আর্জেন্তিনা না ব্রাজিল? জার্সির হাটে ধন্ধে ফুটবল পাগল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বাসে বা ট্রেনে লিওনেল মেসি আর নেইমারদের এখন ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও হাজির মুলার বা আগেরো!
অলিতে-গলিতে রাত জেগে টিভিতে বা জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার সময় গায়ে নীল-সাদা, হলুদ-সবুজ অথবা অন্য কোনও দেশের জার্সি পরাটা এখন নিয়ম করে ফেলেছেন শহরের সমর্থকরা। যেমন দেখা যায় মারাকানা বা এরিনা কোরিন্থিয়াস স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বা সেখানকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা বা নেদারল্যান্ডস সমর্থকদের।
পাড়ায় পাড়ায় প্রিয় দলের জার্সি পরে ঘুরে বেড়ানো বা বাজার করতে যাওয়া বিশ্বকাপের বাজারে এখন স্ট্যাটাস সিম্বল।
বাবা কিনছেন ছেলের জন্য, স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদেরও ঢল ধর্মতলায়। গ্রাম থেকে ক্লাবের দাদারা চাঁদা তুলে নিয়ে আসছেন এক সঙ্গে কুড়ি-পঁচিশটা জার্সি কিনতে। ভিক্টোরিয়া ঘুরতে আসা প্রেমিকা আবদার করে প্রেমিকের থেকে উপহার চাইছেন মেসি-জার্সি, নেইমার-জার্সি।
শুধু ময়দান মার্কেট থেকেই গত এক সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে প্রায় নব্বই হাজারের মতো জাসির্। মার্কেটের দোকান এবং ফুটপাত মিলিয়ে দেড়শো দোকানের মধ্যে আশি শতাংশ-তেই এখন বিভিন্ন দেশের জার্সিতে ছয়লাপ। আশি টাকা থেকে শুরু শেষ আড়াই হাজারে। লুধিয়ানা-ত্রিপুরা থেকে আসা জার্সির দাম কম। ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর মেড হলে দু’-আড়াই হাজার।
বিদেশি জার্সি কলকাতায় বিক্রি যিনি প্রথম চালু করেছেন সেই জ্যাকি স্পোর্টসের জ্যাকিদা বলছিলেন, “’৮০ সাল থেকে বিদেশি জার্সি বিক্রি শুরু করেছি। এরকম ঢল কখনও দেখিনি। মুলার যে দিন হ্যাটট্রিক করেছে তার পর দিন থেকে ওর জার্সি বিক্রি হচ্ছে খুব।” আর ফুটপাতে জার্সি-পতাকা বিক্রিতে ব্যস্ত সাদিক মহম্মদের মন্তব্য, “গতবার সাত হাজার বিক্রি করেছিলাম, এ বার এর মধ্যেই বারো হাজার হয়ে গেছে। মেসি, নেইমার হট কেক।”
বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের এই বিদেশি জার্সি প্রীতির পিছনে রহস্য কী? কেনই বা জার্সি পরার এই প্রবণতা?
এখানকার সমর্থকরাও কি তা হলে বিশ্ব ফুটবল উত্তেজনার শরিক হতে চাইছেন? না কি শুধুই অনুকরণ?
বেশ কয়েক জন বিক্রেতা এবং ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে চৌম্বকে তিনটি কারণ উঠে আসছে। এক) টিভির সৌজন্যে শুধু বিশ্বকাপই নয়, ইপিএল থেকে লা লিগা-- বিদেশি ফুটবল এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। রাত জেগে বাসের্লোনা, রিয়াল মাদ্রিদ বা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখেন সবাই। ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার সমর্থকেরা নিজেদের দলের জার্সি পরে খেলা দেখতে আসেন। করেন নানা সাজাগোজ। সেটা দেখেই বদলাতে শুরু করেছেন এখানকার সমর্থকরা। জার্সি কেনার পাশাপাশি মুখে-রং মেখে সেজে আসাও এখন ময়দানে পরিচিত ছবি। দুই) প্রিয় তারকা বা ক্লাবের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রবণতাও এই আগ্রহের অন্যতম কারণ। তিন) জার্সির দাম নাগালের মধ্যে এসে যাওয়া। তরুণ প্রজন্ম যা চায়।
বিশ্বকাপের বাজারে মেসি বা নেইমারদের জার্সি হয়তো বেশি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু শহরের জার্সি বিক্রির প্রাণকেন্দ্র ময়দান মার্কেটের দোকানিরা জানাচ্ছেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইপিএল বা লা লিগা চলার সময়ও বাসের্লোনা, বায়ার্ন, রিয়াল মাদ্রিদ বা ম্যান ইউয়ের জার্সিও বিক্রি হয় ভালই।
ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকান সমর্থকদের প্রভাব পড়েছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যেও। বিদেশের অনুকরণে কলকাতা লিগ, আই লিগ বা ফেড কাপের সময় দেখা যায় লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন জার্সি পরে গ্যালারিতে ইদানীং দলে দলে আসছেন সমথর্করা। ভাইচুং, ওডাফা, সুনীল ছেত্রী, মেহতাব হোসেনদের জাসির্র নম্বর বা নাম লেখা তাতে। সাত, আট বা নয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসবের তেমন চল ছিল না। চুনী-পিকের কথা ছেড়ে দিন, কৃশানু-বিকাশ বা চিমা-শিশিরের সময়ও এসব কেউ ভাবেননি। কলকাতা ফুটবলে এটা শুরু হয়, নয়ের দশকের শেষ দিকে। আর এখন তো এটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। ফ্যান ক্লাবের লোকজন টুইটারে বা ফেস বুকে সবাইকে বলছে, ‘প্রিয় দলের জার্সি পরে মাঠে আসুন। একসঙ্গে বসে খেলা দেখুন।’ পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার-হাজার লাইক হচ্ছে। যেমন করে থাকেন বিদেশের ক্লাবের সমর্থকরা। যুবভারতী, বারাসত বা কল্যাণীতে ইস্ট-মোহন বা মহমেডান সমর্থকরা মাঠ ভর্তি করে ফেলছেন ক্লাবের জার্সি পরে। বার্সা, রিয়াল-বায়ানর্দের জার্সি বিক্রি হয় ক্লাবের বিপণন কেন্দ্র থেকে। ইস্ট-মোহনের সেই পরিকাঠামোই নেই। ফলে ময়দান মার্কেটে চলে আসেন সমর্থকরা। ময়দান মার্কেটের আর এক বড় জার্সির দোকানের মালিক হাসিবুর রহমান বলছিলেন, “নাইট রাইডাসের্র চেয়ে এখন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের জার্সি বিক্রি হয় বেশি।”
পেলে যখন খেলে গিয়েছিলেন তখন জার্সি কেনার চল ছিল না। কবে থেকে শুরু হয়েছে প্রিয় দল বা তারকার জার্সি পরে খেলা দেখার এই ধুম? শহরে বিদেশি জার্সি বিক্রির পুরোধা জ্যাকিদা জানাচ্ছেন, “’৮৬-তে মারাদোনা নায়ক হওয়ার সময় জার্সি কেনা শুরু হয়েছিল। ২০০৬ থেকে এটা বাড়ে। রোনাল্ডিনহোর জার্সির সে বার দারুণ ডিমান্ড ছিল। মিডিয়ার বিদেশি ফুটবল নিয়ে লেখালিখি, মারাদোনা-মেসি-জিকো-কানরা পরপর কলকাতায় ঘুরে যাওয়ার পর জার্সি কেনার আগ্রহ বেড়েছে শহরে।” তাঁর হিসাব, ২০১০ এর তুলনায় এ বার বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে বাড়ে বিক্রি। ব্রাজিল বা আর্জেন্তিনার বিক্রি বরাবরই বেশি। তবে প্রথম ম্যাচে পাঁচ গোল খাওয়ার পর স্পেনের জার্সি আর বিক্রি হচ্ছে না। বরং বেড়েছে নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানির জার্সি বিক্রি।
মেসি, নেইমারের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন জার্মানির মুলারও। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর রিয়ালের জার্সি বিক্রি হলেও পতুর্গালে জার্সিতে তিনি অনেক পিছিয়ে। রবেনের জার্সি খুঁজতে এসেছিলেন এক নেদারল্যান্ডস সমর্থক। দোকানদার জানতে চাইলেন নম্বরটা বলুন। এই ছবিটা? মুহূর্তে জার্সিতে ছাপা হয়ে গেল ছবি এবং নম্বর।
এ দেশের ফুটবলের যত দূরাবস্থাই হোক, সমর্থকরা কিন্তু আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। অন্তত জার্সি বিক্রির ধুম তাই বলছে।