রাত একটা বেজে গিয়েছে। মোহালির প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে টিম বাস। ঘণ্টা দু’য়েক আগে ভারতকে সেমিফাইনালে তোলার পরও দেখা গেল, বিরাট কোহালির কাজটা শেষ হয়ে যায়নি। বিকেলে ভারতীয় টিমের নকিংয়ের সময় কোহালির একটা ড্রাইভ এক মহিলার নাকে গিয়ে লাগে। রক্তপাত হওয়ার পর তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিরাটকে দেখা গেল, মহিলার অবস্থা নিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন।
আর আধ ঘণ্টা আগে দেখছিলাম, গোটা স্টেডিয়ামের ভিতরেও এই নামটাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমএস ধোনি তো বটেই, অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন স্টিভ স্মিথের মুখেও বারবার ঘুরেফিরে আসছিল সেই বিরাটের নামই।
বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর, পিসিএ মহাকর্তা আইএস বিন্দ্রা। কেউ বাদ গেলেন না। বিরাটে এতটাই আচ্ছন্ন মোহালি, যে সেই ঘোর থেকে যেন বেরোতেই পারছিলেন না কেউ। এমনকী ম্যাচ শেষে দেখা গেল হরভজন এসে কোলে তুলে নিলেন বিরাটকে!
আর তিনি? বিরাট কোহলি? মাঝরাতে পিসিএ স্টেডিয়াম থেকে যখন বেরোচ্ছিলেন, তখন এক ভারতীয় সমর্থক তাঁর পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বাইরে তখন রব উঠেছে, ‘কো-হা-লি, কো-হা-লি, কো-হা-লি, কো-হা-লি।’
পিসিএ-র এক শীর্ষকর্তা এই দৃশ্য দেখে মন্তব্য করলেন, ‘‘এক সময় এই পিসিএ স্টেডিয়ামের সামনে রব উঠত সচিনের নামে। আজ সেই জায়গাটা নিয়ে নিল ছেলেটা।’’ বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর পর্যন্ত মাঠে তাঁকে গিয়ে বলে এলেন, ‘তুসসি গ্রেট হো, তোফা কবুল করো’ স্টেডিয়াম থেকে বেরোতে বেরোতে সে কথাই শোনাচ্ছিলেন তিনি।
আইএস বিন্দ্রা বললেন, ‘‘ম্যাচটা কোথায় পৌঁছে দিল ছেলেটা!’’
আর বিরাট নিজে বললেন, ‘‘এই ইনিংসটা আমার সেরা তিনের মধ্যে রাখব। আর এই মুহূর্তে তো সেরা। কারণ, আমি একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। এর জন্য দর্শকদের ধন্যবাদ। ধন্যবাদ যুবিকে, ক্যাপ্টেনকেও। ওরাই আমার মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করেছে।’’
মোহালিতে রাত যত নেমেছে, তত এই বিরাট-ম্যাজিকে পাগল হয়ে উঠেছিল গ্যালারি। বিস্ময়ের পারদ চড়তে চড়তে থার্মোমিটারের বিস্ফোরণ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। সেই পাগলামির রেশ ম্যাচ শেষের দেড় ঘন্টা পরেও থাকবে না, তাই কখনও হয়?
অসাধারণ এই ক্রিকেট জাদুকরের ক্যারিশমায় তাঁর দেশের মানুষ ধন্য ধন্য করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মুগ্ধতার সীমানা ছাড়িয়ে তা যে পৌঁছে গেল বিপক্ষ শিবিরেও তা বোঝা গেল অজি ক্যাপ্টেন স্টিভ স্মিথের মুখে ঘুরেফিরে ওই একই নাম চলে আসায়।
তাঁর একটাই কথা, ‘‘কোহালির ওই অভাবনীয় ইনিংসেই ম্যাচ আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেল।’’
আর ধোনি? এত দিন তিনিই ছিলেন ভারতীয় দলের সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার ব্যাটসম্যান। চাপের মুখে তাঁর মাথা বরফশীতল থাকার প্রশংসা করেছে সারা বিশ্ব। এ বার আর একজনকে সঙ্গে পেয়ে তাঁকেও অনেক নিশ্চিন্ত মনে হল। বললেন, ‘‘এত চাপের মুখে ঠান্ডা মাথার লোকেদেরই বেশি কাজে লাগে। কারণ, এত চাপ থাকে যে প্রতি মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয়, সেগুলো ঠিকমতো না নিতে পারলে বড় ভুল হয়ে যায়। আজ আমরা ওই সময়ে দুজনেই ক্রিজে ছিলাম বলে অনেক সুবিধা হল।’’ বিরাটের ইনিংসকে এক কথায় ‘ইনক্রেডিবল’ আখ্যা দিয়ে ধোনি বলেন, ‘‘ওর জন্য আমাদের চিন্তা অনেক কমে গেল। আশা করি আরও কমবে।’’
অস্ট্রেলীয় মিডিয়াও যেমন বাকরুদ্ধ বিরাটের এমন ইনিংস দেখে। তেমনই স্মিথ নিজেও। স্মিথ এ দিন নিজেই স্বীকার করে গেলেন, ‘‘জানি না কী ভাবে বিরাট অমন পারফেক্ট শটগুলো খেলে গেল। সিরিয়াসলি অসাধারণ ইনিংস।’’ ঘুরেফিরে এই কথাটাই শোনা যাচ্ছিল তাঁর মুখে। কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না যেন।
এই আনন্দের মধ্যেও খারাপ খবর, যুবরাজ সিংহর চোট। রবিবার বাঁ পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্টেডিয়াম থেকে বেরোতে দেখা গেল তাঁকে। ধোনির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘জানি না ও পরের ম্যাচে খেলতে পারবে কি না। কাল-পরশুর মধ্যেই সেটা জানা যাবে। তবে আমাদের পরিবর্ত তৈরি আছে। যুবি খেলতে না পারলে সে খেলবে।’’ ইঙ্গিতটা সম্ভবত অজিঙ্ক রাহানের দিকে।
তবে কোনও খারাপ খবরই বোধহয় এখন ভারতীয় দলকে ভেঙে পড়তে দেবে না। পুরো ভারতীয় দলটাই যে এখন বিরাট-জাদুতে আচ্ছন্ন।