দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বহু অধ্যায়ের সাক্ষী থেকেছে ফুটবলবিশ্ব। টুর্নামেন্ট যাই হোক না কেন, ম্যাচের আগেই উত্তেজনার পারদ কখনও কমেনি। কিন্তু আজ শোকের ছায়া দুটো দেশেই। দুই দেশের সমর্থক মিলে একসঙ্গে প্রার্থনায় মগ্ন। যাতে খুব শীঘ্রই আবার তাঁর প্রতিভার সাক্ষী থাকা যায় ফুটবল মাঠে। তিনি-- ব্রাজিলের দশ নম্বর নেইমার দ্য সিলভা জুনিয়র।
যে ফুটবলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহাওয়া মুছে দিয়েছেন ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা থেকে, তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক সেই প্রার্থনাই করছে দু’দেশ। নেইমারকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তার বাইরে উপস্থিত ছিলেন আর্জেন্তিনা সমর্থকরা। ওয়ান্ডারকিডকে নিয়ে আসতেই ব্রাজিলীয়দের সঙ্গে তাঁরাও চিৎকার করতে শুরু করে, “ভরসা রাখো নেইমার। শক্ত থাকো।”
উদ্বেগ শুধু সমর্থকদের মধ্যেই আটকে ছিল না। নেইমারের সতীর্থরাও সমান ভাবে শোকাহত। দলের অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা যেমন বলে দিলেন, ওয়ান্ডারকিডের জন্যই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হবে। “নেইমারের জন্যই আমাদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হবে। ওর অনেক আশা আছে এই দলের থেকে। সব স্বপ্ন পূর্ণ করতে হবে আমাদের।”
সাও পাওলোর প্রায় প্রতিটা পাব-এ এককাট্টা হয়ে খেলা দেখছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনা সমর্থকরা। নেইমারের চোটের খবর শুনতেই উপস্থিত এক আর্জেন্তিনা ভক্ত এডুয়ার্ডো গোমেস বলেন, “খুবই খারাপ লাগছে ব্রাজিলের জন্য। ভাগ্যের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করতে পারে না।” বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনার মরণ-বাঁচন লড়াইয়ের আগেও সমর্থকরা উগ্বেগে ছিলেন নেইমারের শারীরিক অবস্থা নিয়ে। কয়েক জন আবার ব্রাসিলিয়ার মাঠেই উপস্থিত হন ‘ফুয়েরজা নেইমার’ ব্যানার নিয়ে। অর্থাৎ ‘নেইমার দ্য ফোর্স।’ পাশাপাশি আবার ব্রাজিলীয় সমর্থকরা ভাগ হয়েছে দুই ভাগে। এক দল মনে করছে, নেইমার না থাকায় কোনও সমস্যা হবে না ব্রাজিলের। আবার একটা দল এখন থেকেই শঙ্কিত, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ অভিযানের ইতি না ঘটে যায় জার্মানি ম্যাচেই। যে মারাদোনা বহু বার ব্রাজিলের রক্ষণ নাজেহাল করে তুলতেন, তিনিও আজ সমবেদনার হাত বাড়িয়ে দিলেন নেইমারকে। বলে দিচ্ছেন, “শুধু ব্রাজিলই তাদের চোখের মণিকে হারাল না। এই হার আমার মতো সব ফুটবলপ্রেমীদেরই। এটা ওর বিশ্বকাপ হওয়া উচিত ছিল। ভগবান যেন ওকে শক্তি দেয়।” কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে লিওনেল মেসি টুইট করেন, “নেইমার আমি চাই তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো বন্ধু।”
আর্জেন্তিনা যখন প্রার্থনায় মগ্ন, ব্রাজিল ফুঁসছে রাগে। কলম্বিয়ার জুনিগাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী স্ট্রাইকার রোনাল্ডো বলে দিলেন, ফাউলটা নেইমারকে আঘাত করার জন্যই করা হয়েছিল। প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক সুরে রোনাল্ডো বলেন, “কলম্বিয়ার খেলাটা আমার ভাল লাগছিল না। খুব খারাপ ভাবেই ফাউল করছিল ওরা।” সঙ্গে তিনি যোগ করেন, “ইচ্ছা করেই এ রকম ভয়ঙ্কর ভাবে মারা হয় যাতে নেইমারের আঘাত লাগে। ফাউলটা একদমই ভাল লাগেনি। আমার মনে হয় ইচ্ছাকৃতই এ রকম ফাউল করল জুনিগা। টিভিতে দেখে সেটা পরিষ্কার ছিল। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আর কিছু বলার নেই।” কলম্বিয়ার টিম হোটেলের বাইরে সারা রাত বোমাবাজি করে ব্রাজিল সমর্থকরা। হুমকি শোনা যায়, “জুনিগা তুমি বেরোলেই মেরে ফেলব। কোন সাহসে এ রকম করলে।”
‘রিহ্যাবটাই আসল’
নেইমারের চোটটা ঠিক কী? কত দিন লাগবে সারতে? ভবিষ্যতে এই চোট কি তাঁকে সমস্যায় ফেলতে পারে?
চার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যা বলছেন-
ভেস পেজ (স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ): যেখানে চিড় ধরেছে, সেটা মেরুদণ্ডের খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বিশেষ করে একজন ফুটবলারের জন্য। চার সপ্তাহ পর নেইমার হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামতে আরও এক মাস লেগে যেতে পারে। এই এক মাসে রিহ্যাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক রিহ্যাবের উপরই নির্ভর করছে নেইমারের ফুটবল-ভবিষ্যৎ।
শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত (অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ): নেইমারের চোটটা ডাক্তারি পরিভাষায়, ফ্র্যাকচার্ড ট্রান্সভারস প্রসেস অব থার্ড লাম্বার ভাটিব্রা। এই ধরনের চোটে সাময়িক যন্ত্রণা হয় খুব বেশি। যে জন্য নেইমার মাঠে কেঁদে ফেলেছিল। তবে ফুটবল জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই।
মানব ভট্টাচার্য (ভারতীয় ফুটবল দলের চিকিৎসক): ইন্টারনেটে নেইমারের এক্স-রে রিপোর্ট যা দেখলাম, থার্ড লাম্বার ভাটিব্রাতে ওর চোটটা মারাত্মক কিছু নয়। পুরো চার সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। পুরো ম্যাচ ফিট হয়ে উঠতে আরও কিছু দিন লাগবে। ফুটবলারের মনের জোরের উপরেও অনেকখানি নির্ভর করে।
অলোক দত্ত (অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ): কলম্বিয়ার ডিফেন্ডারের শরীরের পুরো ওজনটা নেইমারের উপর পড়েছিল। তবে নার্ভের ক্ষতি হয়নি বলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে না। সাধারণত এমন চোটে ওষুধ, ইঞ্জেকশনের পাশাপাশি একটি বেল্ট পরিয়ে রাখা হয় কোমরের ওই জায়গায়। বিশ্রাম আর রিহ্যাব খুবই দরকার।