স্যর ফ্র্যাঙ্ক ওরেল! নামটা বার্বেডোজের বাইরে এই মহাদেশেও এত সম্মানিত যে, কালেভদ্রে সেই অভিজ্ঞানের সঙ্গে অস্ট্রেলীয়রা কোনও তুলনা টানে।
২০১৪-’১৫-র অস্ট্রেলিয়া সফরকারী ভারত দেখা যাচ্ছে ব্যতিক্রম! অ্যাডিলেডের চতুর্থ ইনিংসে ফ্র্যাঙ্ক ওরেল সদৃশ মনোরঞ্জক ক্রিকেট খেলে আলোচনায় আসার পর এ বার আবার ব্রিসবেনে পরের টেস্টের প্রথম দিন। পারথ যদি অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের পেন্টাগন হয়। গাব্বা হল হোয়াইট হাউস। সেখানে খেলতে এলে বিজিত হয়ে ফিরতে হবে, এটাই নিদান। যার গুমোর ব্যাগি গ্রিন এ মাঠে গত ছাব্বিশ বছর অপরাজিত থাকায় আরও বেড়েছে। বুধবারই একটা অদ্ভুত দিন যেখানে সফরকারীরা টেস্টের প্রথম দিনেই সেই রানটা তুলেছে যা নিদান অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার করার কথা। মাত্র চার উইকেটে ৩১১! রান আরও উঠত— স্টিভ স্মিথরা সাত ওভার বল কম না করলে।
রেকর্ড বলছে গাব্বা মাঠে গত পঞ্চান্ন বছরে কোনও সফরকারী দল তিনশোর ওপর করেনি। শেষ সেই ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যে টেস্টের পরিণতি টাইয়ে থেমেছিল! আবছা শীত পড়া কলকাতা যখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয়ার প্রহরে, বিষ্যুদবারের সেই ঊষাকালেই মনে হচ্ছে ব্রিসবেন টেস্টের ভাগ্যরেখা ফুটে উঠবে! ধোনির ভারত যদি পাঁচশো পৌঁছবার উপক্রম করে ব্রিসবেন টেস্টের পাসওয়ার্ড তা হলে তাদের হাতে চলে যাওয়া উচিত!
অস্ট্রেলিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মিচেল জনসনকে দিয়ে। গাব্বার ভালচার এন্ডটাই জনসনের প্রিয় বোলিং এন্ড। আর ঐতিহাসিক ভাবে এই প্রান্ত থেকেই শকুনের মতো ছোঁ মেরে তিনি উইকেটগুলো তোলেন। গত বার ইংল্যান্ডকে ভেঙেছিলেন নয় উইকেটে। প্রথম দিনও অন্তত দু’গজ গতি বাড়িয়ে বল করলেন। ফিল হিউজের স্মৃতিতে অস্ট্রেলীয়রা আদৌ টেস্ট সিরিজে বাউন্সার দেবে কি না, বা দিলে কমাবে এই সব কত কথা হচ্ছিল।
এ দিন জনসন এবং বাকিদের দেখে মনে হল, হিউজ বোধহয় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতেন! মুরলী বিজয়-শিখর ধবন তিন বছর পর বিদেশে ওপেনিং উইকেটে ভারতের হয়ে পঞ্চাশ তুললেন। তাঁদের অবিচলিত দেখে বোলার এবং মার্ক টেলরের হাতে এ দিন সকালে ক্যাপ্টেন্স ব্লেজার উপহার পাওয়া নতুন অধিনায়কের বোধহয় নার্ভ ফেল করে গেছিল। নইলে একটা সময় মনে হচ্ছিল এঁদের মন্ত্র হল— রণে বনে জলে জঙ্গলে এবং ক্রিকেটমাঠে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও। আমি মানে শর্ট বল!
কিন্তু বলটা করবে কে? সাঁইত্রিশ ডিগ্রি গরমে বল করতে নেমে আধ্ধেকই এমন অসুস্থ যে, খেলার পর অজি ফিজিওকে তীব্র বিদ্রুপ করলেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা। বললেন, গুড জব মেট। অ্যালেক্স কনটুরিস কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আচ্ছা কাল তোমার কাছে জনসন কখন আল্ট্রাসাউন্ড নিতে আসছে? ফিজিও বললেন, “কাল সন্ধের আগে ওকে সময় দিতে পারব না। মিচেল মার্শ আছে। স্টার্ক আছে। হ্যাজলউড আছে।” শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই। ফিজিও তখন হাঁ করে দেখছেন।
অস্ট্রেলিয়ার মত চূড়ান্ত ফিট টিম এ ভাবে টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিন কাতরাচ্ছে, সচরাচর দেখাই যায় না। তারা দুটো সহজ ক্যাচও ছাড়ল। দুটোই শন মার্শ। দুটোতেই বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির নাম মুরলী বিজয়। কিন্তু ওই দুটো চোনা বাদ দিলে দারুণ ব্যাট করলেন বিজয়। বিদেশে ভারতীয় ওপেনারের এত ভাল ব্যালান্স। অফস্টাম্পের বাইরে এত চমত্কার বল ছাড়া— বহু বছর পর চোখে পড়ছে। গত ইংল্যান্ড সিরিজ থেকেই ধারাবাহিক ভাল খেলছেন বিজয়। আজকের ওই গরমে যখন এত ফিট বিপক্ষও বারবার শুয়ে পড়ছে, তখন তিনি সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি ক্রিজে কাটালেন।
খুব সহজ স্ট্র্যাটেজি ছিল ভারতের— শর্ট বল ছেড়ে দাও যাতে আকাশে পেঁজা তুলোভরা মেঘের মতো উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে যায়। ফুলার লেংথ পেলেই মারো। সেই শর্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকল ভারতের ইনিংস।
নাথন লিয়ঁকে দিয়ে কুড়ি ওভার বল করানো হল প্রথম দিন। আশ্চর্য তো নিশ্চয়ই। শেন ওয়ার্নও গাব্বার প্রথম দিনে ক’বার কুড়ি ওভার বল করেছেন, সন্দেহ। লিয়ঁকে খেলার সময় বিজয়রা মনে হল পলি উম্রিগড়ের সেই সাবেকি পরামর্শ অনুসরণ করলেন। যা পলি বহু বছর আগে দিয়েছিলেন গাওস্করকে: বিদেশে স্পিনার হচ্ছে অমৃতের মতো। কিন্তু অমৃত পেয়ে এমন ভাব দেখিও না যে, গলে গ্যাছো। তা হলেই ক্যাপ্টেন তুলে নেবে। বরঞ্চ অ্যাক্টিং করে দু’একটা বিট হয়ে যেও। যেন অসুবিধে হচ্ছে। ওভারে চার-পাঁচ করে তুলবে। বেশি লোভ কোরো না। মনে রাখবে, ও যতক্ষণ আক্রমণে থাকবে তত ভাল। তা বিজয় ক্লান্ত হয়ে সেই লিয়ঁকেই উইকেট দিলেন। তার আগে অবশ্য যা দোয়ানোর ছিল হয়ে গেছে।
মুরলী বিজয়ের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নানান কাহিনি এ দিক-ও দিকে চলে। যার মোদ্দা কথা, তিনি হলেন খাঁটি আইপিএল প্রজন্ম। গতি ভালবাসেন। ভালবাসেন ফাস্ট লাইফও। চলতি সফরে কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে জীবনযাত্রা বদলেছেন। নিজের মধ্যে একটা টলটলে দিঘির শান্ত ভাব তৈরি না করতে পারলে কোনও টেস্ট ওপেনার নাগাড়ে এই সব ইনিংস খেলতেই পারবেন না! তাঁর পাঁচটা সেঞ্চুরির চারটেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। তবে আজকেরটা বেশ মজার ছিল। গাব্বা সেঞ্চুরির পর সৌরভের লাফিয়ে ব্যাট তোলাটা বঙ্গ ক্রিকেটের অমর এক ফ্রেম। আজকের ইনি তো ব্যাটই তোলেননি প্রথমে। সবাই ভাবছে কী হল? এ তো ব্যাটই তুলছে না। তার পর দেখা গেল নন-স্ট্রাইকার অজিঙ্ক রাহানে এগিয়ে গিয়ে কিছু বললেন। বিজয় তাকালেন স্কোরবোর্ডের দিকে। তার পর ব্যাট তুললেন। খেলার পর মজাই লাগল তাঁর কথা শুনে যে, “আগেরটায় ৯৯ করে আউট হয়েছিলাম বলে ভয়ে বোর্ডে নিজের রান দেখিনি।” উত্তরটা থেকেও পরিষ্কার, বিজয় যে আইপিএল প্রজন্ম থেকে টেস্ট প্রজন্মে উত্তরণের বাঁধ তৈরি শুরু করেছেন!
গাব্বার পক্ষে একটু তাড়াতাড়ি লিয়ঁকে আক্রমণে আনেন স্টিভ স্মিথ। আগে লিখিনি, এই নতুন স্টিভের সঙ্গে একই দিনে পুরনো স্টিভের জন্মদিন। তিনি স্টিভ ওয়। আর দুই অধিনায়কের বিরুদ্ধে ভারতীয় গাব্বা-সেঞ্চুরির সর্বোচ্চ ক্রমিক সংখ্যাটাও বুধবার সেই একই থাকল— ১৪৪। যদিও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ইনিংসটা ঘটেছিল আরও চতুর, ক্ষুধার্ত টিমের বিরুদ্ধে। যারা বিপক্ষকে ৪২ রানে তিন উইকেটে নামিয়ে দিয়ে তখনই খেলা শেষ করে দেবে ভেবেছিল। যারা টিম ফিজিওর কাছে লাইন বেঁধে আল্ট্রাসাউন্ড নিতে যায়নি। নতুন স্টিভ রাজত্বের প্রথম দিন মনে হল এই অস্ট্রেলিয়া নিজেরাই যথেষ্ট গোছানো নয়। নতুন ক্যাপ্টেন সবে এসেছেন। এখনও বোলারদের সঙ্গে বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। প্রচণ্ড প্রত্যাঘাতে সিরিজ ১-১ করার ক্ষীণ সুযোগ কিন্তু প্রথম দিনের স্টাম্প ওঠা ইস্তকই ভারতের দিকে এগোতে শুরু করেছে।
চ্যানেল নাইন বারবার অস্ট্রেলিয়ার ক্যাচ ফেলার কথা বলছে। কিন্তু তারও আগে যে পূজারার উইকেটটা অস্ট্রেলিয়া পুরো বোনাসে পেয়েছে। হ্যাজলউডের বাউন্সারটা হেলমেটে লেগে কিপারের হাতে যায়। গ্লাভসটা মাথার ঠিক নীচে রাখা ছিল বলেই বোধহয় ইয়ান গোল্ড বিভ্রান্ত হন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ওয়ান ডাউনকে এ ভাবে গাব্বা উইকেটে হারানো যে কোনও টিমের পক্ষে মর্মান্তিক। খেলা সেখানেই ঘুরে যেতে পারত। এখানে ঘোরেনি, অন্য কথা।
কিন্তু এ বার আর গোঁয়ার্তুমি না করে ভারতের ডিআরএস মেনে নেওয়ার সময় হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ডিআরএস না নিলে ভারত দাম দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
ব্রিসবেন টেস্টের স্কোর
ভারত
প্রথম ইনিংস
বিজয় ক হাডিন বো লিয়ঁ ১৪৪
ধবন ক হাডিন বো মিচেল মার্শ ২৪
পূজারা ক হাডিন বো হ্যাজলউড ১৮
কোহলি ক হাডিন বো হ্যাজলউড ১৯
রাহানে ব্যাটিং ৭৫
রোহিত ব্যাটিং ২৬
অতিরিক্ত ৫
মোট ৩১১-৪।
পতন: ৫৬, ১০০, ১৩৭, ২৬১।
বোলিং: জনসন ১৫-২-৬৪-০, হ্যাজলউড ১৫.২-৫-৪৪-২,
স্টার্ক ১৪-১-৫৬-০, মিচেল মার্শ ৬-১-১৪-১, লিয়ঁ ২০-১-৮৭-১,
ওয়াটসন ১০.৪-৫-২৯-০, ওয়ার্নার ১-০-৯-০, স্মিথ ১-০-৪-০।