টেস্ট ক্রিকেটে জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি করলে একজন ক্রিকেটারের পরিচিত প্রতিক্রিয়া কী কী হওয়া উচিত? সাধারণত দু’টো ঘটতে দেখা যায়।
সেঞ্চুরি ছুঁয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকিয়ে আকাশছোঁয়া লাফ। দর্শকদের দিকে একটা গর্জন ছুড়ে দেওয়া।
সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে লেখার গরমাগরম মশলা জুগিয়ে যাওয়া।
সাত বছর পর টেস্ট ক্রিকেট মঞ্চে বাংলার গর্বের মশাল ফের জ্বালিয়েও ঋদ্ধিমান সাহা যার একটাও করেননি!
লাফ দেননি। সেঞ্চুরির সময় হেলমেট নামিয়ে ব্যাটটা তুলেছিলেন শুধু। টেস্ট জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি করার পরেও তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনে দেখা যায়নি। এসেছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এবং বোর্ডের ওয়েসবাইটে যে সাক্ষাৎকারটা দিলেন ঋদ্ধিমান, সেখানেও কোনও ‘আমাকে দেখুন’ কথাবার্তা নয়, বরং ‘বয় নেক্সট ডোর’-এর চিরাচরিত ছোঁয়া থেকে গেল।
‘‘অশ্বিন আর আমি ঠিক করেছিলাম লুজ বল পেলে হিট করব। কিন্তু সেটাও যদি একশো শতাংশ নিশ্চিত হই, তবেই।’’
‘‘মনে মনে একটা ব্যাপার চলছিল যে, আগের দু’টো ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি পাইনি। হাফ়সেঞ্চুরির কাছাকাছি পৌঁছে ঠিক করেছিলাম, আগে বাকি ক’টা রান করি। হাফসেঞ্চুরিটা পাই। সেটা করার পর আবার প্রথম থেকে শুরু করেছিলাম।’’
‘‘টেস্ট সেঞ্চুরি বড় কীর্তি। বড় প্রাপ্তি। সেটা ঘরের মাঠে হোক বা বাইরে। আমি খুশি যে আমার সেঞ্চুরিতে টিম সাড়ে তিনশো পার করতে পেরেছে। আমরা চেয়েছিলাম যতটা সম্ভব ব্যাট করতে।’’
মহাকীর্তি গড়েও ঋদ্ধিমান সাহা ঠিক এতটাই নির্লিপ্ত। ঠিক এতটাই বহিঃপ্রকাশহীন।
শোনা গেল, গত রাতে ঋদ্ধির সেঞ্চুরির পর তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলেন ময়দানের কোনও কোনও কর্তা। উত্তরে ‘ভাল লাগছে’, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’-এর বাইরে নাকি কিছু আসেনি। অথচ গত রাত থেকে ঋদ্ধির কীর্তি নিয়ে তীব্র হইচই শুরু হয়েছে তাঁর পারিপার্শ্বিকে। গ্রস আইলেটে দিনের খেলা শেষে আর এক সেঞ্চুরিকারী রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলে গিয়েছেন, ‘‘বুধবার প্রথম সেশনটা খুব ভাল খেলল সাহা। আমি চেষ্টা করেছিলাম ক্রিজে পড়ে থাকতে। জানতাম, টেস্টে সম্মানজনক একটা জায়গায় নিজেদের নিয়ে যাওয়া থেকে আমরা আর পঞ্চাশ-ষাট রান দূরে।’’
সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঋদ্ধি নিয়ে একটার পর একটা পোস্ট। সিএবি যুগ্ম সচিব অভিষেক ডালমিয়া তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলে ঋদ্ধির ছবি দিয়ে দিয়েছেন। শুধু ঋদ্ধিমান বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস দেখাননি। এমনকী ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম যে ছয় আর সাত নম্বর ব্যাটসম্যান একই ইনিংসে সেঞ্চুরি করল, সেটাও একটা সময় পর্যন্ত জানতে পারেননি ঋদ্ধিমান। জায়ান্ট স্ক্রিনে একটা রেকর্ডের কথা যে ভেসে উঠেছে, জানতেন। কিন্তু অক্ষরগুলো এত ছোট ছিল যে, তিনি পড়তে পারেননি!
ময়দান এ সব দেখে, শুনে আশ্চর্য নয়। ঋদ্ধিমান যে ক্লাবে খেলেন, সেই মোহনবাগানের এক কর্তা এ দিন বলছিলেন যে, ঋদ্ধিমানের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। শিরোনামযোগ্য বক্তব্য পেশ না করে নির্লিপ্ত থাকাটাই তাঁর স্বভাব। বাংলা টিমে তাঁর বহু দিনের সতীর্থ একই কথা বললেন। নিজেদের বক্তব্য সমর্থনে এঁরা কেউ কেউ উদাহরণও পেশ করলেন। শোনা গেল, বছর দেড়েক আগের এক আশ্চর্য ঘটনার কথা।
আগের দিন টেস্ট ম্যাচ খেলে ফিরেছেন ঋদ্ধিমান। পরের দিন সিএবি লিগে মোহনবাগানের ম্যাচ ছিল। ঋদ্ধিমান ম্যাচটা খেলেননি। বিশ্রামও নেননি। পুরো দিন সতীর্থদের জন্য জল বয়েছেন! দেশের সেরা উইকেটকিপার হয়েও, টেস্ট ক্রিকেটার হয়েও।
বাংলার হয়ে খেলার সময়কার দু’একটা ঘটনার কথা শোনা গেল। যেমন বাইরে খেলতে গিয়ে শপিং মল বা সিনেমা যাওয়ার সময় গাড়ির অপেক্ষা না করে অটো ধরে বেরিয়ে যাওয়া! বলা হল, যিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলেও সতীর্থদের জন্য ময়দানে জল বইতে দু’বার ভাবেন না, দিব্য অটো চেপে বেরিয়ে পড়েন, ফাঁকা সময়ে জুনিয়রদের ‘চল টিটি খেলবি’ বলে ডাক দেন— জীবনের প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরির পর সেই ক্রিকেটারের তো ‘‘ভবিষ্যতে চেষ্টা করব টিমের কাজে এ রকম আরও আসতে’’ চেনা প্রতিক্রিয়া হবে, নির্লিপ্ততাই হবে তাঁর কীর্তি পরবর্তী স্বাভাবিক চিত্রনাট্য।
দিনের খেলা পরিত্যক্ত: তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিন বৃষ্টিতে একটা বলও খেলা হল না। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৩৫৩ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১০৭-১। ক্রিজে ব্রেথওয়েট (৫৩ ন.আ) ও ডারেন ব্র্যাভো (১৮)।