দিল্লির কফি শপে রেনেডি সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।
একটা সময়ে দেশের জার্সিতে দাপিয়ে খেলেছেন দীর্ঘ দিন। প্রায় এক যুগের ফুটবলার জীবন। তাই হয়তো আজও ভারতের ফুটবল নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস!
পাশাপাশি, দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও নিজের মধ্যেই চলতে থাকে রেনেডি সিংহের। তাঁর রাজ্য মণিপুর থেকে যুব বিশ্বকাপ দলে আট জন ফুটবলার খেলছে। তা নিয়ে যদিও গর্ব করতে রাজি নন রেনেডি। আসলে এই ফুটবলারদের ভবিষ্যতটাই আসল তাঁর কাছে। বিশ্বকাপের পর ওদের কী হবে?
তাই, অনেক কাজের মাঝেও ছুটে এসেছেন দিল্লিতে। দেখেছেন কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচও। হতাশ নন একটুও। শুধু ভাবতে চান ভবিষ্যৎ নিয়ে। ফুটবল প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের কাছে তাই বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীর এক কফি শপে বসে সেই উদ্বেগের কথাই বারে বারে শোনালেন রেনেডি।
আরও খবর
• ‘গোল করে ক্লাউড নাইনে পৌঁছে গিয়েছিলাম’
• কলম্বিয়া ম্যাচ দেখলেন?
রেনেডি: হ্যাঁ। ভাল লাগল ওদের লড়াই দেখে। যে ভাবে চোখে চোখ রেখে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গেল, সেটাই প্রাপ্তি এই ম্যাচ থেকে। এটা ধরে রাখতে পারাটা খুব জরুরি।
• তা হলে একটা সংশয় কোথাও কাজ করছে ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে?
রেনেডি: তা তো থাকবেই। কত ফুটবলার হারিয়ে গিয়েছে, মাথা ঠিক রাখতে না পেরে। বিশ্বকাপের এই উচ্ছ্বাস, এই উন্মাদনা শেষ হওয়ার পর! ওদের ভবিষ্যৎটাই তো আসল।
• কারা ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে?
রেনেডি: অবশ্যই সবটা ফেডারেশনের হাতে। এই পুরো ভারতীয় দলটাই তৈরি করেছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন আর মিনার্ভা অ্যাকাডেমি। এ বার ফেডারেশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিশ্বকাপের পরে এই দলকে কী ভাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করবে।
• এই দল তো আই লিগ খেলবে বলছে?
রেনেডি: ফেডারেশন একটা ভাবনাচিন্তা করছে। আমি এই কথাই বলছিলাম। পুরোটাই ফেডারেশনের হাতে। বিশ্বকাপের পর যদি দল না থাকে, তা হলে অনেকেই ছিটকে যেতে পারে। মাথা ঠিক রাখাটাও খুব জরুরি।
ভারত-কলম্বিয়া ম্যাচের একটি মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত।
• এর মধ্যে তো বিদেশের অফার, আইএসএল, আই লিগ ক্লাব ঢুকে পড়বে। সেটা ক্ষতিকর হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য?
রেনেডি: ক্ষতি হবে এটা বলতে পারব না। কারণ, এটাই তো ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার বয়স। তবে কে ডাকছে, কত টাকা অফার করছে, এগুলো এখনই ওদের মাথায় না ঢোকাই ভাল। ওদের বুঝতে হবে, ওরা যদি সাফল্য পায়, সব এমনিই আসবে ওদের কাছে। তাই ও সব নিয়ে না ভেবে, শুধু নিজেদের কাজ নিয়ে ভাবা উচিৎ।
• কোমল থাটালের কাছে শুনেছি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাক রয়েছে?
রেনেডি: আমিও শুনেছি। কতটা সত্যি জানি না। হাওয়ায় খবর উড়ছে। কিন্তু, ওটাই বলছিলাম। বিশ্বকাপে ভারতীয় দল যেমন খেলছে, তাতে এর পর অনেকের কাছেই বড় ক্লাবের ডাক আসবে। সেটা নিয়ে এখন না ভাবাই ভাল।
আরও খবর
• বিশ্বকাপে ৮ ফুটবলার, তবুও মণিপুরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেমসের
• এই দলে অনেক প্রতিভা। আপনার দেখা সেরা কে?
রেনেডি: কাল আমি বরিসের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। কী অনবদ্য ফুটবলটাই না খেলে গেল পুরো ম্যাচে (মাথা ফেটে যাওয়ায় অসুস্থ বোধ করছিল বরিস, শেষের দিকে তাঁকে তুলে নেন কোচ)। যত ক্ষণ মাঠে ছিল তত ক্ষণ সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
• বরিসের মধ্যে কার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন?
রেনেডি: কারও সঙ্গে তুলনা করব না। ও অসাধারণ ফুটবল খেলেছে। এটা ধরে রাখতে পারাটা কিন্তু কঠিন। সঠিক পরিচর্যা না হলে এই প্রতিভাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, যদি সব ঠিক থাকে আর বরিসও মাথা ঠিক রাখতে পারে, তা হলে ও ভারতে খেলা সব ডিফেন্ডারকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
• এই দলের তিন জন সেরাকে বাছতে হলে, কারা থাকবে সেই তালিকায়?
রেনেডি: এই টিম থেকে তিন জনকে বেছে নেওয়া কিন্তু কঠিন। তবুও এখনও পর্যন্ত সেরা বরিসই। তার পর ধীরাজ আর অমরজিৎ। অমরজিৎকে আলাদা করে চেনা যায় না। কারণ ও খুব উচ্চ পর্যায়ে যায় না, আবার খুব নিম্নমানেও পৌঁছয় না। কিন্তু, ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত ধারাবাহিকতা রয়েছে। যেটা ও মাঠে থাকলে বোঝা যায় না। কিন্তু যে দিন মাঠে থাকবে না, সে দিন ওর অভাব বোধ করবে দল। এটাই ওর বিশেষত্ব।
আরও খবর
• কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে কোন বাঙালি? সাক্ষাৎকারে অকপট মাতোস
• এই দলের কাছে কী প্রত্যাশা?
রেনেডি: কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ ফল যথেষ্ট ভাল। ওই পর্যায়ের একটা দলের সঙ্গে এ ভাবে খেলাটাই বড় বিষয়। ঘানা কিন্তু গত বারের চ্যাম্পিয়ন, সেটা ভুললে চলবে না। আর এক নম্বর দলও। তাদের সঙ্গে এই খেলাটা খেলতে পারলেই হবে। তাতে অনেকটা আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে।
• মাতোস সম্পর্কে আপনার কী মত?
রেনেডি: আমি আগের কোচকে খুব একটা চিনতাম না। দল তখন বেশির ভাগ সময়েই বিদেশ ট্যুরে থাকত। তেমন ভাবে দেখিওনি। কিন্তু, মাতোসকে বেশ ভাল কোচ বলেই মনে হয় আমার। ছ’মাস এই দলের সঙ্গে থেকে কিন্তু দলের মানসিকতাই বদলে দিয়েছেন।
• মণিপুরের ৮ ফুটবলার খেলছে এই ভারতীয় দলে। এখানে মণিপুরের কৃতিত্ব কোথায়?
রেনেডি: কোনও কৃতিত্বই নেই। সব কৃতিত্ব এআইএফএফ এবং মিনার্ভা অ্যাকাডেমির। ওখানে কিছুই নেই। একটা অ্যাকাডেমি নেই, মাঠ নেই। আমাদের সময়েও ছিল না। আমিও ছোটবেলায় টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে চলে গিয়েছিলাম। মণিপুরের থেকে অনেক এগিয়ে মিজোরাম। এই ভারতীয় দলে এক জন মাত্র মিজোরামের ফুটবলার রয়েছে। কিন্তু, ওরা আমাদের থেকে এগিয়ে।
• আপনি বা আপনার মতো প্রাক্তন ফুটবলাররা তো কিছু ভাবতে পারেন মণিপুরের ফুটবল নিয়ে?
রেনেডি: ভাবছি। কাজও অনেকটা এগিয়েছে। বর্ষায় মাঠে জল জমে থাকায় কাজ শুরু করতে পারিনি। এ বার করব।
• ঠিক কী পরিকল্পনা রয়েছে?
রেনেডি: আপনি জানেন, নাগাল্যান্ডে কী বিপুল ফুটবল প্রতিভা রয়েছে। আমি ওখানে একটা ফুটবল স্কুল শুরু করছি। সঙ্গে মণিপুরেও। মণিপুর সরকার এখন ফুটবলকে সমর্থন করছে। যদিও আমি নিজের মতোই কাজ করতে চাই, যাতে মণিপুর থেকেই ফুটবল শিখে এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে ফুটবলাররা।
• মণিপুরের ফুটবলারদের ক্ষেত্রে তাদের পারিবারিক অবস্থাও কি একটা বড় প্রতিবন্ধকতা?
রেনেডি: হ্যাঁ। একদমই তাই। এই দলের ফুটবলারদেরই দেখুন না। ভাল মতো থাকার জায়গা নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা বেশির ভাগেরই। আমাদের সময়েও তাই ছিল। আমি লাকি ছিলাম। আমাকে কোনও স্ট্রাগল করতে হয়নি। কিন্তু সবার তেমনটা হয় না। এই দলের ধীরাজের পরিবার যেমন স্বচ্ছ্বল। কিন্তু বাকিরা!
এশিয়ান কাপ ২০১১-য় ভারত-বাহরাইন ম্যাচে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে রেনেডি। ছবি: এএফপি।
• আপনিই তো ওঁদের দিল্লি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন?
রেনেডি: যখন শুনলাম দিল্লিতে ওদের খেলা দেখতে আসার অবস্থা নেই, তখন আমি ওদের বাড়িতে যাই। প্রথমে অমরজিতের বাড়ি। তার পাশেই জিকসনের বাড়ি। বরিসের বাড়িও। সবার অবস্থা দেখে এত খারাপ লাগে যে, আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। সঙ্গে ফেডারেশনকেও জানাই। আমার ফেসবুক পেজেও পুরো বিষয়টি লিখি। এর পরে অনেক সাহায্য এসেছে। তার পরেই ওঁরা আসতে পেরেছেন।
• সবার শেষে কী বলবেন, এই প্রতিভাদের পরিচর্যা করার আসল রাস্তাটা কী?
রেনেডি: ভাল কোচ, ভাল ট্রেনিং, ভাল অনুশীলন ম্যাচ খেলে যাওয়া। অবশ্যই সেটা নেপালের বিরুদ্ধে নয়। ঘুরে ফিরে ওই নেপাল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলে কিছু হবে না। ভারতীয় সিনিয়র দলের ক্ষেত্রেও একই বিষয়। না হলে ভেবে দেখুন, আমরা ২০০৭ ও ২০০৯-এ সিরিয়াকে নেহরু কাপে হারিয়েছিলাম। আজকে ওরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ড্র করছে। কোথায় পৌঁছে গিয়েছে। আর আমরা কোথায় পড়ে! এই ছোটদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কম করে ইউএই, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো দলের বিরুদ্ধে খেলা উচিত। তবেই উন্নতি হবে। আর এই প্রতিভারা ফল দেবে।
আরও খবর
• ফুটবল উৎসবের মধ্যেই বড্ড একলা দিল্লির অম্বেডকর স্টেডিয়াম
• এই দলে ভবিষ্যতের রেনেডি, ভাইচুংকে দেখতে পাচ্ছেন?
রেনেডি: ওরা তো আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। অনেক সুবিধে পায়। অনেক বেশি প্রতিভা। সুযোগ পেলে ওরা সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।