স্টুয়ার্ট ব্রড এখন অদ্ভুত একটা কায়দা আবিষ্কার করেছেন। আট হোক বা এক, যে ক’টা উইকেট পাচ্ছেন ব্রড মুখ দু’হাতে চেপে বিস্মিত চোখে দৌড়তে দৌড়তে সতীর্থদের কোলে চড়ে পড়ছেন! যেন প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত বুঝিয়ে চলা, তোমরা যে দিনের পর দিন কী করছ, বুঝতে আমার কেমন অসুবিধে হচ্ছে!
আনন্দ-বিস্ময় মিশ্রিত খুব স্বাভাবিক একটা প্রতিক্রিয়া, যা ব্রড দিতেই পারে। চলতি অ্যাসেজ শুরুর আগে অতুৎসাহী ব্রিটিশ মিডিয়াও আগাম কোনও কুচকাওয়াজ করেনি সিরিজ নিয়ে। ভবিতব্যটা সবাই যেন দেখতে পাচ্ছিল। ক্রিকেট নামক একট নিষ্ঠুর পরিহাসে যে সেটা সম্পূর্ণ ওলটপালট হয়ে খোদ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটকেই দুর্বার ঘূর্ণিতে ছুড়ে দেবে, তা আর কে জানত! ব্রড প্রতিপক্ষ পারফর্মার— তাই তাঁর চোখেমুখে আনন্দ মিশ্রিত বিস্ময়। ক্রিকেটপ্রেমীরা নন। তাঁদের চোখে তাই শুধু বিস্ময়।
এ কোন অস্ট্রেলিয়া!
মার্চের মেলবোর্নে যে টিমটা গোটা ক্রিকেটদুনিয়াকে পদানত করে পঞ্চম বিশ্বকাপ তুলে নিয়েছিল, তারা আর এরা একই টিমের প্রতিনিধি তো? যে ব্যাগি গ্রিনের ঐশ্বর্যের দিকে আগে তাকাতে ভয় পেত সমগ্র বিশ্ব, আজ তারাই কি না শেষ হয়ে যাচ্ছিল মাত্র দু’টো দিনে। অস্ট্রেলিয়া ট্রেন্টব্রিজে হেরে যে চোদ্দো বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংরেজদের অ্যাসেজ দিয়ে আসছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অলৌকিক না ঘটলে ওটা শনিবারই হচ্ছে। প্রশ্ন হল, অপমানটা কোন স্তরের হবে? অস্ট্রেলিয়া কি ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় বার টেস্টে ব্যাট করতে নামাতে পারবে? নাকি ইনিংসে হেরে ফিরবে ছাই হয়ে? ইনিংস হার থেকে নিষ্কৃতি পেতে এখনও দরকার ৯০, হাতে পড়ে মোটে তিনটে উইকেট।
যা-ই হোক শেষ পর্যন্ত, একটা ব্যাপার নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াকুল। অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ককে এ বার ক্রিকেট কিটটা তুলে রাখার সময় হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রখ্যাত সংবাদপত্রে ম্যাচের লাইভ আপডেট চলতে চলতে একটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক টুইট তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্লার্কের পারফরম্যান্স নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৫ সালের পর এত জঘন্য পারফরম্যান্স আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক করেননি। চলতি সিরিজে ক্লার্ক যে অবিশ্বাস্য ১৬.৭১ ব্যাটিং গড় নিয়ে বসে আছেন, তা শেষ বার নাকি ঘটেছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ নামক কোনও এক টুর্নামেন্ট চালু হওয়ার দশ বছর আগে!
অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী ট্রেন্টব্রিজের দু’দিনে আরও অনেক ঘটল। ব্রডের আটে অস্ট্রেলিয়ার ষাট— এক নম্বরে অবশ্যই। এ দিন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের আর তিনটে গেলে দু’নম্বর অবিশ্বাস্যটাও ঘটে যায়। অস্ট্রেলিয়া দু’দিনে হারে।
কে বিশ্বাস করবে, দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রেলিয়ার মতোই করেছিল। ডেভিড ওয়ার্নারকে (৬৪) আবার খুনে ওয়ার্নার মনে হচ্ছিল। ক্রিজ রজার্সও (৫২) যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ইংল্যান্ড যে রানটা করেছে সেটা অস্ট্রেলিয়াও করতে পারে। প্রথম ইনিংসের ষাট অলআউটটা অঘটনই ছিল। কিন্তু বেন স্টোকস যে আচমকা ব্রড হয়ে উঠলেন! দিনের শেষে দেখা গেল, স্টোকস বলটা তুলে দেখাচ্ছেন। স্বাভাবিক। এমন ঐতিহাসিক জয়ের দরজা যদি খুলে দেয় তাঁর পাঁচ উইকেট, আবেগাপ্লুত হওয়াই স্বাভাবিক। যে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেট গেল ১১৩ রানে, তাদেরই পরের ছ’টা বেরোল ১৩০ রানে। স্টিভ স্মিথ (৫), শন মার্শ (২), ক্লার্ক (১৩), নেভিল (১৭)—পরাজিত এবং পদানত। ক্রিজে এখন একক লড়াই চালাচ্ছেন অ্যাডাম ভোগস (৪৮ ব্যাটিং)। কিন্তু সেটা ঠিক ততটাই অসম লাগছে যতটা লেগেছে ইংল্যান্ড ইনিংস চলাকালীন মিচেল স্টার্কের যুদ্ধ (৬-১১১)। ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করল ৩৯১-৯ স্কোরে। জো রুট শেষ পর্যন্ত থামলেন ১৩০ রানে। জনি বেয়ারস্টো করলেন ৭৪। রানটা বিশাল নয়, কিন্তু ষাট অলআউট হলে দু’শোও তো দুর্জেয় দেখায়। ইংল্যান্ডের লিডটাই দাঁড়াল ৩৩১ রানের। দু’টো টিমে মোটামুটি তখন এক আলোকবর্ষ তফাত!
আর ব্যাগি গ্রিনের এমন দৃষ্টিকটু বিজ্ঞাপনে মারাত্মক আহত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহল। ইয়ান হিলি একজন। পরিষ্কার বলে দিলেন যে, সঙ্গে বউ আর বান্ধবী রাখাতেই এমন হয়েছে। প্লেয়ারদের মনঃসংযোগটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ‘‘সবারই তো দেখছি সঙ্গী আছে এখানে। আমি যাদের সঙ্গে খেলেছি তারা কিন্তু এমন ব্যাপার ঘৃণা করত। মনঃসংযোগের সঙ্গে কিছুতে আপস করত না। সিরিজ না জেতা পর্যন্ত তখন বউ বা বান্ধবীদের আনার অনুমতিও দেওয়া হত না,’’ চ্যানেল নাইনে ক্ষোভ উগরে দেন হিলি। অস্ট্রেলীয় মিডিয়া আবার শালীনতার সীমাকেও টুকরো করে দিয়েছে। ‘অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট, শান্তিতে ঘুমোও’ জাতীয় লেখালেখি তো চলছিলই। কিন্তু কার্ল স্টেফানোভিক নামের এক অস্ট্রেলীয় টিভি চ্যানেল প্রেজেন্টার যা করলেন, কল্পনাতীত। তিনি বাজি ধরেছিলেন, ক্লার্ক প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি না করতে পারলে নগ্ন হয়ে দৌড়বেন। প্রথম কেন, দ্বিতীয় ইনিংসেও তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি ক্লার্ক। এবং কার্লও প্রতিজ্ঞাটা রাখলেন শুক্রবার সকালে!
যে কাণ্ড ট্রেন্টব্রিজ বিপর্যয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। মাইকেল ভন যখন ইংলিশ ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের আবির্ভাব নিয়ে বিভোর, কলামে লিখে ফেলছেন তাঁর প্রত্যাশার অনেক আগে এরা সাফল্যকে নিয়ম করেছে, ডিন জোন্স তখন তুলোধোনা করছেন অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংকে। ক্লার্কদের ব্যাটিং দেখে তাঁর একটাই উপমা মাথায় আসছে— প্যাথেটিক। মিডিয়া লিখছে, মিস্টার ক্লার্ক এ বার দয়া করে ক্যাপ্টেন্সিটা ছেড়ে বিদায় নিন!
দ্বিতীয় দিনের মতো খেলা শেষের কথা যখন ঘোষণা করলেন আম্পায়াররা, ট্রেন্টব্রিজ আকাশ বেশ অন্ধকার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-আকাশ? তার আঁধারের সঙ্গে কেউ এখন আর পাল্লা দিতে পারবে? কখনও সম্ভব?
ছবি এএফপি ও গেটি ইমেজেস।