কমনওয়েলথ সোনা জিতে বিস্ফোরক সুখেন

‘নিজেকে বাংলার ছেলে বলতে এখন লজ্জা করে’

দেশের মাটিতে কমনওয়েলথ গেমসের সোনা হারিয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠে কেঁদেছিলেন। চার বছর পর গ্লাসগোতেও কাঁদলেন। তবে সোনা জিতে, জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে দেশের পতাকা সবার আগে ওড়াতে পেরে।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০৩:১১
Share:

দেশের মাটিতে কমনওয়েলথ গেমসের সোনা হারিয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠে কেঁদেছিলেন।

Advertisement

চার বছর পর গ্লাসগোতেও কাঁদলেন। তবে সোনা জিতে, জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে দেশের পতাকা সবার আগে ওড়াতে পেরে। “যখন ক্লিন অ্য্যান্ড জার্ক বিভাগের ওজন তুলতে যাচ্ছি তখন শুধু ভাবছিলাম, এ বার আমি দেশের পতাকাটা সবার উপরে তুলতে পারব তো? ভিকট্রি স্ট্র্যান্ডে এক নম্বর জায়গাটা পেতেই হবে, সেই জেদও ছিল। কী রকম একটা যেন হচ্ছিল শরীরের মধ্যে,” গ্লাসগোয় ভারতীয় সময় দুপুর দু’টো নাগাদ যখন সোনার ছেলেকে মোবাইলে ধরা হল, তখনও বৃহস্পতিবার রাতের সোনা-জয়ী ভারোত্তোলক সুখেন দে ঘোরের মধ্যেই।

সবে ব্রেকফাস্ট করে গেমস ভিলেজে ঘুরতে বেরিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। “গত বার টেকনিক্যাল ভুলের জন্য সোনা হাতছাড়া হয়েছিল। এ বার ভুল করিনি। গত চার বছর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি এই দিনটার জন্য। ওজন বেড়ে যাবে বলে ভাল করে খাইনি। প্রতি দিন পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা প্র্যাকটিস করেছি। হাওড়ার বাড়িতে আসিনি এক বছর।”

Advertisement

গেমসের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার রাতে ভারত দু’টো সোনা জিতল। দু’টোই ভরোত্তোলনে। মেয়েদের বিভাগে সঞ্জিতা চানুর পর পুরুষদের ৫৬ কেজি বিভাগে সোনা জেতেন হাওড়া আন্দুলের দুইল্যা জামরুলতলার ছেলে। বৃহস্পতিবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে বারোটায় শুরু হয় ইভেন্ট। স্ন্যাচ বিভাগের মাঝামাঝি পিছিয়ে পড়েছিলেন মালয়েশিয়া আর শ্রীলঙ্কার প্রতিন্দ্বন্দ্বীর কাছে। পরে তা সামলে নেন। ফিরে আসেন লড়াইয়ে যথাক্রমে দুই বিভাগে ১০৯ এবং ১৩৯ মোট ২৪৮ কেজি ওজন তুলে। গত বার এর চেয়ে চার কেজি বেশি তুলেও সোনা পাননি সুখেন। এ বার কম তুলেও বাজিমাত। ঈশ্বর এ ভাবেই হয়তো আলোয় ফেরান সাহসী আর পরিশ্রমীদের!

সোনার ছেলে সুখেন। গ্লাসগোয়। ছবি: পিটিআই

কলকাতা থেকে প্রথম ফোন পান আনন্দবাজারেরই। যাঁর কাছে পাতিয়ালার শিবিরে অনুশীলন করতেন, সেই কোচ বিজয় কর্মাই যোগাযোগ করিয়ে দেন সুখেনের সঙ্গে। বঙ্গসন্তান হিসেবে ইতিহাস তৈরি করলেন। আপনার আগে এ রাজ্যের কেউ তো এই গৌরব ছুঁতে পারেনি ভারোত্তোলনে। কেমন লাগছে? শুনে রীতিমতো চটে যান শান্ত স্বভাবের গ্রাম্য ছেলে। “আরে নিজেকে বাংলার ছেলে বলতে এখন লজ্জা হয়। পুণেয় অফিসে শুনি অন্য রাজ্যের ক্রীড়াবিদরা জাতীয় স্তরে সাফল্য পেলেই রাজ্য থেকে ফ্ল্যাট পায়, সংবর্ধনা পায়, আর্থিক সাহায্য পায়। আমি তো আজ পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। এক বার ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রকে ফোন করেছিলাম, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য। উনি বলে দিলেন কে সুখেন, তুমি কী করো? তোমাকে তো চিনি না।”

গত বার কমনওয়েলথে রুপো জেতার পর তাঁর অফিস সার্ভিসেস সুখেনকে প্রমোশন দিয়েছে। বছর পঁচিশের সোনার ছেলেকে সিপাই থেকে করে দিয়েছে জুনিয়র কমান্ডার। কিন্তু বাংলা থেকে কোনও সাহায্য পাননি জাতীয় ও কমনওয়েলথ পর্যায়ের টুর্নামেন্টগুলোয় সোনা-রুপো জয়ী ভারোত্তোলক। “কাগজে দেখি ক্রীড়ারত্ন, খেলরত্ন দেওয়া হচ্ছে। ক্লাবগুলোকে লাখ লাখ টাকা দিচ্ছে রাজ্য সরকার। ক্যারাটে, উসুও টাকা পাচ্ছে। এক-এক জন তো দু’তিন বারও পেয়েছে। গত কমনওয়েলথ গেমসে আমার সঙ্গে বাংলার যারা পদক জিতেছিল কেউ টাকা, কেউ ফ্ল্যাট, কেউ জমি পেয়েছে। আমি গ্রামের ছেলে, একটা চাদরও তো দিতে পারত,” তীব্র ক্ষোভ আর অভিমান থেকে বলে যান বাংলার অন্যতম সফল ক্রীড়াবিদ।

উসুও টাকা পাচ্ছে। এক-এক জন তো দু’তিন বারও পেয়েছে। গত কমনওয়েলথ গেমসে আমার সঙ্গে বাংলার যারা

পদক জিতেছিল কেউ টাকা, কেউ ফ্ল্যাট, কেউ জমি পেয়েছে। আমি গ্রামের ছেলে, একটা চাদরও তো দিতে পারত...”

এ বার গ্লাসগোয় ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। দিল্লি গেমসের মাত্র দু’জন ভারোত্তোলক যোগ্যতামান পেরিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন সুখেন। জুনের শুরুতে গ্লাসগোগামী দলে সুযোগ পেয়েই দু’জনকে ফোন করেন মা মীনা দে আর রাজ্য সংস্থার সচিব শৈলেন কাপাসকে। শৈলেনবাবু বলছিলেন, “তখনই বলেছিল স্যার এ বার সোনা জিতবই। ছেলেটার মধ্যে বরাবরই কিছু করে দেখানোর একটা জেদ দেখেছি।” একই কথা গ্লাসগো থেকে ফোনে শোনালেন সুখেনের বর্তমান কোচ বিজয় কর্মা, “জাতীয় প্রতিযোগিতায় চোট আর অসুস্থতার জন্য গত কয়েক বছর ভাল করতে পারেনি সুখেন। ভেবেছিলাম শুধু ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়ে কী পারবে? ও কিন্তু আমাকে চমকে দিয়েছে,” বলার সময় তাঁর গলাতেও মুগ্ধতা।

কমনওয়েলথের স্বপ্ন সফল। এ বার সুখেনের লক্ষ্য এশিয়াড। “সমস্যা হল রিকভারির সুযোগ খুব কম। একটা টুর্নামেন্টের পর অন্তত তিন মাস লাগে নিজেকে তৈরি করতে। সেপ্টেম্বরেই তো এশিয়াড। তা ছাড়া ওখানে ইউরোপ আসবে,” বাস্তবের জমিতে মেজর কাম আন্দুলের গ্রামের ছেলে।

এশিয়াডে সফল হতে পারবেন কি না সেটা সময় বলবে। তবে সুখেনের যা মনোভাব তাতে এটা লেখা যায়ই যে তাঁর মোবাইলের অদৃশ্য রিং টোনে বেজেই যাবে, “আমাকে বাঙালি বোলো না, আমাকে বাঙালি বোলো না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন