ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট দূতাবাসের ফার্স্ট অফিসার চলে গেলেন

অ্যান্থনি কোজিয়ার ধর্মভীরু খ্রিস্টানদের মতো প্রতি রবিবার চার্চে যেতেন কি না জানি না। তবে ক্রিকেট ঈশ্বরের চার্চে ২৪X৭ এমনই আনাগোনা ছিল তাঁর যে, হটলাইনে নিজের জন্য সেরা বন্দোবস্ত করে তবেই তিনি বিদায় নিলেন।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০৩:৫৭
Share:

অ্যান্থনি কোজিয়ার ধর্মভীরু খ্রিস্টানদের মতো প্রতি রবিবার চার্চে যেতেন কি না জানি না। তবে ক্রিকেট ঈশ্বরের চার্চে ২৪X৭ এমনই আনাগোনা ছিল তাঁর যে, হটলাইনে নিজের জন্য সেরা বন্দোবস্ত করে তবেই তিনি বিদায় নিলেন।

Advertisement

দেখে গেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দুটোতেই তাঁর ক্রিকেট-হতমান দেশ কি না ফের বিশ্বজয়ী।

তিনি— টোনি কোজিয়ার নিজের জন্য এর চেয়ে বড় ওয়েস্ট ইন্ডিজ রত্ন পুরস্কার আর কি আশা করতে পারতেন?

Advertisement

কোজিয়ারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় আজ থেকে উনিশ বছর আগে বার্বেডোজে। কোজিয়ার তখন একটা ক্রিকেট ম্যাগাজিন চালান তাঁর ছেলের সঙ্গে। বাবা-ছেলে ছাড়াও বিশ্বের অনেক ক্রিকেট সাংবাদিকও লেখেন সেখানে। সমস্যা হল, বার্বেডোজের বাইরে সেটা বিক্রি হওয়া সমস্যা। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এক-একটা দ্বীপপুঞ্জে এক একটা রাম বিখ্যাত। কোজিয়ার বার্বেডোজে যে রাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি থেকে ব্যাক কভার সংগ্রহ করেছেন তারা আবার ত্রিনিদাদে ব্রাত্য। ত্রিনিদাদে যাদের বহু খোঁজাখুজি করে পাওয়া গেল সেই রামের বিজ্ঞাপন অ্যান্টিগায় দেওয়া যাবে না। দু’হাজার দশে ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে দেখি কোজিয়ারের সেই ম্যাগাজিন ধুঁকছে। গ্রাহক সংখ্যা আরও কমে গিয়েছে। বিজ্ঞাপন প্রায় বন্ধ। কিন্তু কোজিয়ার লড়ে যাচ্ছেন।

ওঁকে বলেছিলাম, ভারতের মতো ক্রিকেট পাগল দেশেও স্পোর্টস ম্যাগাজিন সংস্কৃতি বহু বছর উঠে গিয়েছে। এমনকী আমাদের সংস্থার পটৌডি সম্পাদিত ম্যাগাজিনও। আপনি কেন নিশ্চিত হার জেনেও লড়ছেন? কোজিয়ার একটা অসামান্য উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘কমার্স মে উইন বাট রোম্যান্স উইল নেভার লুজ।’’

পরের বছর খবর পাই উইকেট পড়ে গিয়েছে। ম্যাগাজিন বন্ধ। কিন্তু গলায় জড়ানো সেই আন্তরিকতাটা ভুলতে পারি না যে, ব্যবসা জিততে পারে কিন্তু রোম্যান্স কখনও হারবে না।

ফ্র্যাঙ্ক ওরেল যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সর্বকালীন রাষ্ট্রদূত হয়ে থাকেন। তা হলে ওরেলের দূতাবাসের ফার্স্ট অফিসার ছিলেন কোজিয়ার।

দেশের হয়ে একটা বলও খেলেননি। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে তাঁর প্রভাব পাঁচ হাজার রান আর তিনশো উইকেটের সমতুল্য। একটা সময় বলা হত ওয়ালি গ্রাউট মাঠে হেঁটে গেলে পিছনে অদৃশ্য অস্ট্রেলিয়ান পতাকা হাঁটে। সচিন তেন্ডুলকরের পিছনে কোটি কোটি ভারতীয় অদৃশ্য তেরঙ্গা ঝান্ডা দেখেছেন। তিনি টোনি কোজিয়ার হেঁটে গেলে মনে হত সর্বাঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট ক্যালিপসো বাজছে।

রেডিও, টিভি দুই মিলে কোজিয়ার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অবশ্যই রিচি বেনো। কিন্তু অসংখ্য কিংবদন্তি প্লেয়ারে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের উপর বেনোর এত প্রভাব নেই যা কোজিয়ারের ছিল নারকেল গাছ আর সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দ্বীপভূমির উপর।

সরেজমিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে ধারণা ছিল এমন বিশ্বখ্যাত ভাষ্যকার গোটা দ্বীপপুঞ্জ জুড়েই একই রকম আরাধ্য হবেন। ভুলটা ভেঙে গেল পোর্ট অব স্পেন ওভালে। যখন প্রেসবক্সের বাইরে থেকে চিৎকার করে এক সমর্থক অকথ্য গালাগাল শুরু করল। কোজিয়ার অবিচলিত। একই মুখ নিয়ে কমেন্ট্রি করে যাচ্ছেন।

এমন আশ্চর্য হয়েছিলাম যে বলেই ফেলি আপনি কিছু বললেন না কেন? কোজিয়ার জাস্ট উড়িয়ে দিলেন, ‘‘এ তো কিছুই না। জামাইকাতে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। আমার জীবনে এ সব লেগেই থাকে। দ্বীপপুঞ্জগুলোর মধ্যে এত হানাহানি কী বলব।’’

শুনে মনে হয়েছিল, এর আসল অনুবাদ হবে ক্রিকেটের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা যায়। কোনও কিছুর জন্যই ক্রিকেটকে ত্যাগ করা যায় না।

সুনীল গাওস্কর-সহ ভারতীয় ক্রিকেটারদের অসম্ভব প্রিয় ছিলেন কোজিয়ার। কারণ, দেশ-সময়-গায়ের রং সব কিছুর উপর তিনি ক্রিকেটকে চাপিয়েছিলেন। ছিয়াত্তরের পোর্ট অব স্পেনে যখন ভারত চতুর্থ ইনিংসে চারশো রান তাড়া করছে তখন রেডিও ধারাভাষ্যে ছিলেন ডিকি রত্নাগর আর কোজিয়ার। ভাষ্যে অবিমিশ্র ভারতীয়দের প্রশস্তি শুনে বোঝা যায়নি কে ভারতের ডিকি? কে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোজিয়ার?

কমেন্ট্রি বক্সে ক্রিকেট না খেলা মানুষকে নিয়ে তারকা ক্রিকেটারদের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য বাধ্যতামূলক ভাবে জারি থাকে। তাঁকে— কোজিয়ারকে নিয়ে সে সবের প্রশ্নই নেই। উইকস থেকে লয়েড। লারা থেকে ভিভ। সবাই একই রকম সশ্রদ্ধ।

বিদেশি দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এলে প্রতিবার নিজের ব্রিজটাউনের বাড়িতে টেনিস বলে বিচ ক্রিকেটের আসর বসাতেন কোজিয়ার। সে বার বিশেষ আকর্ষণ ছিল হোল্ডিংয়ের বোলিং, গাওস্করের ব্যাটিং। ভারতীয় সাংবাদিকদের সবার নেমন্তন্ন।

এমনই দুর্ভাগ্য, ট্যাক্সিচালক বাড়ি গুলিয়ে ফেলায় সেই নেমন্তন্ন মিস করে যাই। আজ আর তার জন্য মনস্তাপ হচ্ছে না।

তিনি— কোজিয়ার ওপরে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরেল-কনস্ট্যানটাইনদের বলতে শুরু করেছেন যে, ৭৫ করে ওপরে এলাম। ইট ইজ এ গুড স্কোর। আর বলছেন ম্যাচটা তা হলে প্রতি শনিবার রাখছি। কোজিয়ারের ক্রিকেট রোম্যান্সের যা রেকর্ড যে যখন ওপরে ম্যাচ দেখতে চাইবে, প্রতি সপ্তাহে ক্রিকেট পাবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন