তারকাদের পিছনে ফেলে তাক লাগালেন জম্মুর তরুণ

অর্জুনের ফেরার লড়াই এখন বাকিদের প্রেরণা

ধূসর-সাদা ডোরাকাটা টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার্সে ছ’ফুট এক ইঞ্চির পেটানো চেহারাটা এগিয়ে আসছে দেখেই নিমেষে আঠারো নম্বর গ্রিন ঘিরে থাকা পাতলা ভিড় রীতিমতো জমায়েতের চেহারা নিল। উত্‌সাহীদের মধ্যে সবচেয়ে নিবিষ্ট ভাবে তাকিয়ে কালো নীল হাতকাটা জ্যাকেটের প্রৌঢ়। সাদা চুল-দাড়ি।

Advertisement

মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ধূসর-সাদা ডোরাকাটা টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার্সে ছ’ফুট এক ইঞ্চির পেটানো চেহারাটা এগিয়ে আসছে দেখেই নিমেষে আঠারো নম্বর গ্রিন ঘিরে থাকা পাতলা ভিড় রীতিমতো জমায়েতের চেহারা নিল। উত্‌সাহীদের মধ্যে সবচেয়ে নিবিষ্ট ভাবে তাকিয়ে কালো নীল হাতকাটা জ্যাকেটের প্রৌঢ়। সাদা চুল-দাড়ি। দাঁড়ানোর আড়ষ্ট ভঙ্গি থেকে আন্দাজ করা যায়, ঘাড়ে ব্যথা। জনতার উত্‌সাহের কেন্দ্রের মানুষটি বার্ডির সুযোগ ফস্কাতেই বলে উঠলেন, “এহ! আবার!” হরমিন্দর সিংহ অটওয়াল এর পর মৃদু অপছন্দের মাথা নেড়ে যোগ করলেন, “পাটিংটা একদমই হচ্ছে না।”

Advertisement

দিনের শেষে বাবার সঙ্গে একমত অর্জুন অটওয়াল। “ক্লোজ পাটিং নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। দেখা যাক, সবে তো প্রথম দিন!” অবশ্য ক্রিসমাসের দিন পার ৭২ স্কোর দিয়ে ম্যাকলিয়ড রাসেল ট্যুর চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করলেও খোশমেজাজেই মাত্র দশ দিন আগের দুবাই ওপেন চ্যাম্পিয়ন। কলকাতার শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে দেখা হতেই মুচকি হেসে বললেন, “তুমি এক ওভার স্কোর করেছ। মানে আজ তোমাকে হারিয়েছি!”

অর্জুন অসাধারণ বোঝাতে ‘অ্যসাম’ শব্দটা খুব ব্যবহার করেন। যেমন আরসিজিসি-র সবুজ কোর্সের বর্ণনা দিতে গিয়ে। আবার দিনের শেষে আট-আন্ডার ৬৪ স্কোরে শীর্ষে থাকা আঠারো বছরের শুভঙ্কর শর্মা সম্পর্কেও বললেন ‘অ্যসাম’। জম্মু-কাশ্মীরের শর্মা পরিবার এখন দিল্লির বাসিন্দা। সেনাবাহিনীর কর্নেল, বাবা মোহনলাল শর্মার হাত ধরে মাত্র ছ’বছর বয়সে উটির গল্ফ কোর্সে গিয়ে প্রথম গল্ফ ক্লাব হাতে তুলে খেলাটার প্রেমে পড়েছিলেন শুভঙ্কর। যাঁর নামকরণ ‘১৯৪২: এ লাভ স্টোরি’-র জ্যাকি শ্রফ অভিনীত বিপ্লবী চরিত্রের নামে। সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অনুরাগী পরিবারের ছেলের গল্ফই ধ্যানজ্ঞান। পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র গতবছর এই আরসিজিসি-তেই সর্বভারতীয় অপেশাদার খেতাব জেতার পর পেশাদার হন। এপ্রিলে মাত্র সতেরো বছর বয়সে কোচির টুর্নামেন্টে পিজিটিআই-এর সবচেয়ে কমবয়সি চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।

Advertisement

বড়দিনেও ভারতীয় গল্ফের নক্ষত্র সমারোহের মাঝে ন’টি বার্ডি করে প্রচারের সব আলো কাড়লেন নতুন তারা। অর্জুন তো বলেই দিলেন, “মাত্র আঠারোয় এই রকম খেলা! অসাধারণ!” তরুণ তুর্কির মাথা অবশ্য একদম ঠান্ডা। একদিন মেজর জেতার স্বপ্ন দেখা শুভঙ্কর বললেন, “এত ভাল শুরু আশা করিনি। কোর্সটা চেনা থাকায় সুবিধে হল। তবে গল্ফে প্রত্যেকটা দিনই কিন্তু নতুন দিন।” টাইগার উডসের ভক্ত উডসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়েও রীতিমতো আপ্লুত। বলছিলেন, “অর্জুনের কাছে পিজিএ ট্যুরে উইন্ডহ্যাম টুর্নামেন্ট জেতার গল্প শুনলাম। কত অভিজ্ঞতা! খুব সাহায্যও করেন।”

তেরো বছর পর নিজের হোম কোর্সে অজুর্নের প্রত্যাবর্তনের প্রথম দিনটা ‘অ্যসাম’ না হলেও রাহিল গাঙ্গজি থেকে গগনজিত্‌ ভুল্লার, সবার মুখেই শুভঙ্করের কথার প্রতিধ্বনি। কব্জির চোটে গত ক’মাস মাঠের বাইরে থাকা গগনজিত্‌ যেমন বললেন, “চোট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অর্জুনের পরামর্শ খুব কাজে দিয়েছে।” গত বারের রানার্স রাহিল আবার বলছিলেন, “অর্জুন অসাধারণ মানুষ। গল্ফের একটা নতুন দিগন্ত খুলে যায় ওঁর সঙ্গে কথা বলে। নিজের খেলা নিয়ে অনেক সংশয় দূর হয়ে যায়।” ভারতীয় গল্ফাররা চাইছেন এশীয় ট্যুরে আটটি খেতাবের মালিক আগামী মরসুমেও এশীয় ট্যুরে খেলুন।

অর্জুনের নিজের পাখির চোখ অবশ্য পিজিএ ট্যুরের কার্ড ফিরে পাওয়া। ফ্লোরিডায় ফিরে যোগাসন আর রিহ্যাবে পুরো ফিটনেসে ফিরতে চান। বললেন, “এখনও ড্রাইভটা আগের তুলনায় সতেরো গজ কম যাচ্ছে। একচল্লিশের শরীরে রোজই কোথাও না কোথাও টনটন করে। এগুলো সারাতে হবে।” তার পর যোগ করলেন, “একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাবিনি পিঠ আর কোমরের চোট সারিয়ে আবার খেলব। শুধু আমার বউ লড়াইটা ছাড়তে দেয়নি। সারাক্ষণ বলেছে, তুমি আবার ফিরবেই। আজ মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস ও চাপটা দিয়ে গিয়েছিল!”

স্ত্রী রিতিকা এবং দুই ছেলে কিষেণ আর শিবকে নিয়ে আপাতত কলকাতার বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছেন। তবে এ দিন আরসিজিসির ধাত্রীগৃহে ফেরাটা বেশ আবেগজড়ানো ছিল। বাবা ছাড়াও ভাই গোবিন্দ এসেছিলেন। যেন অর্জুনের হাতে গল্ফ ক্লাব ফেরত আসাটাই বিরাট প্রাপ্তি। হরমিন্দর বলছিলেন, “অর্জুন যে দিন এখানে প্রথম খেতাব জিতল, আমি হাতে জপমালা নিয়ে এসেছিলাম। মনে আছে, সতেরো নম্বর হোল-এ পৌঁছে ওর জয় নিশ্চিত হওয়ায় তবেই জপ থামিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলি।”

এ দিনও কি মনে মনে সেই মালাটাই জপে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন