অ্যাডিলেড ওভালের বিরাট-রাজে মর্যাদা রক্ষিত হাজারে উত্তরাধিকারের

চ্যানেল নাইনের স্টাম্প মাইক্রোফোন থেকে এল আওয়াজটা? নাকি মাঠ থেকে সরাসরি প্রেসবক্স পৌঁছল? জানি না। কিন্তু খুব জোর হল— ঘটাং!সহমর্মিতার একটা বৃত্ত মুহূর্তে ঘিরে ধরেছে তাঁকে। প্রাক ফিলিপ হিউজ অধ্যায়ে যা কল্পনাই করা যেত না। বিরাট কোহলি সত্যিকারের মাচো। অনুষ্কা শর্মার জগতের অনেক নায়কের মতো স্টান্টম্যান দিয়ে শট দেন না। আর বিরাটদের দুনিয়ায় সেই উপায়ও নেই। ওই প্রচণ্ড আওয়াজওয়ালা ঘা হেলমেটে খেয়েও দাঁড়িয়ে রইলেন। মাথায় একবার হাত অবধি বোলাতে দেখলাম না।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৩
Share:

চ্যানেল নাইনের স্টাম্প মাইক্রোফোন থেকে এল আওয়াজটা? নাকি মাঠ থেকে সরাসরি প্রেসবক্স পৌঁছল? জানি না। কিন্তু খুব জোর হল— ঘটাং!

Advertisement

সহমর্মিতার একটা বৃত্ত মুহূর্তে ঘিরে ধরেছে তাঁকে। প্রাক ফিলিপ হিউজ অধ্যায়ে যা কল্পনাই করা যেত না। বিরাট কোহলি সত্যিকারের মাচো। অনুষ্কা শর্মার জগতের অনেক নায়কের মতো স্টান্টম্যান দিয়ে শট দেন না। আর বিরাটদের দুনিয়ায় সেই উপায়ও নেই। ওই প্রচণ্ড আওয়াজওয়ালা ঘা হেলমেটে খেয়েও দাঁড়িয়ে রইলেন। মাথায় একবার হাত অবধি বোলাতে দেখলাম না।

কিন্তু তিনি নিজে নিজের শুশ্রূষা করতে বাধা দিলে কী হবে, প্রথম বলেই ভারত অধিনায়কের এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়াটা মাঠে তখন একটা অদ্ভুত আবেগ তৈরি করেছে। এ যেন ভরা শ্রাদ্ধবাসরের মধ্যে কাউকে আবার অতর্কিতে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলতে হবে কি না এমন উদ্‌ভ্রান্ত জটলা।

Advertisement

ঘটাং— শব্দটা নিমেষে যেন ছেষট্টি বছর পেছনে নিয়ে ফেলল দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অশীতিপর সদস্যকে! প্রেসবক্সের ঠিক পেছনেই অস্ট্রেলিয়ার প্রাইভেট রেডিও স্টেশন তাঁকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য এ দিন নিয়ে এসেছিল। ফোনে সিডনিতে বসা নিল হার্ভিকে ধরতে না পারায় তাদের তখুনি দরকার ছিল ভারতের প্রথম অ্যাডিলেড টেস্ট খেলতে দেখা কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর। ভদ্রলোক আনন্দবাজারে দাবি করলেন, তিনি সেই সময়কার প্রবাদপ্রতিম স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেটের আত্মীয়। ভারতের প্রথম অ্যাডিলেড অবতরণ যখন ঘটছে, গ্রিমেট তত দিনে ক্রিকেট ছাড়তে বাধ্য হয়ে ঘোর অবসর জীবনে। কিন্তু সেই টেস্ট ম্যাচটা প্রাণ ভরে দেখেছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্যের জোড়া সেঞ্চুরির জন্য!

ভারত অধিনায়ক হিসেবে জীবনের প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বে কোহলি যে দু’জনকে এ দিন স্পর্শ করলেন তার প্রথম জন বিজয় স্যামুয়েল হাজারে! প্রবীণ সদস্য যা বলে গেলেন তার সারমর্ম হল: এখনকার ছেলেরা পাওয়ারের ওপর খেলে। টেকনিক বলে কোনও বস্তু নেই। নইলে এই কোহলি যার বিশ্বজুড়ে এত নাম সে কখনও মাথায় খায়! ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন, হাজারে ওই ম্যাচে লিন্ডওয়াল-মিলারকে আঢাকা উইকেটে খেলেছিলেন। যখন বাউন্সার-বিমারের সংখ্যার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মাথা কেন, গায়ের একটা জায়গাতেও বল না লাগিয়ে করেছিলেন ১১৬ আর ১৪৫। দু’বারই যখন ব্যাট করতে নামছেন পরিস্থিতির প্রচণ্ড চাপ। তার ওপর কভারে নিল হার্ভি, স্লিপে লিন্ডসে হ্যাসেট। আর মিড অনে স্বয়ং তিনি ব্র্যাডম্যান। সেই সব সামলে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পর এখনকার ড্রেসিংরুমের এলাকায় বসে থাকা গ্রিমেট নাকি লাফিয়ে ওঠেন। কয়েকটা ব্যাটিং টিপস তিনি হাজারেকে দিয়েছিলেন, সেগুলো খেটে গেল দেখে এত ফূর্তি। লোকে অবশ্য মনে করেছিল আরও একটা কারণও আছে। গ্রিমেটের শত্রু ব্র্যাডম্যানের বিরুদ্ধে যেহেতু রানগুলো করা! ভারতে আজ কোটলা মাঠে গেলে কেউ গাওস্কর-কপিল পুরনো বিরোধ নিয়ে আলোচনাই করবে না। সৌরভ-দ্রাবিড় নিয়েও কথা তুলবে না। অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলোয় কিন্তু অনবরত ক্রিকেট চর্চা আর প্রাচীন ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার অদ্ভুত পরম্পরা রয়েছে। গ্রিমেট-ভিক্টর রিচার্ডসনের বেনিফিট ম্যাচ সেই কোন যুগে হয়ে যারা টাকা দিয়েছিল এবং যারা পেয়েছিল সবাই মরে ভূত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সরস চর্চা আর শেষ হয় না।

প্রবীণের মুখেই শুনলাম যে গ্রিমেট খুব ক্যাটক্যাট করে কথা বলতেন। কূটনীতির কোনও ব্যাপারই ছিল না। একবার এমনও বলে বসেন যে, ডনকে তিরিশ সালে ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার সময়ে জাহাজে তিনি অমূল্য কিছু ব্যাটিং টিপস দিয়েছিলেন। যা সেরা ছাত্রের মতো ডনকে পরীক্ষায় দারুণ নাম্বার পাইয়ে দেয়। এ হেন গ্রিমেট যে ব্র্যাডম্যানের ক্যাপ্টেন্সিতে বেশি দিন খেলবেন না জানাই কথা। নাথন লিয়ঁ টাইপের মধ্যবিত্ত স্পিনার দিয়ে ব্র্যাডম্যান কাজ চালানো শুরু করেন। বিদেশের সিরিজে ৪৪ উইকেট নিয়েও গ্রিমেটকে বসিয়ে দেওয়া হয়। এর পর টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচে খুব দ্রুত ব্র্যাডম্যানকে বোল্ড করে দেন গ্রিমেট। যা দেখে ইয়ান চ্যাপেলদের দাদু ভিক্টর রিচার্ডসন উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, এটা কী করলি? ডন আউট মানে আমাদের তো অনেক ডলারের ক্ষতি হয়ে গেল রে। লাঞ্চের পর মাঠে কেউ ঢুকবে না। গ্রিমেটের মুখে কোনও অনুতাপের ছায়া নেই, “আমায় বাদ দেওয়ার আগে বলেছিল টার্ন করাতে পারি না আজকাল। সেটাই ওকে দেখালাম।”

সেই আমলের গ্রিমেটের মতো আজকের কোহলিও কি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না ক্রিজে থেকে? যতই বলুন লাগেনি— লেগেছে তো বটেই। নইলে ওই আওয়াজ হয়! ইংল্যান্ডে পাঁচ টেস্ট ম্যাচ সিরিজে মাত্র ১৩ গড় নিয়ে শেষ করাটা নিশ্চয়ই এখন মাথায় আরও খেলবে। পরিস্থিতির চাপও অসহনীয়। মিচেল জনসন এই ব্যাটিং ট্র্যাকেও এমন গতি বাড়িয়ে বল করছেন যে সেটা দেখার সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হচ্ছে, গাব্বা উইকেটে তা হলে এঁকে নিয়ে কী করা? কুড়ি হাজার দর্শক তারস্বরে ব্যারাকিং করছে। মাইকেল ক্লার্ক ক্রমশ ফিল্ডার সামনে এনে চাপ বাড়াচ্ছেন। লোকে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ছে মাঠে বিক্রি হওয়া সব খুদে ট্রানজিস্টরে চ্যানেল নাইন কমেন্ট্রি শুনে। ভারতে একেবারেই চল নেই। কিন্তু এখানে টিভি কমেন্ট্রি রেডিওতে শুনে একই সঙ্গে খেলা দেখার মারাত্মক প্রবণতা রয়েছে। আর চ্যানেল নাইন এই মূহূর্তে পক্ষপাতদুষ্ট বললে কম বলা হয়। শিবসেনা যদি স্টার স্পোর্টসে ভারত-পাক ম্যাচ প্রোডাকশনের সুযোগ পায়, তা হলে যা হবে তা-ই। নাথন লিয়ঁ বিশ্বের এক নম্বর স্পিনার। ক্লার্ক বিশ্বসেরা ক্যাপ্টেন এবং এক নম্বর ব্যাটসম্যান দুটোই। ভারত এখুনি ফলো অন খেল বলে। মাঠে কোহলি ব্যাট করছিলেন এই সব প্রচার থেকে তৈরি হওয়া টাটকা সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধেও।

কিছু মাস আগে যাঁর কাছে অ্যাডিলেডের ভারত অধিনায়ক তাঁর ব্যাটিং রোগ সারাতে গেছিলেন, এর পর এসএমএস করলাম তাঁকে। তিনি মোটেও দিল্লির রাজকুমার শর্মা নন। মুম্বইয়ের বেঁটেখাটো কোনও মরাঠি। ওই চাপের মুখে চিত্‌কার হচ্ছে কাম অন অজি, কাম অন। তাঁকে টেক্সট না করে পারলাম না— চার নম্বরে আপনি নেই অস্ট্রেলিয়ায় এটার সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারছি না। বাইশ বছরের অভ্যেস তো। উত্তরে কোহলির প্রশংসাসহ কী এল সেটা প্রয়োজনীয় নয়।

প্রয়োজনীয়, যে বিপন্নতার সীমাহীন মাত্রার বিরুদ্ধেও ব্যাট করছিলেন কোহলি। শুধুই মিচেল জনসনের বিরুদ্ধে নয়, রায়ান হ্যারিসের বিরুদ্ধেও নয়। যে পেস বোলিং জুড়ির অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে সবচেয়ে ভাল স্ট্রাইক রেট। এমনকী লিলি-টমসনের চেয়েও ভাল। তাঁদের দারুণ সামলালেন ভারতীয়রা। ইনিংসের শুরুতে ধবন। পূজারা। এবং আরও বেশি করে মুরলী বিজয় হাত খুলে মেরে গেছেন। কখনও মনেই হচ্ছিল না এঁরা ভারতীয় ক্রিকেটের জেনারেশন ওয়াই যাঁরা পাঁচশো রানের বিরুদ্ধে পড়েও বরুণ অ্যারনের মতো চোক করে যেতে পারেন বলে। নির্ভার স্ট্রোক প্লে-র একটা মেজাজ লাগে। সেই মেজাজটা ধরা কিন্তু সমস্যা করছে জনসনের সাংঘাতিক স্পেলগুলো। আর রাউন্ড দ্য উইকেট বল করতে এসে ভারতীয় পেসারদের তৈরি ফুটমার্কস। ওটাতেই তো বল ফেলে সময়-সময় ত্রাস সৃষ্টি করছেন লিয়ঁর মতো মাঝারি বোলার।

কোহলিকে দেখে একবারও মনে হল না কোনও ভ্রুক্ষেপ আছে বলে। এ মাঠেই রাহুলের ডাবল দেখেছি। ব্যাটসম্যানশিপের জাত হিসেবে আরও উচ্চাঙ্গের। কিন্তু কোহলির ইনিংসটা আরও জ্বলন্ত চাপের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়ান উইকেটে রান করার জন্য ব্যাকফুট দরকার। পুল শটটা দরকার। কোহলির দুটোই রয়েছে তাই তাঁর রানের গতি এত চাপেও থামানো শক্ত। ভারত দিনে ওভার পিছু চার রান করে গেল। পরিস্থিতি বিচারে যা অকল্পনীয়। মাইকেল ক্লার্ক সাত বোলার ঘুরিয়ে ফিরিয়েও ইনিংসটা ভাঙতে পারেননি। অজিঙ্ক রাহানের ইনিংসটাকে ইয়ান চ্যাপেল ‘কুত্‌সিত’ আখ্যা দিলেন। চ্যাপেল এত বার ভারতে এসেও জানেন না ওটাকে ভারতীয় ভাষায় কুত্‌সিত বলে না। বলে খারুশ। লড়ে পড়ে থাকো। পারো বা না পারো। ঋদ্ধিমান অবধি মিচেল জনসনের কড়া ডেলিভারি কাঁধে নিয়েও লড়াই চালিয়ে গেলেন। এই নাছোড় মনোভাবটাই ছিল বিষ্যুদবারে কোহলির ভারত।

প্রেস লাউঞ্জে খেলার শেষ দিকে দেখা হয়ে গেল ব্রেট লি আর ম্যাকগ্রার সঙ্গে। এক জনের হাতে বল। মাঠে কোনও প্রচারধর্মী কাজ করে ওপরে উঠলেন এখনই। আর এক জন তিনি ম্যাকগ্রা সেই রেডিও বক্স থেকে বেরোচ্ছেন যেখানে হাজারে ইনিংসের প্রত্যক্ষদর্শী অশীতিপরকে আনা হয়েছিল। ম্যাকগ্রাই তো পূর্বাভাস করেছিলেন সিরিজ ৪-০ হবে। এখন কী ভাবছেন, জানা গেল না। তবে দু’জনকেই দেখে মনে হল ঠোঁট চাটছেন। চোখের সামনে এত বড় সুযোগ বেরিয়ে যাচ্ছে দেখেও হাতে লাল বল নেওয়ার উপায় নেই তাঁদের। তাঁরা যে এখন অবসৃত।

হেলমেটে প্রথম বল লাগাটা যদি ঘটাং আওয়াজসম্পন্ন হয়— ম্যাকগ্রা-লি-র হতাশ ভাবভঙ্গিও ঘটাং। তবে প্রত্যুত্তরের। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্রত্যাঘাত সেঞ্চুরির পর কোহলি এখন আর অশীতিপরের কৃপার পাত্র হবেন না।

বরং হাজারে ওপরে বসে নিশ্চয়ই বিরাট গর্ব করছেন তাঁর উত্তরাধিকার বিরাট-রাজ নিয়ে!

অস্ট্রেলিয়া

প্রথম ইনিংস: ৫১৭/৭ ডি.।

ভারত

প্রথম ইনিংস

মুরলী ক হাডিন বো জনসন ৫৩

ধবন বো হ্যারিস ২৫

পূজারা বো লিয়ঁ ৭৩

কোহলি ক হ্যারিস বো জনসন ১১৫

রাহানে ক ওয়াটসন বো লিয়ঁ ৬২

রোহিত ব্যাটিং ৩৩

ঋদ্ধিমান ব্যাটিং ১

অতিরিক্ত ৭।

মোট ৩৬৯-৫ (৯৭ ওভারে)।

বোলিং: জনসন ১৮-৫-৯০-২, হ্যারিস ১৭-৫-৪৯-১, লিয়ঁ ৩০-৩-১০৩-২,

সিডল ১৩-২-৬২-০, মার্শ ১১-৪-২৯-০, ওয়াটসন ৫-১-১৩-০, স্মিথ ৩-০-১৯-০।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement