আমার কোচ ক্র্যামারের কথাই এখন বায়ার্নের ভরসা

সেমিফাইনালের লটারি হওয়ার দিন থেকেই এই ম্যাচটা ছিল এ বারের ‘দ্য ম্যাচ’। রবেন-রিবেরি বনাম রোনাল্ডো-বেল। জার্মান তিকিতাকা বনাম রিয়ালের কাউন্টার অ্যাটাক ফুটবল। আরও সূক্ষ্ম ভাবে বলতে হলে পেপ গুয়ার্দিওলা বনাম কার্লো আন্সেলোত্তির মগজের লড়াই।

Advertisement

চুনী গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১০
Share:

গোল নষ্টের আর্তনাদ

রিয়াল মাদ্রিদ-১ (বেঞ্জিমা)

Advertisement

বায়ার্ন মিউনিখ-০

সেমিফাইনালের লটারি হওয়ার দিন থেকেই এই ম্যাচটা ছিল এ বারের ‘দ্য ম্যাচ’। রবেন-রিবেরি বনাম রোনাল্ডো-বেল। জার্মান তিকিতাকা বনাম রিয়ালের কাউন্টার অ্যাটাক ফুটবল। আরও সূক্ষ্ম ভাবে বলতে হলে পেপ গুয়ার্দিওলা বনাম কার্লো আন্সেলোত্তির মগজের লড়াই।

Advertisement

বায়ার্ন কোচ গুয়ার্দিওলা যদি জোহান ক্রুয়েফের প্রিয় শিষ্য হয়ে থাকে, তা হলে রিয়াল কোচ আন্সেলোত্তিও কোনও অংশে কম যায় না। সে আবার বারেসি, মালদিনি, খুলিট, রাইকার্ড, বাস্তেনদের ঝলমলে এসি মিলানে একদা সতীর্থ।

দু’বছর আগে এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে রিয়াল বনাম বায়ার্ন ম্যাচে জার্মানদের কাছে দৌড় শেষ হয় রিয়ালের। সে বার বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করে বিতর্ক বাড়িয়েছিল স্প্যানিশ সমর্থকরা। জবাবে কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে বলেছিল, “পরের বার দেখা হলে মাঠেই এর জবাব দেবে ফুটবলাররা।” এই ম্যাচের আগে সেই আলোচনা ফের প্রচারমাধ্যমে উঠে আসায় ফুটবল মাঠে চোখে চোখ রেখে লড়াই দেখার প্রহর গুনছিলাম। কারণ, ফুটবল মাঠে জার্মানদের জাত্যাভিমান কারও অজানা নয়। যেটা আমার জার্মান কোচ ডেটমার ক্র্যামার গল্পছলে বহু বার বলেছিলেন। সেই ফ্রিটজ্ ওয়াল্টার থেকে আজকের ফিলিপ লাম যাদের ডাইরেক্ট, পজিটিভ, নির্মম ফুটবল ঘিরে কতই না গল্পকথা!

কিন্তু বুধবার রাতে ম্যাচটা টিভিতে দেখার পর প্রশ্ন জাগছে জার্মানদের সেই বহুচর্চিত ফুটবলটা গেল কোথায়? তিকিতাকার পেটেন্ট পকেটে রাখা গুয়ার্দিওলা জার্মান ঘরানার উপর জোর করে কি পাসিং ফুটবলটা চাপিয়ে দিচ্ছে? না হলে গোটা ম্যাচের দুই-তৃতীয়াংশ বলের দখল নিজেদের পায়ে রাখলেও রবেন, রিবেরিরা রিয়ালের পেপে-র্যামোসদের হারিয়ে একটা গোল করতে পারে না! নিজেদের মধ্যে গাদাগুচ্ছের পাস খেললেই কি ম্যাচ জেতা যায় না কি? তার জন্য দরকার পড়ে পেনিট্রেশন। যা করতে গেলে বেশি করে ওভারল্যাপিং দরকার ছিল বায়ার্নের দুই সাইডব্যাক রাফিনহা এবং আলাবার পা থেকে। কিন্তু সে সব রিয়ালের মিডল থার্ড অবধি গিয়েই হারিয়ে যাচ্ছিল। তবে গোটজে, মুলাররা নামার পর সুযোগ তৈরি হতে দেখলাম। কিন্তু তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। তা হলে সোয়েনস্টাইগার-মুলার-গোটজে ত্রিভুজ শুরু থেকে নয় কেন? ‘দ্য ম্যাচ’ থেকে টনি ক্রুজ, বোয়াতেংদের সেই মরিয়া লড়াইটাই উধাও। খেলায় কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া ভাব। গুয়ার্দিওলা হয়তো বোঝেনি বার্সেলোনায় জাভি-ইনিয়েস্তাদের নিয়ে যা করা যায়, তা অন্য একটি জাতির অন্য ঘরানার ফুটবলে চাপিয়ে দিতে গেলে তিরন্দাজ, গোলন্দাজ একসঙ্গে হতে গিয়ে ফুটবলটাই বেআন্দাজ হয়ে যায়! বুধবার রাতে বের্নাবাওতে যেন সেটাই ঘটল বায়ার্নের কপালে।

আলট্রা ডিফেন্সিভ ছকে শুরু করা রোনাল্ডোদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে বায়ার্ন মিউনিখকে গোল করে যেতে দেবে না আন্সেলোত্তি। পেপে-র্যামোসদের আঁটোসাঁটো রক্ষণের সামনে জাবি আলোন্সো রিয়ালের গোলের মুখে তালাচাবি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল পুরো নব্বই মিনিটই। ওঠানামা করে মান্ডজুকিচও বেশ নজর কাড়ছিল। রিয়ালের হয়ে এই চার জনই অনবদ্য। এ সব ক্ষেত্রে রক্ষণের লৌহকপাট ভাঙতে পারত জার্মানদের সেই গতিময় ডাইরেক্ট ফুটবল। কিন্তু তার নাম-গন্ধ ছিল না গুয়ার্দিওলার বায়ার্নে।

প্রশ্ন উঠবে যে টিমটা সাতটা ম্যাচ বাকি থাকতেই বুন্দেশলিগা জিতেছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে প্রথম পর্বের ম্যাচে মাত্র এক গোলে হারতেই এত ‘গেল গেল’ রব কেন? উত্তরে বলব, বর্তমান ফুটবল বিশ্বে কোনও কিছুই দীর্ঘ দিন ব্যাখ্যাহীন হয়ে পড়ে থাকে না। বায়ার্নের খেলা দেখে অন্য পেশাদার কোচেরাও তো সেটার প্রতিষেধক তৈরি করছে রোজ। তাই রবেন যে ডান দিক দিয়ে বাঁ পায়ে ইনসাইড ডজে ভিতরে ঢুকে আসবে তা প্রায় সবাই এত দিনে জেনে ফেলেছে। জেনে ফেলেছে যে, ডাচ ফুটবলারটির ডান পা তেমন ভয়ঙ্কর নয়। আর খেলে খেলে রিবেরিও যেন ক্লান্ত মনে হল। বায়ার্ন মিউনিখ গোল পাবে কী ভাবে? এই সুযোগে পিঠে পিঠ দিয়ে লড়ে বিষাক্ত কাউন্টার অ্যাটাক দিয়েই ম্যাচ বের করে নিয়ে গেল আন্সেলোত্তি।

সাফল্যের হুঙ্কার

আমার মতে গুয়ার্দিওলার উচিত ছিল, দি মারিয়া, রোনাল্ডোদের দৌড় বন্ধ করা এবং কাউন্টার অ্যাটাকের জায়গা না দেওয়া। সেটা প্রথম কুড়ি মিনিট হচ্ছিলও ঠিকঠাক। কিন্তু তার পর সব তালগোল পাকিয়ে গেল। সেই সুযোগেই বেঞ্জিমার গোল। গোলটার সময় বোয়াতেং পায়ে পা জড়িয়ে পিছিয়ে পড়ল। রাফিনহাকে ঠিক পজিশনে দেখা গেল না। দাঁতে আর আলাবাও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঞ্জিমাকে মার্ক করেনি ।

পরের সপ্তাহে আলিয়াঞ্জ এরিনায় ঘরের মাঠে চাপ বাড়ল গুয়ার্দিওলার। ফাইনাল উঠতে সেই ম্যাচে দু’গোলের ব্যবধানে জিততে গেলে লামকে মাঝমাঠের বদলে রক্ষণে ফিরিয়ে আনলে বোধহয় ভাল করবে গুয়ার্দিওলা। লামের ডিস্ট্রিবিউশনটা ভাল। কিন্তু রাইট ব্যাকে আবার রাফিনহার চেয়ে লাম-ই পোক্ত। তবে ‘দ্য ম্যাচ’-এর দ্বিতীয় পর্বে তাই একটা জবরদস্ত লড়াই দেখার অপেক্ষায় রইলাম। শুনলাম, রুমেনিগে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছে।

আর ক্র্যামার আমাদের বলতেন, “জার্মানদের গলায় ছুরিটা যে দিন বসে যায়, সে দিন কিন্তু যুদ্ধটা জিতে ফেরে তারাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন