যেন গোল না খাই। শিল্টনের প্রার্থনা। ছবি: উৎপল সরকার
সকাল আটটা পঁয়ত্রিশ। তাঁবু ছেড়ে মাঠের দিকে এগোতেই তিনি ঘেরাও হয়ে গেলেন সবুজ-মেরুন সমর্থকদের কাছে।
চার বছরের ট্রফি-বুভুক্ষু মুখগুলোর তখন আর্জি, “স্যর, কাল ওদের হারাতেই হবে। লিগটা চাই-ই চাই।” গত দশ বছরে দেশের বাইরে থেকে ভারতীয় ফুটবলে ট্রফি আনা একমাত্র কোচ একবার সেই মুখগুলোর দিকে তাকালেন। তার পর বললেন, “টেনশন লেনেকা নেহি, দেনেকা হ্যায়।”
সকাল দশটা কুড়ি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর দিকে উড়ে যাচ্ছে চোখাচোখা প্রশ্ন। চার মরসুম ট্রফিহীন ক্লাবের ‘হটসিট’-এ বসা ষাটোর্ধ্ব কোচ এ বার বললেন, “বাড়ির অসুস্থ কুকুরটাকে নিয়ে সত্যিই খুব চাপে আছি।”
দু’টোই সুভাষ ভৌমিক। কিন্তু কোন সুভাষ ডার্বির টেনশন কাটাতে বেশি উদগ্রীব?
ডার্বির চব্বিশ ঘণ্টা আগে বাগান টিডি সারাক্ষণ হাসি, ঠাট্টা, কপট রাগের আড়ালে নিজের চাপ লুকিয়ে রাখলেন। মাঠে নিজের ফুটবলারদের মধ্যেও সেই চাপ সংক্রমিত হতে দিলেন না। কিংশুক, রাম, বলবন্তদের সঙ্গে মশকরাতে মজে থাকলেন। ড্রেসিংরুমেও কখনও বেজে উঠল, ‘কলিও কা চমন’, কখনও ‘লুঙ্গি ডান্স’। শুধু পাসিং আর সেটপিস অনুশীলনের সময়ই পুরো সিরিয়াস সুভাষ। রবিবার কি ডেডবল সিচুয়েশন থেকেই গোলের ফুল ফোটাতে চাইছে সুভাষের বাগান?
তবে অনুশীলনে বল ক্লিয়ারেন্স, হেডিং বা সেকেন্ড-বল ধরায় ফাতাই, কিংশুক, জেজেদের সমস্যা হলে সমাধানের দাওয়াই নিয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের কাছে। সঙ্গে সাতসকালে মাঠে হাজির সবুজ-মেরুন সমর্থকদের বাগান-টিডি হাবেভাবে যেন এটাও বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন, ধুস্, চাপ কোথায়? যা দেখে সদস্য গ্যালারির সবুজ-মেরুন রঙের চেয়ারে বসে ক্রিকেটার রণদেব বসুও এক সময় বলে বসলেন, “সুভাষদার জন্যই টিমটার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ পাল্টে গিয়েছে। কাল বাবাকে নিয়ে ম্যাচটা দেখতে যাব।”
সুভাষের চাপটা কোথায়? উত্তর কলকাতার ক্লাবে প্রথমবার খেলতে এসে একেবারে ডার্বিতেই হাতেখড়ি হতে চলা আদিসা ফাতাইদের রক্ষণ নিয়ে।
সাংবাদিক সম্মেলনে সে কথা গোপনও করলেন না বাগান টিডি। “ফাতাইকে এর আগে অন্তত একটা ম্যাচ দেখে নিতে পারলে ভাল হত। এ রকম পরিস্থিতিতে চট করে কাউকে সচরাচর নামাতে চাই না। কিন্তু এখন ও সব ভেবে লাভ নেই। কখনও অজ্ঞতাও আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।”
মুখে না বললেও এ রকম পরিস্থিতিতে কোচ সুভাষের অতীত অভিজ্ঞতা মধুর নয়। পাঁচ বছর আগে আই লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে বাগানের ঐতিহাসিক ৫-৩ জয়ের দিন ঠিক একই পরিস্থিতি উদয় হয়েছিল সেই ম্যাচে লাল-হলুদ কোচের সামনে। সে দিন স্টপারে নবাগত উগা ওপারাকে খেলানোর সাহস পাননি সুভাষ। যার মাসুল গুনতে হয়েছিল তাঁকে। তাই এ বার বাগানে বসে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তিনি। ফাতাইকে পইপই করে বোঝাচ্ছেন এই ম্যাচের গুরুত্ব। টিম সূত্রে খবর, ফাতাইয়ের অ্যান্টিসিপেশন, কভারিং, ক্লিয়ারেন্স, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় মুগ্ধ সুভাষ। কিন্তু একটাও প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে তাঁকে যাচাই না করার খচখচানি রয়েই গিয়েছে নিউ আলিপুরের বাসিন্দার মনে।
যুদ্ধ জয়ের বূহ্য সাজানোর পরেও রক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সুভাষ বলে উঠছেন, “শৈশবে নতুন দাঁত ওঠার সময় যেমন মাঁড়ি শিরশির করে আমার রক্ষণও সে রকম সদ্যোজাত। তাই নানা যত্ন নিতে হচ্ছে।” আর যদি আগের চার ম্যাচের মতো শেষ দশ -পনেরো মিনিট টিমটা দাঁড়িয়ে যায়? সুভাষের চটজলদি উত্তর, “তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
সব ভুল শুধরে আর্মান্দো কোলাসোর দলের বিরুদ্ধে নব উদ্যমে ঝাঁপাতে মরিয়া বাগান টিডি। জানেন জিতলেই লিগ জয়ের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবেন। চেনা মেজাজেই তাই সুভাষ বলছেন, “ভাল খেলার সঙ্গে তিনটে পয়েন্টও চাই। মাঠে ওদের আগে আমাদের দৌড়তে হবে, হেড করতে হবে, ট্যাকল করতে হবে। ওদের আগে আমাদের গোলও গোল করতে হবে। আমি খেটে আর খুঁটে খাওয়ায় বিশ্বাসী।”
শেষ বেলায় বাগানের অন্যতম শীর্ষকর্তা সৃঞ্জয় বসু যখন টিডিকে থাম্বস-আপ দেখিয়ে তাঁবু ছাড়ছেন, এক অদ্ভুত নির্ণিমেষ দৃষ্টি সুভাষের চোখেমুখে। তাঁবুর বাইরে থেকে সমর্থকদের স্লোগান আছড়ে পড়ছে কোচের ঘরে “এই তো সে দিন মুখ লুকোতিস দশে দশ-এর কালে/পড়বে মনে সে সব দিন বল জড়ালে জালে।”
সুভাষ সে দিকে কান না দিয়ে তখনও ব্যস্ত ‘টেনশন দেনে কা’-র অঙ্ক সাজাতে!