দ্বৈরথ ভুলে বার্সেলোনার বন্ধু এখন মাদ্রিদও

কে বলবে, কাতালোনিয়ার দু’টি ব্যস্ত ট্যুরিস্ট স্পটে গাড়ি নিয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হানার কয়েক ঘণ্টা আগেই রিয়াল মাদ্রিদ হারিয়েছে লিও মেসির বার্সেলোনাকে। আর সেই ক্লাসিকোয় জেতার আনন্দে মাদ্রিদও পার্টি করেছে সারা রাত ধরে। যেমন করে থাকে।

Advertisement

কাঞ্চন সরকার

মাদ্রিদ শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০৪:৩৭
Share:

মৌনতা: জঙ্গি হানার শোকপালন। প্র্যাকটিসে মেসিদের নীরবতা। ছবি: টুইটার।

এল ক্লাসিকোর যুদ্ধের মেজাজটাই আর নেই স্পেনে। বরাবরের সেই দুই শহরের দ্বৈরথ মুছে গিয়েছে সন্ত্রাসবাদী হানায়। মাদ্রিদও এখন পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, আমরা বার্সেলোনা। আমরা এক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক দেশ, এক শহর, এক প্রাণ।

Advertisement

কে বলবে, কাতালোনিয়ার দু’টি ব্যস্ত ট্যুরিস্ট স্পটে গাড়ি নিয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হানার কয়েক ঘণ্টা আগেই রিয়াল মাদ্রিদ হারিয়েছে লিও মেসির বার্সেলোনাকে। আর সেই ক্লাসিকোয় জেতার আনন্দে মাদ্রিদও পার্টি করেছে সারা রাত ধরে। যেমন করে থাকে।

ক্লাসিকোর পরের বিকেলেই জঙ্গিহানার ঘটনাটি ঘটে এবং তার পর মাদ্রিদ থেকেও ক্লাসিকো জয়ের আনন্দ উধাও। আমি এখানে আছি প্রায় তেরো বছর হয়ে গিয়েছে। ফুটবলের দুই যমজ শহর হিসেবেই সকলে বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদকে দেখে। ফুটবল মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই শহর। বাংলা থেকে এসে আমরাও তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি। বার্সেলোনা যেমন লিও মেসির, মাদ্রিদ তেমনই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর। কে বড় তা নিয়ে তর্ক কোনও দিনই থামবে না।

Advertisement

আপাতত অবশ্য ফুটবল মাঠের রেষারেষির কোনও চিহ্ন কোথাও নেই। বার্সেলোনাতে যেমন নেই, তেমনই মাদ্রিদেও নেই। গত কাল ঘটনা ঘটার পর থেকে রেড অ্যালার্ট চলছে। টিভি-তে ননস্টপ বার্তা দিচ্ছে পুলিশ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পুলিশের প্রধান কর্তারা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের উদ্দেশে সতর্কবার্তা জারি করছেন। এই লেখাটা তৈরি করার সময়েই যেমন দেখলাম, পুলিশের উচ্চ কর্তা বলছেন, বার্সেলোনা এবং মাদ্রিদ দু’টি শহরেই ব্যস্ত এলাকাতে বড় গাড়ি নিয়ে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। জঙ্গি হানা ঘটেছিল বড় ভ্যান নিয়ে। তাই বড় গাড়ির ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। ভ্যান নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়নি। তবে জোরাল তল্লাশি চালিয়ে তবেই ছাড়া হচ্ছে।

কাতালোনিয়ার দু’টি জায়গায় গত কাল জঙ্গিহানার ঘটনা ঘটে। বার্সেলোনা এবং ক্যামব্রিলস। এর মধ্যে লাস রামব্লাস নামে যেখানে প্রথম জঙ্গিরা ভ্যান নিয়ে আক্রমণ চালায়, সেটি বার্সেলোনার ব্যস্ততম স্কোয়্যার। ট্যুরিস্টদের ভিড় এখানে খুব বেশি থাকে। এই জায়গাটার আরও একটা পরিচিতি আছে। লা লিগা থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ— যে কোনও খেতাব জিতলে এখানেই বিজয়োৎসব সারতে আসে বার্সেলোনা দল। জায়গাটায় রাস্তা খুব বড়। অনেকটা কলকাতার রেড রোডের মতো।

ট্রফি নিয়ে মেসি, ইনিয়েস্তারা এখানেই তাঁদের ভক্তদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে খুশি মনে পোজ দেন, সেলফি তোলেন। মাদ্রিদে রোনাল্ডোদের বিজয়োৎসব করার জায়গা যেমন ফুয়েন্তে দে সিবেলেস, তেমনই মেসিদের হচ্ছে লাস রামব্লাস। ফুটবলের শহরে উৎসবের মঞ্চই এখন হিংসার কবলে রক্তাক্ত।

এমন দুঃসময়ে ফুটবলের দ্বৈরথ ভুলে মাদ্রিদ যে বার্সেলোনার পাশে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে বিশেষ চমক নেই। মানবিকতার খাতিরেই সেরকমই তো হওয়া উচিত। যেমন জঙ্গি হানায় বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত ট্যুরিস্টদের ভাড়া না নিয়ে সারা রাত ধরে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন ট্যাক্সি ড্রাইভাররা। তার মধ্যে মাদ্রিদেরও অনেক ট্যাক্সিচালক রয়েছেন। বিমানবন্দরে পাসপোর্ট কন্ট্রোলিং বিভাগের কর্মীরা ধর্মঘট ডেকেছিলেন। এই ঘটনার পরে তাঁরাও ধর্মঘট তুলে নিয়ে কাজে নেমে পড়েছেন।

অন্যান্য দেশের মতো স্পেনের রাজনৈতিক নেতারা কেউ কারও দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন না। সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শোনা যায়নি বিরোধী পক্ষকে। সুরটাই হচ্ছে, হাতে হাত ধরে এসো এই কঠিন সময়ের প্রহর পেরোই আমরা। মেসিরা যেমন তাঁদের প্র্যাকটিস শুরুর আগে নীরবতা পালন করলেন, তেমনই করল রোনাল্ডোর রিয়াল মাদ্রিদ। সিনসিনাত্তি থেকে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন রাফায়েল নাদালও।

আর দুই শহরের বিভিন্ন স্কোয়্যারে জনতা দলবদ্ধভাবে উপস্থিত হয়ে নীরব ভাবে জঙ্গিহানার প্রতিবাদ করল। দেখিয়ে দিতে চাইল, সন্ত্রাসের ভয়ে বাড়ির দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে বসে থাকব না আমরা। স্পেন জুড়ে এখন মন্ত্র হচ্ছে, এটা আমাদের দেশ। নিজেদের স্বাধীনতা এবং অধিকার নিয়েই এখানে বাঁচব আমরা। কী বার্সেলোনা, কী মাদ্রিদ— ক্লাসিকো ভুলে সকলের আজ এই এক সুর।

(লেখক কলকাতা থেকে স্পেনে গিয়ে বসবাস করছেন এক দশকের উপর।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন