বেইলির ভুল নাইটদের শেষ শৃঙ্গে তুলে দিল

পুনর্জন্ম? রূপকথা? নাকি আধঘুমে দেখা দিবাস্বপ্ন? যে কোনও একটা পছন্দ করে নিতে পারেন। ৭ মে থেকে ২৮ মেএকুশ দিনব্যাপী ঘটনাপ্রবাহের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষণ বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। যমুনাতীরে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের বিরুদ্ধে নামার আগে টিমটা ছিল যেন মৃত্যুপথযাত্রী। সাতে সাত চাই, নিদেনপক্ষে সাতে পাঁচ, কত না জটিল ক্যালকুলাস, কত না আতঙ্কের হিসেবনিকেশ। আর গঙ্গাতীরে বুধবার যে টিমটা পঞ্জাব-বধের শৌর্যসমেত মাঠ ছাড়ল, তারা যেন জীবনের চলমান সংজ্ঞা।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ০৩:৪১
Share:

ছবি: উৎপল সরকার।

পুনর্জন্ম? রূপকথা? নাকি আধঘুমে দেখা দিবাস্বপ্ন?

Advertisement

যে কোনও একটা পছন্দ করে নিতে পারেন। ৭ মে থেকে ২৮ মেএকুশ দিনব্যাপী ঘটনাপ্রবাহের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষণ বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। যমুনাতীরে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের বিরুদ্ধে নামার আগে টিমটা ছিল যেন মৃত্যুপথযাত্রী। সাতে সাত চাই, নিদেনপক্ষে সাতে পাঁচ, কত না জটিল ক্যালকুলাস, কত না আতঙ্কের হিসেবনিকেশ। আর গঙ্গাতীরে বুধবার যে টিমটা পঞ্জাব-বধের শৌর্যসমেত মাঠ ছাড়ল, তারা যেন জীবনের চলমান সংজ্ঞা।

দু’টোই কেকেআর। সে দিনও। আজও।

Advertisement

মাঝে শুধু আটটা জয়!

প্রত্যাবর্তনের ব্যাখ্যায় যাওয়াটা মূর্খামি। এ জিনিস তো রোজ-রোজ হয় না। এ জিনিস তাই অনুভব করা যেতে পারে। উপভোগ করা যেতে পারে। আর নিজ-নিজ ভাবে খুঁজে নেওয়া যেতে পারে প্রত্যাবর্তনের কারণ। কিছু বেগুনি-সোনালি ফ্রেম দেখে।

পয়েন্ট থেকে পাগলের মতো দৌড় শুরু করছেন গৌতম গম্ভীর, প্রকাণ্ড লাফে উঠে পড়ছেন রবিন উথাপ্পার কোলে! আরে, লং অনে কেকেআরের নতুন সূর্যর গালে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন কে? ওহ্, উনি আর্জেন রবেনের দেশের। কিন্তু আজ উনি ভীষণ ভাবে কলকাতার, আমার-আপনার রায়ান টেন দুশখাতে।

কেকেআর ডাগআউটে ওটা কী চলছে? টিমটা তো চলল ভিকট্রি ল্যাপ দিতে। তা হলে কেকেআর ডাগআউটে কে ওঁরা দুই? লাফিয়ে উঠে বারবার যাঁরা লি-হেশের বিখ্যাত ‘চেস্ট বাম্প’ দিচ্ছেন? ওঁদের একজন বাঙালি, এক জন ক্যারিবিয়ান! দেবব্রত দাস, আন্দ্রে রাসেল।

রাত সাড়ে আটটার ইডেন গ্যালারি বলছে, ওখানে আর একটাও লোক নেই। কিন্তু ইউসুফ পাঠানের হাত তো ব্যথা হয়ে গেল! ‘রেস্ট্রিক্টেড এন্ট্রি’-র কাঁটাতারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পিলপিল করে মাঠে ঢুকে পড়ছে শ’য়ে-শ’য়ে। গম্ভীরের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে না? ইউসুফের সইটাও ম্যানেজ করা আছে! এ সবের মধ্যেই কোথা থেকে দু’বালতি জল মাঠে এসে উপস্থিত এবং সোজা উমেশ যাদবের মাথায়।

নাইট রাইডার্স ফাইনালে! দু’বছর পরে। আবার!

আইপিএলের সাত বছরে আজ পর্যন্ত কম মহার্ঘ্য ম্যাচ দেখেনি ইডেন। গত বছরই আইপিএল ফাইনালে সে শুনেছে কোনও এক সচিন রমেশ তেন্ডুলকর বলে যাচ্ছেন, এই শেষ। আর আইপিএল খেলব না। সে দেখেছে, মধ্যবিত্ত টিম নিয়ে স্বপ্নের দৌড় শেষে আজীবনের মতো ক্রিকেট-কিট তুলে রাখছেন কোনও এক রাহুল শরদ দ্রাবিড়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও আইপিএল ম্যাচ এমন অমরত্বের খোঁজ পায়নি। কোথাও তো কেকেআর ছিল না। কখনও তো ইডেন থেকে সৃষ্ট হয়নি আইপিএল চূড়োয় ওঠার চূড়ান্ত পদক্ষেপ।

আবেগ ছেড়ে ক্রিকেটীয় ব্যাপারে ফেরা যাক। বিখ্যাত ক্রিকেটলিখিয়ে নেভিল কার্ডাস একবার বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড আসলে গাধা। ঠিকই। বুধের ইডেন স্কোরবোর্ড যেমন বলছে, পঞ্জাবের রাজাধিরাজরা কেকেআরের বিরুদ্ধে ম্যাচটাকে কুড়ি ওভার পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছেন। বলছে, একটা সময় গোটা দশেক বলে বাকি ছিল ৩৪— যা টি-টোয়েন্টির পৃথিবীতে কোনও ব্যাপারই নয়। এমন পরিস্থিতি মানে অবশ্যই সেখানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি থাকবে। কিন্তু নির্ভেজাল সত্যিটা হল, এ সবের কিছুই হয়নি।

ফার্স্ট বয় বনাম সেকেন্ড বয়ের সম্মুখ-সংঘর্ষ কখনওই দেখা যায়নি। আর পঞ্জাব মোটেও কুড়ি ওভার পর্যন্ত ম্যাচে থাকেনি। মাত্র ছ’ওভারেই কিংসের যাবতীয় বিক্রম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভুল হল বোধহয়। ঠিকঠাক বললে, পঞ্জাবের অন্তর্জলীযাত্রার চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল টসের সময়ই।

টি-টোয়েন্টির প্রখ্যাত অধিনায়ক বলে জর্জ বেইলির যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের আজ কী হল কে জানে, টস জিতে ফিল্ডিং নিলেন। কলকাতায় গত দু’দিন যে ভাবে তুমুল বর্ষণ চলেছে, বুধের যে কোনও সময়ে আবার নামার যখন পূর্বাভাস প্রবল ভাবে ছিল, তখন পাড়ার ক্রিকেটেও কেউ বোধহয় টস জিতে ফিল্ডিং নেবে না। বৃষ্টির আশঙ্কা ঘাড়ে নিয়ে নামা মানে যে কোনও মুহূর্তে পড়তে হতে পারে ডাকওয়ার্থ-লুইস নামের ‘করিডোর অব আনসার্টেনিটি’-র খপ্পরে। যেখানে একটা উইকেট গেলে টার্গেট বাড়বে চড়চড়িয়ে, ডাগআউটে টেনশন ছড়িয়ে। ইডেন পিচ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করতে গিয়ে বেইলি আকাশের আশঙ্কা ভুলে গেলেন। এবং অবধারিত ভাবে ডুবলেন। পঞ্জাব ব্যাট করতে নামলই ঝিরঝিরে বৃষ্টি নিয়ে। সঙ্গে ডাকওয়ার্থ-লুইসের দুর্বোধ্য সব হিসেব। বীরেন্দ্র সহবাগ গেলেন, ন্যূনতম টার্গেট পাঁচ ওভারে ৩৭। মনন ভোরা গেলেন এবং সেটা সঙ্গে সঙ্গে ছ’ওভারে ৪৯! ম্যাড ম্যাক্স অফস্টাম্পের দিকে সরে ঠিক কী করতে চাইলেন বোঝা গেল না। শুধু ইডেন দর্শক দেখল, চাপে পড়লে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও কোর্টনি ওয়ালশের ব্যাটিংয়ে বিশেষ পার্থক্য নেই! ৭ ওভারে টিমটা ৫৫-৩, পঞ্জাবের গঙ্গাপ্রাপ্তিও ওখানেই সম্পন্ন।

ঘটনা হল, শুধু বৃষ্টির আশীর্বাদে কেকেআর মহাদাপটে সেমিফাইনাল-বৈতরণী পেরিয়ে গেল ভাবলে ভুল হবে। পেরোল, ক্রিকেটের সব ক’টা বিভাগে পঞ্জাবকে পর্যদুস্ত করে। ক্যাপ্টেন্সি যেমন। ব্যাটিং তেমন। এবং অবশ্যই বোলিং।

রাতের দিকে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখা গেল। দু’বছর আগের গম্ভীরদের গ্রাফের সঙ্গে এ বারের নাইটদের তুলনা করা হয়েছে। যেখানে প্লে-অফে দিল্লিকে হারিয়ে সোজাসুজি ফাইনালে চলে গিয়েছিল কেকেআর। বাকিটা ইতিহাস। বাস্তব হল, দু’বছর আগের দিল্লির সঙ্গে যেমন বুধবারের পঞ্জাবের তুলনা চলে না, ঠিক তেমনই ক্যাপ্টেন গম্ভীরের পূর্বের সংসারের চেয়ে বোধহয় বর্তমান অনেক এগিয়ে। নারিন-মর্কেল-উমেশ-পীযূষদের নিয়ে গঠিত কেকেআর বোলিং ফ্র্যাঞ্চাইজি কেন, তাবড়-তাবড় জাতীয় দলের ব্যাটিংয়েও পাগলাঘণ্টি বাজিয়ে দেবে। নারিন এ দিন চার ওভারে ৩০ দিলেন। উইকেট নেই। কিন্তু মর্কেলের দু’টো আছে। উমেশের যাদবের কৃপণ বোলিংয়ে তিনটে আছে। ক্যাপ্টেন গম্ভীর আবার প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ এক ফর্মুলা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। এগারো ওভার যেতে না যেতে দেখা গেল, মর্কেলের চার ওভার শেষ। উমেশের দু’টো। নারিনেরও দু’টো। মিলার তখনও ছিলেন। বেইলি নামেননি। কিন্তু গম্ভীর সাহসটা দেখিয়ে ‘একবার বৃষ্টি নামলেই আমরা জিতছি’-র বন্দোবস্তটা করে ফেললেন। বেইলি যে সাহসটা দেখাতে পারেননি।

ছবি: উৎপল সরকার।

আর ব্যাটিং? বুধবার গম্ভীর-বর্ণিত ‘স্মল স্মল কন্ট্রিবিউশন’-এর দিন। যেখানে রবিন উথাপ্পার আরও একটা চল্লিশোর্ধ স্কোরের যা গুরত্ব থাকল, ঠিক ততটাই থাকল লোয়ার অর্ডারে পীযূষ চাওলার ৯ বলে ১৭-র। কেউ বলতে পারে, পীযুষের শেষ ওভারে পরপর বাউন্ডারিগুলো না থাকলে কেকেআর শেষ পর্যন্ত জিততই জিতত? শুধু একটা ব্যাপার নির্দ্বিধায় বলা যায়। দু’বছর আগের প্লে-অফে যেমন পারেননি বীরেন্দ্র সহবাগ, আজও পারলেন না। সে দিন সহবাগ অধিনায়ক ছিলেন। আজ ইডেন উইকেটে তিনি ছিলেন টিমের সবচেয়ে বিশ্বস্ত যোদ্ধা। কিন্তু দু’বছর আগের মতো আজও সহবাগকে দেখতে হল, দিল্লিওয়ালা সতীর্থর কপালেই জয়তিলক উঠছে। আর অদৃষ্ট তাঁকে আবারও ঠেলে দিচ্ছে দ্বিতীয় প্লে-অফের অনিশ্চয়তার গর্ভে।

তা হলে, এ বার কে? তিন দিন পর কেকেআরকে খেলবে কে? মহেন্দ্র সিংহ ধোনি পারেন। বা আবারও পারেন জর্জ বেইলি-গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

আসুক না, যে আসার আসুক!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

কলকাতা নাইট রাইডার্স ২০ ওভারে ১৬৩-৮ (উথাপ্পা ৪২, কর্ণবীর ৩-৪০)

কিংস ইলেভেন পঞ্জাব ২০ ওভারে ১৩৫-৮ (ঋদ্ধিমান ৩৫, উমেশ ৩-১৩)।

পঞ্জাবের সামনে চেন্নাই

নিজস্ব প্রতিবেদন

আইপিএল সিক্সের ফাইনালে হারের মধুর প্রতিশোধ নিল চেন্নাই সুপার কিংস। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির টিম এলিমিনেটরে সাত উইকেটে হারাল মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে। বুধবার ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে মুম্বইয়ের ১৭৩-৮ টার্গেট আট বল বাকি থাকতেই তুলে দিল সিএসকে। আসন্ন বাংলাদেশ সিরিজে টিম ইন্ডিয়ার নেতা নির্বাচিত হওয়ার দিনই আইপিএল টিমের জয়েও নেতৃত্ব দিলেন সুরেশ রায়না (৩৩ বলে ৫৪ ন.আ)। যোগ্য সঙ্গত ডেভিড হাসির (২৯ বলে ৪০ ন.আ)। ১৮.৪ ওভারে সিএসকে ১৭৬-৩ তুলে জিতে যায়।

ওপেনিংয়ে লেন্ডল সিমন্স (৪৪ বলে ৬৭) আর মাইক হাসির (৩৩ বলে ৩৯) ৭৬ রান তোলার পরও মুম্বইকে ১৭৩ রানে আটকে রাখতে বড় ভূমিকা নেন চেন্নাইয়ের বোলার মোহিত শর্মা (৩-৪২)। জবাবে ব্যাট করতে নেমে আগাগোড়া ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল সিএসকে-র হাতে। ফাইনালে উঠতে সিএসকে-র লড়াই শুক্রবার ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের বিরুদ্ধে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন