জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ।
আন্দ্রে পির্লো গিয়ে বসে আছেন নিউ ইয়র্ক সিটিতে।
স্টিভন জেরার আর ফুটবলে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
দাভিদ ভিয়া স্পেনের গ্ল্যামার ত্যাগ করে নিউ ইয়র্ক মাতাচ্ছেন।
থিয়েরি অঁরি এখন ফুটবল ছেড়ে মাইক হাতে বিশ্লেষণ দিচ্ছেন।
পেশাদার ফুটবলার হওয়ার লাভ অনেক।
সমর্থকরা তোমায় মাথায় তুলে রাখবে। ক্লাব কর্তারা রাজার মতো প্রাসাদে থাকতে দেবে। এক একটা মাসে এক একটা স্বপ্নের গাড়ি ঢুকবে গ্যারাজে।
আবার অসুবিধেও আছে।
দেখতে দেখতেই যেন মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। এক সময় তোমায় মাথায় চড়িয়ে রাখা সমর্থকরাই তখন দাবি করবে ক্লাব ছাড়তে। কর্তারা আর নতুন চুক্তি নিয়ে আসবেন না। এজেন্টের কাছে ফোনও ঢুকবে না অন্য ক্লাবের।
ফুটবলারদের সন্ন্যাস নেওয়ার মতো অবস্থা হয় তখন।
কিন্তু বর্তমানে ফুটবলাররা যেন এখন একটু দ্রুতই সন্ন্যাস নিয়ে ফেলছেন। যার পিছনে অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্র, চিনের মতো লিগের আর্থিক টান। ইউরোপীয় ফুটবলের মোহ ত্যাগ করে আগেভাগেই তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সেখানে তো থাকবে না ট্রফি জেতানোর চাপ। টাকাটা নিশ্চিতভাবেই ঢুকে যাবে মাসের প্রথমে। শেষ বয়সে পায়ের উপর পা তুলে কাটাতে পারবেন।
এঁদের মধ্যেও যে ব্যতিক্রম আছে। যিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও প্রিমিয়ার লিগের চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। যে কে সেই ক্লাবে নয়। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ফরোয়ার্ড লাইনের দায়িত্ব তাঁর উপর। ভার বইছেন কয়েকশো কোটি ম্যান ইউনাইটেড সমর্থকের প্রত্যাশার। মরসুমের শুরুতে যাঁকে সই করিয়ে কম কটাক্ষ সহ্য করতে হয়নি জোসে মোরিনহোকে। কিন্তু তাঁর গোলগুলো আজ পুনর্জন্ম দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের। প্রমাণ করছে, প্রতিভার সামনে বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। তিনি— জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ। যিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিচ্ছেন।
বক্সিং ডে-তে গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় দু’নম্বরে রয়েছেন ইব্রা। সান্ডারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ নিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে বারো গোল করেছেন সুইডিশ মহাতারকা। কিন্তু সেটা তো নিছক পরিসংখ্যান। তার পিছনে থাকা পরিশ্রমের কথা তো সেই পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না।
ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখা যাবে, আজও এই বয়সে মারাত্মক রকমের ডায়েট কন্ট্রোল করেন সুইডিশ স্ট্রাইকার। ব্যক্তিগত ফিজিও আছে। কোনও রকম ঘাটতি থাকে না ট্রেনিংয়ে। কার্ডিও থেকে জিম, সব কিছুই নিয়ম মেনে করেন।
ইব্রা-বিপ্লবের পিছনে আসল যে কারণটা উঠে আসছে, সেটা হল— ফিটনেস।
মোহনবাগানের ফিজিও জায়ের মিরান্ডা গার্সিয়াও মনে করেন, বয়স্ক ফুটবলারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডায়েট সামলানো। ‘‘আমি এমন অনেকজনের ফিজিও ছিলাম যারা অনেক বেশি বয়স অবধি খেলেছে। জিম বা কার্ডিও মিশিয়ে তখন সূচি তৈরি করতাম। আরও বেশি জরুরি ছিল ডায়েট। কোনও রকম ড্রিঙ্ক যাতে না করে দেখতে হবে। খাবারটা বুঝে খেতে হবে। ফ্যাট জাতীয় কিছু নয়,’’ বললেন গার্সিয়া।
মেসি, রোনাল্ডোরা যেখানে চোট পেয়ে সাইডলাইনে সময় কাটিয়েছেন, ইব্রা কিন্তু এই মরসুমে সমানতালে খেলে যাচ্ছেন। গার্সিয়া বললেন, ‘‘এক জন ফুটবলারের আসল জিনিস শৃঙ্খলা। দিনে অন্তত অর্ধেক সময় ট্রেনিংয়ে থাকতে হবে। বয়স্ক ফুটবলারদের ক্ষেত্রে আরও বেশি। জে রবার্তোর উদাহরণ যেমন দেওয়া যায়। চল্লিশ বছর বয়সেও খেলে যাচ্ছে। এটা নির্দিষ্ট প্ল্যান না মেনে চললে হয় না।’’
ফিটনেস তো গেল একদিকে। ইব্রা তো গোলটাও সমানতালে করে যাচ্ছেন। সঠিক সময় সঠিক জায়গায় থাকার প্রবণতা আজও হারিয়ে যায়নি। প্রতিটা ম্যাচেই তাঁর গোল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডকে মরসুমে নতুন প্রাণ যোগাচ্ছে। স্ট্রাইকার হিসেবেও তো এখনও সমান ধারালো তিনি। প্রিমিয়ার লিগের ফিজিকাল ফুটবলের সঙ্গে মানাতে পারেন না বহু প্রতিভাবান ফুটবলার। কিন্তু ইব্রা আর থামছেন কোথায়! মোহনবাগানের সবুজ তোতা জোসে ব্যারেটো বললেন, ‘‘স্ট্রাইকারদের যত বয়স বাড়ে তত বেশি তারা পজিশনিংয়ের ক্ষেত্রে নিঁখুত হয়। ম্যাচ রিডিং ক্ষমতাও বাড়ে। ইব্রাহিমোভিচের সেই ক্ষমতা আছে। আজও অনুমান করতে পারে কোথায় বলটা আসবে। আর উচ্চতাটা পুরোপুরি কাজে লাগায়। তাই এত গোল পায়। কিন্তু সঙ্গে ফিটনেসটাও বড় ফ্যাক্টর। টপ লিগে খেলতে হলে ট্রেনিংটাই আসল।’’
ইব্রা এমন একজন আর্টিস্ট যাঁর গোল করার ক্ষমতা যেমন আছে, তেমন স্কিলও। তাই তো আজও বুড়ো হাড়ে জোর আছে স্করপিয়ন কিক বা প্রোপেলারের মতো বিস্ময় গোল উপহার দেওয়ার। ‘‘ইব্রাহিমোভিচের স্কিল দারুণ। ও স্ট্যান্ডিং পজিশন থেকেও অস্বাভাবিক কিছু করতে পারে। বলের উপর কন্ট্রোলও দারুণ। ভিড়ের মধ্যেও ঠিক ধরে রাখে বলটা,’’ বললেন ব্যারেটো। লা লিগা থেকে ফরাসি লিগ। ডাচ লিগ থেকে ইতালীয় সেরি এ। ইউরোপের প্রতিটা নামী লিগে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন ইব্রা। ব্যারেটোর সংযোজন, ‘‘বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের মধ্যে একজন। ভাল মতো জানে চাপ সামলাতে। বার্সেলোনা, ইন্টার মিলান, জুভেন্তাস, এসি মিলানে খেলা স্ট্রাইকার অবশ্যই অভ্যস্ত বড় লিগের চাপ সামলাতে। সেটাই সাহায্য করছে।’’
বারোটা প্রিমিয়ার লিগ গোল। সতেরোটা সব মিলিয়ে। ম্যান ইউনাইটেডও নতুন চুক্তি নিয়ে তৈরি। তাই তো ইব্রার পাশে ট্যাগলাইনটা চোখ বন্ধ করে বসানো যায়— ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।