লড়াকু: সবুজ-মেরুন জার্সিতে।
প্রশ্ন: জঙ্গলমহলের রুক্ষ্ম মাটি থেকে কলকাতা ময়দান—যাত্রাপথ কেমন ছিল?
উত্তর: খুবই কঠিন। আমার বাড়ি গুড়গুড়িপাল থানার ধডরাশোলে। আমাদের দিন আনি দিন খাই পরিবার। বাবা সুধীর মাহাতো চাষি। মা বালিকা মাহাতো গৃহবধূ। দিদি সুমিতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলায় জঙ্গলমহলে ভারী বুটের শব্দ শুনে বড় হয়েছি। কলকাতা তো অনেক দূরের কথা ছিল। মেদিনীপুর শহরে যেতেও ভয় লাগত।
প্রশ্ন: শুরুর দিনগুলোর কথা বলুন। প্রথম ফুটবল খেলা শুরু কবে?
উত্তর: আমার বাবা টুকটাক ফুটবল খেলতেন। তাঁর উৎসাহে ছয়-সাত বছর বয়স থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করেছিলাম আমার পাড়ার ধডরাশোল বিবেকানন্দ ক্লাবে। তারপর মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটি স্পোর্টিং ক্লাব। সেখানে কোচ অমিয় ভট্টাচার্য আমার প্রথম গুরু। তিনি হাতে ধরে আমায় ফুটবলের নানা কৌশল শিখিয়েছেন। এখনও বাড়ি ফিরলে ওঁর কাছে যাই। উনি পরামর্শ দেন। বাড়ি থেকে ১৮ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে রাঙামাটি স্পোর্টিং ক্লাবে সপ্তাহে তিন দিন করে অনুশীলন করতে যেতাম। তখন ওই রুটে সেভাবে বাস চলাচল করত না। মোহনবাগান অনূর্ধ্ব ১৪ দলে সুযোগ পাওয়ার পরে পকেটে ২০ টাকা নিয়ে কলকাতায় আসতাম।
প্রশ্ন: তখন কোন পজিশনে খেলতেন?
উত্তর: আমি শুরু থেকেই মাঝমাঠের খেলোয়াড়। উইং দিয়ে খেলতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: পড়াশোনা কোথায়?
উত্তর: প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি স্থানীয় নার্সারি স্কুলে পড়েছি। তারপর চাঁদড়া হাইস্কুল। সেখানে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। স্কুলের হয়ে খেলেছি।
প্রশ্ন: এখন কোথায় থাকেন?
উত্তর: মোহনবাগান মেসে। সেখানে আমি, মইনুদ্দিন, রিকার্ডো ও ব্রিটো চারজনে থাকি।
প্রশ্ন: ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
উত্তর: হ্যাঁ। ফোনে কথা হয়। বাড়ি গেলে দেখাও হয়।
প্রশ্ন: মোহনবাগানে এলেন কী ভাবে?
উত্তর: রাঙামাটিতে অনুশীলন করার সময়ে শুনেছিলাম অনূর্ধ্ব ১৪ মোহনবাগান দলের ট্রায়াল চলছে। আমার এক সম্পর্কিত মামার হাত ধরে মোহনবাগান মাঠে আসি। সেটা ২০১১ সাল। আমার ১৩ বছর বয়স। তখন মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব ১৪ দলের কোচ অমিয় ঘোষ। এক দিন অন্তর ট্রায়াল হত। অমিয় স্যর একদিন আমায় ডেকে কোথা থেকে আসি জ্ঞিগেস করলেন। আমি বললাম। উনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, যদি চূড়ান্ত দলে সুযোগ পাও তো কোথায় থাকবে? আমি বলেছিলাম, অনুশীলন ও খেলার দিন হাওড়া স্টেশনে রাত কাটিয়ে দেব। উনি তারপরে আমায় নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। যে দিন অনুশীলন থাকত তার আগের রাতে অমিয় স্যরের বাড়িতে থাকতাম।
ধডরাশোলের এই বাড়িতেই বড় হয়েছেন পিন্টু। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: তারপর? সিনিয়র মোহনবাগানের জার্সি কবে পেলেন?
উত্তর: ২০১৫-১৬ মরসুমে। অনূর্ধ্ব ১৪ দলে খেলার পরে আমি দুর্গাপুর অ্যাকাডেমিতে কয়েক বছর ছিলাম। সেখানে ডগলাস ও আনচেরিকে কোচ হিসেবে পেয়েছি।
প্রশ্ন: অ্যাকাডেমি থেকে কী শিখেছেন?
উত্তর: শৃঙ্খলা শিখেছি। মাঠে এবং মাঠের বাইরে শৃঙ্খলা ছাড়া কিছুতেই সফলতা আসবে না। এটা আমায় মোহনবাগান অ্যাকাডেমি শিখিয়েছে।
প্রশ্ন: একজন জঙ্গলমহলের ছেলে সিনিয়র মোহনবাগানের হয়ে তিন বছর খেলছেন। জীবনযাত্রায় কোনও বদল এসেছে?
উত্তর: খেলা ও অনুশীলন না থাকলে আমি মূলত মেসেই থাকি। গান শুনি। আমার পরিবার অনেক কষ্ট করেছে। এখনও করে। আমি জানি আমার শিকড় কোথায়। তাই পা মাটিতেই আছে এবং থাকবেও।
প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত সেরা ম্যাচ?
উত্তর: মোহনবাগান অ্যাকাডেমিতে থাকাকালীন আসানসোলে একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ফাইনালে অ্যাকাডেমির মুখোমুখি হয়েছিল রয়্যাল ওয়াহিংডোর সিনিয়র দল। সেই ম্যাচে আমি গোল করেছিলাম এবং সেরা হয়েছিলাম। তারপরেই রাখব দিন কয়েক আগে টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচকে।
প্রশ্ন: প্রিয় ফুটবলার কে?
উত্তর: ছোটবেলা থেকে মেহতাব হোসেনকে খুব ভাল লাগত। বলতে পারেন উনি আমার ছোটবেলার রোল মডেল। আমার বন্ধুরাও সেটা জানে। ঘটনাচক্রে এই মরসুমে আমি মেহতাবদার সঙ্গে একদলে খেলার সুযোগ পেয়েছি।
প্রশ্ন: এবার মোহনবাগান দলে তাঁর এক ভক্ত রয়েছেন সেটা কী উনি জানেন?
উত্তর: (হেসে) না। কোনওদিন বলা হয়নি। নতুনদের মধ্যে উদান্ত সিংহের খেলা ভাল লাগে। বিদেশিদের মধ্যে আমার পছন্দ ব্রাজিলের নেমার।
প্রশ্ন: অমিয় ভট্টাচার্য এবং অমিয় ঘোষ—এই দু’জন আপনার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া কারও নাম বলবেন?
উত্তর: আমার বর্তমান কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী। উনি সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের প্রতিও সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
প্রশ্ন: জঙ্গলমহলের ফুটবলারদের দম ভাল। ফিটনেস ভাল। কিন্তু কলকাতা ময়দানে তাঁদের সেভাবে দেখা যায় না কেন?
উত্তর: উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং গাইডলাইন চাই। কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবগুলো জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় বাছাই শিবির করলে অনেক ভাল ফুটবলার পাবে। সম্প্রতি সেই কাজ শুরু হয়েছে। জঙ্গলমহলে জন্মে যে কলকাতার বড় দলে সুযোগ পাওয়া যায়, সেটা আগে কেউ বিশ্বাস করত না। খেপ খেলে টাকা রোজগার করাই ছিল কাজ। তবে আমি টানা তিন বছর ধরে মোহনবাগানে খেলার পরে ধারণা কিছুটা বদলেছে। আমি নিজে আমার পাড়ার ক্লাবের হয়ে খেলত এমন দু’জনকে মোহনবাগান অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি বলছেন জঙ্গলমহলে প্রতিভা রয়েছে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না?
উত্তর: অনেকটা তাই। ঠিকভাবে সুযোগ পেলে জঙ্গলমহল কলকাতা ময়দানের সাপ্লাই লাইন হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন: জঙ্গলমহলে মেয়েরাও তো ভাল ফুটবল খেলে। কিন্তু তাঁরা রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে মাঠে সেইভাবে জায়গা করতে পারছে না কেন?
উত্তর: আমাদের জেলায় মেয়েদের ফুটবল প্রতিযোগিতা তো খুব বেশি হয় না। স্কুল পর্যায়ের কিছু খেলা ও জঙ্গলমহল কাপ। মেয়েরা নিজেদের স্কিল দেখানোর তেমন সুযোগই পান না।
প্রশ্ন: বাবা-মা তোমার খেলা মাঠে বসে দেখেছেন?
উত্তর: মাঠে বসে দেখার সুযোগ এখনও হয়নি। আমিই বারণ করি। এত দূর থেকে আসার ধকলও তো রয়েছে। তবে মোহনবাগানের খেলা থাকলে তাঁরা টিভির সামনে বসে থাকেন। লোডশেডিং থাকলে মোবাইলে খেলা দেখেন। আমার জন্য তো আমার এলাকায় মোহনবাগান সমর্থক বেড়ে গিয়েছে (হেসে)।
প্রশ্ন: টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচে তো ভরা গ্যালারিতে আপনার নামে জয়ধ্বনি উঠেছে। কেমন লেগেছে?
উত্তর: এই অনুভূতি ভাষায় বোঝাতে পারব না। মোহনবাগান আমার কাছে সব কিছু। সবুজ-মেরুন জার্সি পড়ে মাঠে নামলে বাকি সব কিছু ভুলে যাই। এই জার্সি আমায় সম্মান দিয়েছে। জঙ্গলমহলকে সম্মান দিয়েছে।
প্রশ্ন: তোমার ফুটবলার জীবনের স্বপ্ন কী?
উত্তর: দেশের হয়ে খেলতে চাই।