স্বাধীনতা দিবসে আনন্দবাজারের জন্য বিশেষ লেখা

শক্তিশালী দেশ গড়তে নতুন অঙ্গীকার চাই শিশুদের নিয়ে

মাস্টার ব্লাস্টার। তবে ব্যাট হাতে নয়, অন্য ভূমিকায়। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিশুদের পরিচর্যা জরুরি। চাই বাবা-মায়ের দুর্দান্ত পার্টনারশিপ। ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি ডাক দিচ্ছেন নতুন শপথের...যদি আমরা পুরনো ঐশ্বর্যের সঙ্গে তারুণ্যকে দারুণ ভাবে মেশাতে‌ পারি, তা হলে নতুন বিশ্বের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠতে পারে ভারত।

Advertisement

সচিন তেন্ডুলকর

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০৫:২৩
Share:

দায়বদ্ধতা: শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলতে শিশুদের সুস্থ বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ সচিনের। ফাইল চিত্র

আজ আমরা ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে চলেছি। ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭ থেকে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। রাজা-মহারাজাদের নানা রাজ্য আর অঞ্চলের মিশ্রণ থেকে বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তি হয়ে উঠেছে ভারত। আমাদের দেশের বিদ্বানেরা এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান। বলিউড ফিল্ম গোটা দুনিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমাদের ক্রীড়াবিদেরা সাহসিকতার সঙ্গে দেশের গর্ব হয়ে উঠেছে। আর ইসরো (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন) এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোণে কোণে তেরঙ্গাকে প্রতিষ্ঠা করছে। তবু আমার মনে হয়, দেশের সেরাটা এখনও আসা বাকি।

Advertisement

আমরা বিশ্বের সব চেয়ে পুরনো সভ্যতাগুলোর অন্যতম। ২০২০-তে আমরা সব চেয়ে তরুণ দেশও হয়ে যাব, যখন আমাদের বর্তমান জনসংখ্যার গড় বয়স হয়ে যাচ্ছে ২৯। যদি আমরা পুরনো ঐশ্বর্যের সঙ্গে তারুণ্যকে দারুণ ভাবে মেশাতে‌ পারি, তা হলে নতুন বিশ্বের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠতে পারে ভারত। আমার একটা কথা বলার আছে এখানে। আমাদের দেখতে হবে, আর্থিক পরিস্থিতি যেন সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই কারও সামনে বাধা সৃষ্টি করতে না-পারে। এই দ্বৈত দায়িত্ব পালনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শিশুদের সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা। আসুন, স্বাধীনতা দিবসের দিনে আমরা শপথ গ্রহণ করি, শিশুদের বেড়ে তোলার ব্যাপারে কোথাও কোনও আপস করব না। যদি আমাদের বাচ্চাদের সুস্থ, হাসিখুশি আর বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলতে পারি, তা হলে আগামী দিনে আমাদের দেশ আরও অনেক শক্তিশালী এবং ধনী হয়ে উঠতে পারে। আমার স্ত্রী শিশুচিকিৎসক। সেই সঙ্গে আমি ইউনিসেফের হয়ে নানা কাজে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি, খুব ছোটবেলা থেকে শিশুদের গড়ে তোলার দিকে নজর দিলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা আর্থিক ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব পড়তে পারে। একটা তথ্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে যে, শিশুদের ঠিক ভাবে গড়ে তোলার জন্য এক ডলার খরচ করলে সমাজ ফিরে পেতে পারে ১৩ ডলার!

শিশুর যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটা জিনিস মনে রাখার দরকার। যেমন, তাদের মস্তিষ্কের গঠন শুরু হয় মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই। আর দু’বছর বয়স হতে হতেই মস্তিষ্কের আশি শতাংশ গঠন সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সেই জন্য মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকে দু’বছর পর্যন্ত শিশুদের বিশেষ ভাবে যত্ন নেওয়া জরুরি। এই সময়টায় যথেষ্ট সতর্ক না-হলে বড় হওয়ার পরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বহু হাজার বছর আগে থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে একটা প্রথা রয়েছে। যার নাম ‘গর্ভসংস্কার’। অর্থাৎ মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই শিশুর যত্ন নেওয়া এবং তাকে যত্নের সঙ্গে লালন করতে থাকা। অনেকেই নিশ্চয়ই মহাভারতে অভিমন্যুর কাহিনি জানেন। মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই যিনি যুদ্ধের কলাকৌশল শিখেছিলেন। একটি শিশুর সুন্দর বিকাশের জন্য তাই সুস্থ, নিরাপদ এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ খুব দরকার। তেমনই গুরুত্বপূর্ণ ঠিকঠাক পুষ্টি। এ যুগে সমপরিমাণ দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হয় বাবা ও মাকে। একটি শিশুর মাকে যতটা দরকার, ঠিক ততটাই প্রয়োজন বাবার সাহচর্যের। পরিসংখ্যান বলছে, জন্মলগ্ন থেকে যে-সব শিশু বাবা-মা দু’জনকেই সমান ভাবে পাশে পেয়েছে, তাদের অগ্রগতি অনেক দ্রুত এবং সাবলীল হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মায়েদের উপরে যাতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি না-হয়, সেটা দেখাও খুব জরুরি। ক্রিকেটে দু’জন ব্যাটসম্যান থাকে আর সিঙ্গলস নিয়ে স্ট্রাইক ঘোরাতে হয়। জীবনের পার্টনারশিপ তেমনই। মাঝেমধ্যে স্ত্রী নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে থাকবে। তখন স্বামীকে স্ট্রাইক নিতে হবে।

Advertisement

স্মরণীয়: ২০১১ সালে ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয়ের পরে সতীর্থদের কাঁধে তেরঙ্গা হাতে সচিন তেন্ডুুলকর। ফাইল চিত্র

শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে হিংসাত্মক পরিবেশ সম্পূর্ণ ভাবে লোপ পাওয়া উচিত। নইলে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে যেতে পারে। পরবর্তী কালে সেই ক্ষত সারিয়ে তোলা খুব কঠিন হয়। সেই জন্য শিশুর সামনে বাবা-মায়ের সুন্দর ব্যবহার খুব জরুরি। সন্তানের সুস্থ মানসিক গঠনের জন্য চেষ্টা করতে হবে ‘ফেয়ার প্লে’ পুরস্কার জেতার। প্রথম চব্বিশ মাস স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতার দিকটা দেখতেই হবে। নিশ্চিত করতে হবে, শিশু যেন পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানীয় জল পায়। জীবনের শুরুতেই যেন ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া জাতীয় অসুখের মধ্য দিয়ে যেতে না-হয়। আরও একটা জিনিস আমাদের দেখা দরকার। প্রতিটি সংস্থায় এবং পাবলিক প্লেসেও যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন স্তন্যপানের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। শিশু জন্মানোর পর থেকে তাদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং খেলা করার সুপ্রভাব পাওয়া যায়। শিশুর মন খুবই কৌতূহলী। ওরা নতুন জিনিস শেখা উপভোগ করে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভাল ভাবে তাদের গড়ে তোলা যায়। শুনেছি, শিশুদের সামনে সুন্দর গান বাজানোরও ভাল সুফল পাওয়া যায়।

বিশেষ ভাবে নজর দিয়ে শিশুদের গঠনের উপরে লগ্নি করলে দেশ এবং সমাজ তার সুফল পাবেই। ২০৫০ সালে আমাদের দেশকে আমরা এ ভাবেই একচ্ছত্র মহাশক্তিতে পরিণত করে তুলতে পারি। আসুন, এই স্বাধীনতা দিবসে সকলে মিলে শপথ নিই, শিশুদের প্রতি যত্ন নিয়ে তাদের সুন্দর করে গড়ে তুলব। তা হলে আরও নোবেল পুরস্কার আসবে। অনেক অলিম্পিক পদক এবং বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারব আমরা। প্রত্যেককে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। জয় হিন্দ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন