সকলকে খুশি করবে না। অনেক কঠোর সিদ্ধান্তই অনেক সময় তাঁদের নিতে হয়। আমি নির্বাচক থাকার সময়েই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতের অধিনায়ক বেছে নেওয়া হয়। শুধু নির্বাচক কমিটি কেন, নানা মহলের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও আমাদের ইচ্ছাকে খুব সমর্থন করেছিলেন, বলা যাবে না। কিন্তু পরবর্তী কালে আমাদের পছন্দই তো সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। আসলে নির্বাচকদের কিছুটা মোটা চামড়াও রাখতে হয়। চতুর্দিক থেকে কী দাবি উঠছে, সে সবকে গুরুত্ব দিয়ে তো আর দল গঠন করা সম্ভব নয়।

তবে আমি একটা ব্যাপার মানি। দল গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠলে নির্বাচকদের অবশ্যই তার উত্তর দেওয়া উচিত, কারণ আমাদের ক্রিকেট ভক্তদের অধিকার আছে সেটা জানার। যেমন করুণ নায়ারকে বাদ দেওয়া নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটা অবশ্যই বর্তমান নির্বাচকদের প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করা উচিত যে, কেন একটিও ম্যাচ না খেলা সত্ত্বেও ওকে বাদ দেওয়া হল? আমি তো বলব, এই টুইটার, ফেসবুক যুগে যাওয়া যুগে নির্বাচক কমিটির বৈঠক লাইভ সম্প্রচার করা উচিত। লোকসভা যদি লাইভ দেখানো যায়, তা হলে কেন নয় নির্বাচক কমিটির বৈঠক?

সেটা করা হলে অনেক বিষয় নিয়েই ধোঁয়াশাই কেটে যায়। আমাদের সময় মনে আছে এক নির্বাচক বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর অঞ্চলের সাংবাদিকদের সামনে দাবি করতেন, তিনি তাঁর অঞ্চলের ক্রিকেটারদের জন্য খুব লড়াই করেছেন। কিন্তু অন্যরা ঝামেলা করে সেই ক্রিকেটারদের নাকি দলে রাখতে দেননি। আমরা জানতাম, উনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন। ভিডিয়ো রেকর্ডিং থাকলে এ সব মিথ্যাচার কেউ করতে পারবেন না।

সাম্প্রতিক আর একটা বিতর্ক নিয়ে বলতে চাই। বাদ পড়া ক্রিকেটারদের সবাইকে গিয়ে নির্বাচকদের ব্যাখ্যা দিতে হবে কেন? এটা কোন কালে ঘটেছে? অনেক বড় বড় ক্রিকেটার বা অধিনায়ককে তো সরানো হয়েছে। তাঁদেরও কি বলা হয়েছিল? বিজয় মার্চেন্ট কি টাইগার পটৌডিকে বলেছিলেন, কেন তাঁকে সরিয়ে অজিত ওয়াড়েকরকে ক্যাপ্টেন করা হল? জিমি অমরনাথকে অন্যায় ভাবে কত বার বসানো হয়েছে। তাঁকে পর্যন্ত ডেকে কখনও বোঝানো হয়নি। জিমি নির্বাচকদের ‘বাঞ্চ অফ জোকার্স’ পর্যন্ত বলে বসলেন।

আমার সময়কার একটা কথা মনে পড়ছে। নয়ন মোঙ্গিয়াকে বাদ দিলাম আমরা। তা নিয়ে ওর নাকি ক্ষোভ। টিম ম্যানেজমেন্টকে বার বার গিয়ে বলছিল, কেন বাদ পড়েছি আমি! তার পর টিম ম্যানেজমেন্ট থেকেই আমাকে সামনে পেয়ে বলা হল, মোঙ্গিয়া জানতে চায় কেন ও বাদ? আমি পরিষ্কার বললাম, ওকে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। খেলতে না পারলে তো বাদই যাবে। শেষ সিরিজের স্কোরবোর্ড কি দেখতে পাচ্ছে না?

আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, তরুণ কোনও ক্রিকেটারকে বসালে অবশ্যই তাকে বোঝানো উচিত কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এবং, ভবিষ্যতে তার জন্য কেমন সুযোগ থাকছে। যেমন কুলদীপ যাদবকে লর্ডস টেস্টে খেলানোর পরে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল। অবশ্যই কুলদীপের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত যে, কেন তাড়াহুড়ো করে খেলানোই বা হল, আবার রাতারাতি দেশের বিমানে কেন তুলে দেওয়া হল। করুণ নায়ারের পিঠে হাত রেখে অবশ্যই নির্বাচকদের বলা উচিত, কেন তাকে সুযোগ না দিয়ে ছেঁটে ফেলা হল। কিন্তু শিখর ধবন বা মুরলী বিজয়কে কেন বোঝাতে যাব যে, তোমরা কেন বাদ?

অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তার পরেও কিছু করে উঠতে পারোনি। আবার বোঝানোর কী আছে? এ বার পৃথ্বী শ খেলবে। আমি তো বলব, হায়দরাবাদে মায়াঙ্ক অগ্রবালকেও খেলাও। আর কত রান করতে হবে ওকে জাতীয় দলে খেলার জন্য? কে এল রাহুলকে তো আর নতুন করে কিছু দেখার নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বরং মায়াঙ্ককে দেখে নেওয়া যেতে পারে। আর একটা কথা। নির্বাচকদের চেয়ারম্যান ভারী কোনও নাম হওয়াই ভাল। বাকি সদস্যরা চার-পাঁচটা টেস্ট খেলা হলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু প্রধান নির্বাচক প্রাক্তন কোনও নামী তারকা হলেই ভাল। না হলে সত্যিই তো, অধিনায়ক বা কোচের বিরুদ্ধে কথা বলার দরকার হলে কী করে সেটা পারবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন