‘এই ব্রাজিলে শিল্প হয়তো কম, জেতার জেদ বেশি’

এই ব্রাজিল দলটায় কেউ অপরিহার্য নয়। বুধবার সার্বিয়ার বিরুদ্ধে মার্সেলো যখন শুরুতেই চোট পেয়ে বেরিয়ে গেল, ফিলিপে লুইস নেমে পড়ল এবং প্রমাণ করে দিয়ে গেল, ও কোনও অংশে পিছিয়ে নেই।

Advertisement

জ়িকো

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৮ ০৫:২০
Share:

ছন্দে: রক্ষণ সামলে দুরন্ত গোলও করছেন থিয়াগো সিলভা। ছবি: এএফপি

গোটা দুনিয়া অন্য এক ব্রাজিলকে দেখে চমকে গিয়েছে হয়তো। আমি কিন্তু সেই দলে নেই।

Advertisement

রক্ষণশীল কিছু পন্ডিত দেখছি বক্তব্য দেওয়া শুরু করে দিয়েছে যে, ব্রাজিলের কেমন ধরনের ফুটবল খেলা উচিত। ওরা বলছে, এটা আসল ব্রাজিল নয়। সেই শিল্পটাই তো অনুপস্থিত হলুদ জার্সির খেলায়। জার্মানির পাসিং গেম বা স্পেনের তিকিতাকার সৌন্দর্য নেই। এটা আবার কেমন ব্রাজিলীয় ফুটবল?

উত্তরে আমি একটাই কথা বলব। এই ব্রাজিলীয় অনেক কিছুর মিশ্রণে তৈরি। নেমারের শিল্প আছে। কুটিনহোর টাচ আছে। পাওলিনহো আর জেসুসের দৌড় আছে। পাগেনার, ফিলিপে লুইস এবং ফার্নান্দিনহোর তিকিতাকা রয়েছে। মিরান্দা এবং থিয়াগো সিলভার নির্মমতা রয়েছে। বিবর্তন ঘটে এটাই নতুন ব্রাজিল। হয়তো আগের মতো সুন্দর নয় কিন্তু চোখে লাগার মতো ফুটবল খেলতে পারে। যারা বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের ধ্বংস করতে আসেনি, জিততে এসেছে।

Advertisement

এই ব্রাজিল দলটায় কেউ অপরিহার্য নয়। বুধবার সার্বিয়ার বিরুদ্ধে মার্সেলো যখন শুরুতেই চোট পেয়ে বেরিয়ে গেল, ফিলিপে লুইস নেমে পড়ল এবং প্রমাণ করে দিয়ে গেল, ও কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। এমনকি, মার্সেলোর চেয়েও ভাল খেলতে পারে। আমি এই ব্রাজিলকে দেখে নিশ্চিত যে, পরের ম্যাচে যদি নেমারকেও বেরিয়ে যেতে হয়, আমরা ওর অভাব অনুভব করব না। কারণ, ওর পরিবর্ত তৈরি আছে। ফিলিপে কুটিনহো এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ব্রাজিলের সেরা ফুটবলার। কিন্তু তাকেও তো তুলে নেওয়া হল ৮০ মিনিটে। তার পর বাকি সময়ে কি আমরা কুটিনহোর অভাবও অনুভব করেছি? না, করিনি।

বুধবারের ম্যাচের বিশ্লেষণ করতে বসে বিশেষ ভাবে বলতে চাই দু’জনের কথা। মিরান্দা এবং থিয়াগো সিলভা। আমাকে যদি সার্বিয়া ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় বাছতে হয়, এই দু’জনকেই বেছে নেব। প্রত্যাশা মতোই ব্রাজিলকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল সার্বিয়া। আর সেই পরীক্ষায় যে কোনও গোল না খেয়ে ভাল ভাবে আমরা উত্তীর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, তার সিংহ ভাগ কৃতিত্ব এই দু’জনের।

আরও পড়ুন: মেসির গোড়ালিতে লাল তাবিজ!

ব্রাজিলের প্রথম গোলটার নেপথ্যে প্রধান কারিগর আবারও কুটিনহো। পাওলিনহোর উদ্দেশে ওর পাঠানো লবটা অনবদ্য। পাওলিনহো দুরন্ত টাচে গোল করে গেল। অসাধারণ এই গোলটার পরেই সার্বিয়া মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করল। এই সময়টায় বার বার ব্রাজিলের ডিফেন্স পরীক্ষার মুখে পড়ছিল। সেই সময় দুই স্টপার মিরান্দা আর থিয়াগো সিলভা দেওয়াল হয়ে সার্বিয়ায় সব আক্রমণ রুখে দিল। ওরা স্টপার, তাই হয়তো ঝকমকে মিডফিল্ডার বা স্ট্রাইকারদের মতো অতটা প্রচারের আলো পায় না। কিন্তু এক গোলে পিছিয়ে থাকা সার্বিয়া যে ম্যাচে ফিরে আসতে পারল না, তার কারণ মিরান্দা এবং থিয়াগো।

উচ্ছ্বল: ব্রাজিলের জয় মানেই সুন্দরীদের উৎসব। ছবি: গেটি ইমেজেস

আমি বসে বসে গুণেছি। এই সময়টায় দুই প্রান্ত দিয়ে ১২টি আক্রমণ উড়ে এসেছিল ব্রাজিল বক্সে। বাঁ দিকে পাগেনার আর ডান দিকে ফিলিপে লুইসকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখল সার্বিয়া। দানি আলভেসের অভাব পূরণ করা সহজ ব্যাপার নয়। পাগেনার নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পারছে। আমার মনে হচ্ছে, ব্রাজিলকে এই জায়গাটা নিয়ে আরও খানিকটা ভাবতে হবে। একের পর এক আক্রমণের মুখে পড়লে কোনও স্টপার বা গোলকিপারই স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে না। থিয়াগো সিলভা বা মিরান্দারও তো অফ ফর্মের একটা দিন যেতে পারে। তখন কী হবে?

ব্রাজিলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটা করে থিয়াগো সিলভাই ম্যাচের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিল নিজেদের দিকে। ওই গোলটার আগে পর্যন্ত কিন্তু সার্বিয়া খুব ভাল ভাবেই ম্যাচে ছিল। নেমারের কর্নার থেকে দুর্দান্ত হেডে শুধু গোলই করে গেল না থিয়াগো, গোলকিপার অ্যালিসন পরাস্ত হওয়ার পরে অবধারিত গোলও বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওই সময়ে ব্রাজিল যদি গোলটা খেয়ে যেত, তা হলে ম্যাচের রং বদলে যেতে পারত।

কঠিন গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক-আউটে যাওয়াটা কিন্তু ব্রাজিলের জন্য শাপে বর হতে পারে। এ বার বিশ্বকাপের আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাউন্ডের দিকে এগোচ্ছি আমরা। প্রথমেই মেক্সিকোর চ্যালেঞ্জ। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, ব্রাজিলের সামনে আর একটা কঠিন ম্যাচ রয়েছে। তবে বিশ্বাসও রয়েছে যে, আমরা সেই বাধা পেরতে পারব।

এত দিন আমি শুধু নিজের দেশকে নিয়েই লিখে গিয়েছি। এ বার অন্যান্য কয়েকটি ব্যাপারে কথা বলতে চাই। প্রথমেই ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভার) এবং জার্মানি। সব ভাল জিনিসেরই শেষ আছে। জার্মানির সোনার দৌড় শেষ হওয়াটাও সে রকমই। যখন প্রজন্ম বদলের মধ্যে দিয়ে যায় একটা দেশ, এ রকম হতেই পারে। আমাদের সকলের ক্ষেত্রে হয়েছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন। এ বার জার্মানি। লাম, সোয়াইনস্টেইগার, পোডোলস্কি, ক্লোজে— এরা সব দারুণ ফুটবলার ছিল। সকলের বিকল্প খুঁজে বার করা সহজ কাজ নয়।

ভিডিয়ো রেফারি ফুটবলে নতুন এবং ইতিমধ্যেই বিশ্বকাপে এর ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, খেলায় সুবিচার হওয়াটা খুব জরুরি। আমি নিজে ফুটবলার এবং কোচ হিসেবে অনেক বার ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছি। বিশেষ করে মোক্ষম সময়ে সিদ্ধান্ত ঠিক না হলে ভাগ্যটাই পুরো বদলে যেতে পারে। সে দিক দিয়ে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া একদম ঠিক। কিন্তু ‘ভার’ যেন ফুটবলকে পরিচালিত না করে। বিশ্বকাপে প্রযুক্তির যে রকম ব্যবহার দেখছি, তাতে আমার মনে হচ্ছে, রেফারিদের যোগ্যতার বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করছি। ভিডিয়ো রেফারি খুবই ব্যয়বহুল একটা পদক্ষেপ এবং ফুটবলে অনেক জায়গায়, অনেক প্রতিযোগিতায় এই পদ্ধতি রাখাই হয়তো সম্ভব হবে না। তখন তো চালাতে হবে রেফারিদের দিয়েই।

ফিফা কর্তাদের তাই আমার পরামর্শ, রেফারিদের মান উন্নত করার জন্য অর্থ লগ্নি করার কথা ভাবুন। না হলে বিশ্বব্যাপী ফুটবল খেলাটা ধাক্কা খাবে। প্রযুক্তির ব্যবহার করার পরেও বিতর্ক কমছে না। বরং বেড়ে গিয়েছে। রেফারিদের মান উন্নত করার দিকে নজর দিতেই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন