৩৮ বছর আগে আমাদের মতো কাপ আর ঠোঁটের ফাঁকটা ভুলে যেও না

সামনের রবিবার পর্যন্ত কোনও কথা নয়। আমার মুখে কথাটা শুনে তখন অবাক চোখে তাকিয়ে শিল্টন, প্রীতমরা! গত শনিবারের সন্ধে। স্পোর্টিং ক্লুবকে হারিয়ে সবে বারাসত স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে ঢুকছে মোহনবাগান টিম। পিছন পিছন আমরা মানে প্রাক্তনরা। হঠাৎই গ্যালারির দিকে চলে গেল চোখটা। এক সমর্থক দু’হাতে তুলে ধরেছেন পোস্টার— স্বাগতম মোহনবাগান, আই লিগ চ্যাম্পিয়ন ২০১৫!

Advertisement

শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

মোহনবাগান ২০১৫। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

সামনের রবিবার পর্যন্ত কোনও কথা নয়।
আমার মুখে কথাটা শুনে তখন অবাক চোখে তাকিয়ে শিল্টন, প্রীতমরা!
গত শনিবারের সন্ধে। স্পোর্টিং ক্লুবকে হারিয়ে সবে বারাসত স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে ঢুকছে মোহনবাগান টিম। পিছন পিছন আমরা মানে প্রাক্তনরা। হঠাৎই গ্যালারির দিকে চলে গেল চোখটা। এক সমর্থক দু’হাতে তুলে ধরেছেন পোস্টার— স্বাগতম মোহনবাগান, আই লিগ চ্যাম্পিয়ন ২০১৫!
ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়, ওই পোস্টারটা দেখে তেমনই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। তাই সাততাড়াতাড়ি ড্রেসিংরুমে ফিরে ওই কথাটা বলেছিলাম শিল্টনদের। মনের ফ্ল্যাশব্যাকে বারবার ভেসে উঠছিল ৩৮ বছর আগে কেরলের এক পড়ন্ত গ্রীষ্মের বিকেল।
৬ মে, ১৯৭৭।

Advertisement

এর্নাকুলামে সে দিন সদ্য শেষ হয়েছে প্রথম ফেডারেশন কাপ ফাইনাল। স্কোরবোর্ডে দেখাচ্ছে আইটিআই (বেঙ্গালুরু)-১ : মোহনবাগান-০!
ড্রেসিংরুমে হাবিবভাই চিৎকার করে বুক চাপড়াচ্ছে।, আকবর, শ্যাম, মানস, গৌতম, প্রসূনরা কেউ ফুঁপিয়ে কেউ বা হাউহাউ করেই কাঁদছে। সুব্রত ভট্টাচার্য, সুধীর কর্মকার, সুভাষ ভৌমিকের চোখমুখ থমথমে। প্রদীপ চৌধুরী দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে মাথা নিচু করে নিথর বসা। তখনও কেউ ভাবতেই পারছি না মোহনবাগান ক্লাবের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটা প্রথম সুযোগেই ফেড কাপ তুলতে পারেনি!

সে বছরই আমি মোহনবাগানে এসেছি। ফাইনালে আমাদের গোলে খেলেছিল বিশ্বজিৎ দাস। আমি রিজার্ভে। সিনিয়রদের পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও সে দিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

Advertisement

প্রথম গলাটা চড়ালেন আমাদের কোচ প্রদীপদা। ‘‘দেখলি, কেন ম্যাচের আগে পইপই করে তোদের বলেছিলাম চায়ের কাপ আর ঠোঁটের মধ্যেও দূরত্ব মোটেই কম নয়। বড়লোকের বাউন্ডুলে ছেলের পয়সা খরচের মতো গোল মিস করলে কী হয় দেখলি তো!’’

ঠিকই তো! এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না, সে দিন গোটা ম্যাচ খেলেছিলাম আমরাই। বিশ্বাস করুন, কুড়িটা গোল মিস করেছিলাম! আর দিনের শেষে কাপটা নিয়ে নাচতে নাচতে বেঙ্গালুরু চলে গিয়েছিল দেবরাজ-রাজেশ্বররা। অথচ ফাইনালে আমরাই ছিলাম হটফেভারিট। ডেম্পোকে ৬-৩, সেমিফাইনালে দু’লেগ মিলিয়ে লিডার্সকে ৬-৩ উড়িয়ে ফাইনাল গিয়েছিলাম। ফাইনাল খেলতে হোটেল থেকে বেরোনোর আগে প্রদীপদা যখন আমাদের জিতে ফেরার শপথ নেওয়াচ্ছেন তখনও টিমের বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা ছিল—মাঠে নামব আর মেরে আসব ওদের। তার পর প্রথম ফেড কাপ বগলদাবা করে কলকাতা ফিরে ধীরেনদার হাতে তুলে দেব। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক!

সেকেন্ড হাফে আমরা এক গোলে পিছিয়ে পড়ার পরেও হাবিবভাইয়ের কথাটা আজও কানে বাজে। ‘‘চল, হামলোগ হি জিতেঙ্গে।’’ তার পর বাবলুদার হেড বারে লেগে ফিরেছিল। গৌতম সরকারের ক্রসে বিদেশ স্রেফ মাথা ছোঁয়ালেই গোল কিন্তু ওইটুকু আর হল না! প্রসূনের মাইনাসে ভৌমিকদা পা ছোঁয়ালেই গোল। সেটাও হয়নি।

অনেকেই হয়তো বলবেন, সেটা ছিল ফেড কাপ—দিন পনেরোর একটা নক আউট টুর্নামেন্ট। আর এ বার ম্যারাথন আই লিগ। কিন্তু আমি ১৯৭৭ আর ২০১৫-র মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছি। সে বার আমাদের ম্যানেজার ছিলেন মান্নাদার সমসাময়িক বিখ্যাত সাইড ব্যাক সুশীল গুহ। আর মেন্টর চুনীদা। এ বারও যেন অনেকটা সেই রকম—ম্যানেজার সত্যজিৎ। আর কম্পটন, আমি, বিদেশরা মেন্টর। সবাই ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার। সে বারও ৬ মে জিতলে ইতিহাস তৈরি হত। এ বারও ৩১ মে শিল্টনরা বেঙ্গালুরুর টিমকে হারালে তৈরি হবে অন্য ইতিহাস।

আমার বাবা প্রয়াত গোলকিপার সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কথা প্রায়ই বলতেন—ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। প্রীতম, কাতসুমিদের তাই রোজ বলছি, ৩৮ বছর আগের ভুল আর নয়। ম্যাচের আগে এতটুকু আত্মতুষ্ট হয়ে পড়িস না। মনের মধ্যে এখন থেকেই ঢুকিয়ে নে একটা কথা— জিতে ফিরতেই হবে।

বহু দিনের ট্রফি খরা কাটাতে গোটা সবুজ-মেরুন পরিবার বসে রয়েছি চাতকের প্রতীক্ষায়। ওই সাতাত্তরেই পেলের কসমসের সঙ্গে ২-২-এর মহাম্যাচ। ত্রিমুকুট জয়। ফেরাতে হলে সেই ইতিহাসটাই ফিরিয়ে আনুক সঞ্জয়ের ছেলেরা। অভিশপ্ত ৬ মে যেন কিছুতেই নয়।

সে দিনের কুখ্যাত আত্মবিশ্বাস যাতে আমার প্রিয় টিমে কোনও ভাবে ঢুকে না পড়ে, তাই সামনের চার দিন কথা বলতে বারণ করছি শিল্টনদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন