কেকেআর নিলামের প্রথম দৃশ্য থেকে অনেকে এখন ভরসা পেতে চাইছেন

লেনি রদ্রিগেজকে পুণে প্রথম রাউন্ডে তুলে নেওয়ার পরেই কলকাতার কর্তাদের উসখুস শুরু হয়ে গেল! দেশের অন্যতম সেরা মিডিও হাতছাড়া! ট্রেভর মর্গ্যান যখন কেরল ব্লার্স্টাস কর্তাদের দিয়ে ‘প্রিয়’ মেহতাব হোসেনকে কিনলেন তখন দেখলাম হোসে ব্যারেটোর মুখটা ডার্বি ম্যাচে পেনাল্টি মিস করার পরের মুহূর্তের মতোই পাংশু। লেনি এবং মেহতাব— দু’জনেই ছিলেন আটলেটিকো দ্য কলকাতা-র তালিকায়।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

মুম্বই শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

লেনি রদ্রিগেজকে পুণে প্রথম রাউন্ডে তুলে নেওয়ার পরেই কলকাতার কর্তাদের উসখুস শুরু হয়ে গেল! দেশের অন্যতম সেরা মিডিও হাতছাড়া!

Advertisement

ট্রেভর মর্গ্যান যখন কেরল ব্লার্স্টাস কর্তাদের দিয়ে ‘প্রিয়’ মেহতাব হোসেনকে কিনলেন তখন দেখলাম হোসে ব্যারেটোর মুখটা ডার্বি ম্যাচে পেনাল্টি মিস করার পরের মুহূর্তের মতোই পাংশু।

লেনি এবং মেহতাব— দু’জনেই ছিলেন আটলেটিকো দ্য কলকাতা-র তালিকায়।

Advertisement

‘দাদা’-র টিমে খেলার জন্য মুখিয়ে ছিলেন রহিম নবি। প্রথম দু’রাউন্ডে তাঁকে কেউ নিচ্ছে না দেখে, দেশের সেরা ইউটিলিটি ফুটবলার যখন হয়তো ভাবছেন তাঁর কী হবে, তখনই চমক। সুব্রত পালের সঙ্গে তাঁকেও যে কিনে নিল মুম্বই। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে পান্ডুয়ার ছেলে বলতে বাধ্য হলেন, “যখন কলকাতা নেয়নি তখন কি হাত কচলে অনুরোধ করব। আমি এখন মুম্বই ছাড়া আর কিছু ভাবছি না। মুম্বইকে চ্যাম্পিয়ন করাই আমার এখন লক্ষ্য।” খুশিতে ডগমগ রণবীর কপূরের দলের কর্পোরেট কর্তারা তখন হাসছেন। এক কর্তা তো হাততালিও দিলেন উচ্ছ্বাসে।

কেউ কেউ যদিও বলছেন, আইপিএল নিলামেও তো কলকাতা নাইট রাইডার্সের একই দশা হয়েছিল। বেশির ভাগ সেরা প্লেয়ারই হয়েছিল হাতছাড়া। কিন্তু মাঠে দিনের শেষে শাহরুখ খানের নাইটদের হাতেই ট্রফি উঠেছিল। আইএসএলেও কি শেষ হাসি হাসবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতা দল!

টেনশন, উদ্বেগ, তালিকা মতো ফুটবলার পাওয়া-না পাওয়া, বাজেট সামলে প্ল্যান বি-র ফুটবলার নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা— মঙ্গলবার মুম্বইয়ের লোয়ার প্যারোলের পাঁচতারা হোটেল ছিল নানা নাটকীয় মূহূর্তে ঠাসা। সাত রাউন্ডে সাত জন করে ফুটবলার কেনার সময় ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্তাদের মুখগুলো ছিল মঙ্গলবারের মুম্বইয়ের আকাশের মতোই। এই আলো আবার পরক্ষণেই মেঘলা।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আসছেন না। সচিন তেন্ডুলকর বুধবার আসতে পারেন, জানাচ্ছেন সংগঠক আইএমজি-আর কর্তারা। তবে এ দিনই ইন্ডিয়ান সুপার লিগের (আইএসএল) প্রথম ফুটবলার কেনা-বেচার বাজারের মধ্যেই হাজির হন বলিউড তারকা জন আব্রাহাম। কোনও লিখে আনা স্ক্রিপ্ট নয়, নিজস্ব নায়কোচিত ভঙ্গিমায় গুয়াহাটি টিমের অন্যতম মালিক হঠাৎ-ই উস্কে দিয়ে গেলেন নতুন বিতর্ক। “উত্তর-পূর্বাঞ্চল বরাবরই ব্রাত্য। ফুটবলেও। তাই আমি গুয়াহাটিতে আছি। ভাইচুং, সুনীল ছেত্রী-সহ দেশের সত্তর ভাগ ফুটবলার তো ওখান থেকেই আসে। শুধুই চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়, এখানকার ফুটবলের আরও উন্নতি করাই আমার লক্ষ্য।” যার কিছুক্ষণের মধ্যে ফেডারেশন সচিব কুশল দাস প্রচুর তথ্য নিয়ে হাজির প্রেসরুমে। জনের পাল্টা তাঁর মন্তব্য, “আমরা তো সবচেয়ে বেশি নজর দিই ওখানেই। উনি কী বলছেন জানি না। তবে বলে থাকলে সেটা মানছি না।”

বিতর্ক, বলিউড, কর্পোরেট, টিভি তারকা, ফুটবলার, ক্রিকেটার— মুম্বইয়ের হোটেল প্যালেডিয়াম-এর আট এবং নয় তলায় এ দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যা হল তা ভারতীয় ফুটবল কখনও দেখেনি। জাঁকজমক, আড়ম্বর, নিখুঁত পরিকল্পনা, উপস্থাপনা— ক্রিকেট আইপিএলের নিলামের সঙ্গে যা পাল্লা দিতে পারে অনায়াসেই। তবে ফুটবল আইপিএলে এ দিন ক্রিকেটের মতো কোনও নিলাম বা দরাদরি হয়নি। শুধু ফুটবল বাজার থেকে নির্ধারিত মূল্যে ফুটবলার কিনেছে ছয় ফ্র্যাঞ্চাইজি। সচিনের কেরল টিমের সহকারী কোচ হয়ে এসেছিলেন মর্গ্যান, কলকাতার সহকারী কোচ হিসাবে হাজির হোসে ব্যারেটো। আর কোনও দলই কোচ বসাননি তাদের ফুটবলার নির্বাচন টেবিলে। আট ক্লাবের আট টেবিলের বাকি দুটিতে বসেছিলেন গোয়া এবং গুয়াহাটির কর্তারা। ডেম্পো এবং শিলং লাজংয়ের সঙ্গে তাঁদের সংযুক্তি আছে বলে তালিকা থেকে ফুটবলার কেনেননি তাঁরা। তবে ঘোষণা করেছেন, অন্যদের মতোই সাত ফুটবলারের নাম। যেখানে ক্লিফোর্ড মিরান্ডা, দেবব্রত রায় থেকে আইবরের নাম আছে। শোনা যাচ্ছে, এ দিন কেনা ফুটবলারদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ বুধবার টেবিলে থাকতে পারেন। টিমকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য।

ফুটবলের টিভি সম্প্রচারের পরিচিত সুদর্শনা অ্যাঙ্কর মায়ান্তি যখন সকালে পোডিয়ামে উঠলেন, তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তারা যে যাঁর তালিকা নিয়ে তৈরি। মেজর সকার লিগের নিয়মে রাউন্ড এগোচ্ছিল। প্রতি দু’রাউন্ডের পর কোন দলের কী অবস্থা তার ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন ভাইচুং ভুটিয়া। ফুটবলার বিক্রির কাজ যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে উত্তেজনা। যেখানে ফুটবল-বাজার বসেছিল সেখানে কোনও ফুটবলারকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের পাশের একটি ঘরে বিশাল স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। সবার মুখে উৎকণ্ঠা। একমাত্র মেহতাব হোসেন ছাড়া। কারণ, তিনি সেই ঘরে ঢোকার আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন ‘প্রিয়’ কোচ মর্গ্যানের কেরলে। বলছিলেন, “আরে আমি তো দেখতেই পেলাম না, মর্গ্যান স্যার আমাকে নিয়ে নিয়েছেন।”

হল থেকে বেরিয়ে ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ আবার দেখা করে, নানা কথা বলে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করে দিয়ে গেলেন পুরনো ছাত্র মেহতাব, নির্মল ছেত্রী, গুরবিন্দর সিংহ, সুশান্ত ম্যাথু, ইসফাক আহমেদদের। যাঁদের তিনি অঙ্ক করে কেরল দলে নিয়েছেন এ দিন। দিল্লি, মুম্বই দু’দলই চেয়েছিল মর্গ্যানকে কোচ হিসাবে। কিন্তু সচিন তেন্ডুলকরের দলেই শেষ পর্যন্ত সহকারী কোচ হতে রাজি হয়ে যান মর্গ্যান। শুরুর দিনেই দেখা গেল তাঁর মগজাস্ত্র কাজ শুরু করে দিয়েছে। উদভ্রান্তের মতো না দৌড়ে ইস্টবেঙ্গলের ফর্মুলায় পুরনো এবং ফেভারিট ছাত্রদের উপরই ভরসা রাখলেন। চমকে দিল অবশ্য মুম্বইও। সবচেয়ে দামি আশি লাখের দুই ফুটবলার সুব্রত, নবির সঙ্গে লালরিন্দিকা, দীপক মণ্ডল, রাজু গায়কোয়াড়ের মতো তারকা ফুটবলার তুলে নিয়ে। জানা গেল ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মধ্যে তাদের বাজেটই সবচেয়ে বেশি— প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা। বেঙ্গালুরুও খারাপ ফুটবলার বাছেনি। খাবরা, গৌরমাঙ্গী, শিল্টন, জোয়কিম আব্রাঞ্চেস, ধনচন্দ্র, জেজেদের নিয়েছে তারা।

ফুটবলারদের পাশের ঘরে বসিয়ে রেখে তাঁদের বিক্রি করার মতো অভিনব ঘটনার পাশে আরও একটা চমক ছিল এ দিন। এক সময় আইএসএলের বিরোধিতায় অনড় আই লিগের কর্তারা দলে দলে এসে বসেছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজিদের টেবিলে। ফুটবলার নির্বাচন করতে। সুপার লিগ বিরোধী ক্লাব জোটের অন্যতম মুখ পুণে এফসি কর্তা চিরাগ তান্না বসেছিলেন পুণে ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে। মাঠ নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে বেঙ্গালুরু ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ফুটবলার বাছতে বসে গেলেন আই লিগ চ্যাম্পিয়ন বেঙ্গালুরু এফসি-র দুই কর্তা— মুস্তাফা গাউস, মন্দার তামানে। ডেম্পো, শিলং তো আগেই যুক্ত হয়েছে গোয়া এবং গুয়াহাটির সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো টিমও প্রায় সব ফুটবলারকে লোনে দিয়ে দিয়েছে আইএসএলে। ফলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, ইন্ডিয়ান সুপার লিগের জৌলুসের ধাক্কায় কি আই লিগের গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে? না, সন্তোষ ট্রফির হাল হবে লিগের।

তেতো মুখে এ সব প্রশ্ন শুনে ফেডারেশন সচিব ‘না, না, সে রকম হবে না’ বলে মাথা নাড়লেন। ভাইচুং ভুটিয়া বলে দিলেন, “আই লিগের ক্লাবগুলো আইএসএলে যুক্ত হলে ভাল হবে। এটা বড় সুযোগ।” আর এই সব দেখেশুনে সংগঠক আইএমজি-র ফুটবল ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি নি হাসছিলেন। ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি।

জৌলুসহীন আই লিগকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিতে বিপণন আর চমকই সেরা অস্ত্র সেটা তাঁর চেয়ে বেশি কে-ই বা জানেন! সরকারি ঘোষণা না হলেও আইএসএল শুরু হবে সম্ভবত ৫ বা ৬ অক্টোবর। এখনও পর্যন্ত যা ঠিক আছে তাতে ৪৯ জন বিদেশি ফুটবলারের নিলাম হবে ২০ অগস্ট। সেই আন্তর্জাতিক পুলে বিশ্বকাপজয়ী থেকে ইউরো জয়ী ফুটবলার থাকবেন বলে খবর। সে দিকে অবশ্য কারও নজর নেই এই মুহূর্তে। সবাই আপাতত বুধবার কোন ভারতীয় ফুটবলার নেবেন তা নিয়ে আলোচনায় বসে গিয়েছেন এ দিন বিকেল থেকেই। এখনও যে পড়ে আছেন স্টিভন ডায়াস, সঞ্জু প্রধান, ক্লাইম্যাক্স লরেন্স, সন্দীপ নন্দীর মতো ফুটবলাররা। যাঁরা অবিক্রিত অবস্থায় এ দিন খানিকটা চিন্তিত মুখে হোটেলে ফিরে গিয়েছেন। আরও চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহর গুনতে ।

মেহতাব-লেনি-ইসফাককে হারিয়ে ঘুম ছুটেছে কলকাতারও। বিদেশিদের নেওয়ার নতুন নিয়ম জানার পর আপাতত তাই হোসে ব্যারেটোর টিমের লক্ষ্য আজ বুধবার ড্যামেজ কন্ট্রোল। তা নিয়ে রাতেই আলোচনা শুরু করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। দেখার, শেষ সাত রাউন্ডে দুই ‘ম’— মর্গ্যান-মুম্বইয়ের উপর দাদাগিরি করতে পারে কি না দাদার টিম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন