মঙ্গলবার ইডেনে হতাশ লক্ষ্মীর ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস।
কর্নাটক ৪০৮
বাংলা ২৫১ ও ৪৬-১
যার হয়, তার এমনিই হয়। যার হয় না, তার কখনও কোনও অবস্থাতেই হয় না।
যার হয়, তার ন’নম্বর সেঞ্চুরি করে। যার হয় না তার নয় কেন, গোটা লোয়ার মিলিয়ে দশ ওঠে না। টিমকে বাঁচানোর লক্ষ্যে দায়িত্ব নয়, ক্রিজে এক-একটা মিনিট হয়ে দাঁড়ায় মূর্তিমান আতঙ্ক।
যার হয়, সে সবুজ উইকেটেও চারশো তোলে। ৬৯-৫-এও শিরা-উপশিরায় কম্পন ধরে না। বরং শীতল হিংস্রতায় সে পাল্টা টুঁটি চেপে ধরে প্রতিপক্ষের। যার হয় না, সে একই উইকেটে আড়াইশো করে, মাঠ ছাড়ে ফলো-অনের লাঞ্ছনা নিয়ে।
ক্রিকেটবিশ্বের ঐতিহ্যশালী সব মাঠের মতো ইডেন নিয়েও একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে। বলা হয়, ইডেনে চার দিনের ম্যাচে আদর্শ ব্যাটিংয়ের সুযোগটা থাকে লাঞ্চ থেকে টি পর্যন্ত। উইকেট ওই সময় সহজ থাকে। বল ভাল আসে ব্যাটে। ইডেনের যদি প্রাণ থাকত, সে যদি লিখতে পারত, তা হলে নিঃসন্দেহে মঙ্গলবারের পর সে নিজের সম্পর্কে প্রবাদটা পাল্টে ফেলত।
কারণ বাংলা আজ ঠিক ওই সেশনটাতেই হারিয়েছে সাত-সাতটা উইকেট। মাত্র ৮২ রানের মধ্যে। রানের মৃগয়া দূরে থাক, বাংলা ওই সেশনে আজ ফলো-অন খেল।
শিউরে উঠতে হয় বঙ্গ ব্যাটিংয়ের নমুনা দেখলে। ছ’পয়েন্টের স্বপ্নের অন্তর্জলী যাত্রা গতকালই ঘটে গিয়েছিল। এ দিন প্রশ্নটা ছিল, বাংলা ২৫৯ তুলে ফলো-অন বাঁচিয়ে কর্নাটককে দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে নামাতে পারবে কি না। তা হলে রঞ্জি চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে অন্তত একটা পয়েন্ট নিশ্চিত হত। চারশো তুলে বাংলা তিন পয়েন্ট নেবে, এমন দুরাশা করতে হলে এটাও বিশ্বাস করতে হয় যে, কোনও এক দিন সিআর সেভেনও ইস্ট-মোহনে খেলবেন। বাস্তবে দেখা গেল এক পয়েন্টের আশাতেও গুড়ে বালি। গত বছরের স্বপ্নের ব্যাটিং ফর্ম অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র সঙ্গে এ বার ধারাবাহিক নেই। মনোজ তিওয়ারি দেওধরে এক রকম, রঞ্জিতে সম্পূর্ণ উল্টো। অথচ এমন প্রত্যাশার দিনে এই দুইয়ের কাছ থেকেই কর্নাটককে প্রত্যুত্তরের ইনিংস প্রত্যাশিত ছিল। তা মনোজ করলেন শূন্য, লেংথ বলে ছাড়তে গিয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে এলবিডব্লিউ। লক্ষ্মী করলেন ৬। একটা চার, একটা খোঁচা এবং শেষে এলবি।
আসলে ইডেনে যে দুটো টিম রবিবার থেকে রঞ্জি যুদ্ধে লড়ছে, তাদের মানসিকতায় আলোকবর্ষের তফাত। যার প্রভাব ক্রিকেটের প্রত্যেক অঙ্গে। ফিল্ড প্লেসমেন্টই ধরা যাক। কর্নাটক যখন শেষ উইকেটে ১৪৮ রানের পার্টনারশিপ সৃষ্টি করছে, টিম লক্ষ্মীর তখন যত সময় যাচ্ছে কাঁধ ঝুলছে। ফিল্ড প্লেসমেন্ট হচ্ছে চূড়ান্ত ডিফেন্সিভ।
আজ বাংলাও একটা পার্টনারশিপ তৈরি করেছিল। সুদীপ চট্টোপাধ্যায় আর শ্রীবত্স গোস্বামী মিলে যখন ব্যাটিংটা করছিলেন। কিন্তু বিনয় কুমারকে এক বারের জন্যও দেখা গেল না সাত প্লাস তিনের ফিল্ড প্লেসিং থেকে সরে আসতে। বাউন্ডারি বেরোলে ফিল্ড না ছড়িয়ে উল্টে স্লিপ কর্ডনে লোক বাড়ালেন। গোটা দিন তিনটে স্লিপ, গালি, পয়েন্ট, শর্ট কভার, শর্ট মিড উইকেট বঙ্গ ব্যাটিংয়ের ঘাড়ে তুলে দিলেন কর্নাটক ক্যাপ্টেন।
সঙ্গে মুহূর্মুহু অ্যাপিল। বুঝিয়ে দেওয়া একটা বলের তো ব্যাপার, এখনই তুমি যাবে। চারশো এবং ‘মানসিক নির্যাতনের’ দ্বৈত চাপে রোহন বন্দ্যোপাধ্যায়রা ব্যাটিংয়ের অ-আ-ক-খ পুরোটাই ঘেঁটে ফেললেন। ১০০-১ থেকে ১০১-৩ হল, ক্রমে কুত্সিত হতে হতে ১৭২-৪, ১৮৭-৫, ২২১-৭ এবং ২৫১-এ মৃত্যুশয্যা।
শ্রীবত্স প্রাণপণ একটা চেষ্টা করেছিলেন। যখন ফলো-অন বাঁচাতে ২৫ বাকি, ন’নম্বর ব্যাটসম্যান শূন্য রানে আউট হয়ে গেলেন। শিবশঙ্কর পালকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবধানটা কমাতে কমাতে আটে নিয়ে গেলেন শ্রীবত্স। তাঁর ৬৮ রানের ইনিংস আজ মর্যাদায় ১৬৮-র মতো দেখাত যদি মাঝে সিঙ্গলগুলো নষ্ট না করতেন। শিব তো এগারো নম্বরের মতো ব্যাটিংটা করছিলেন না। শ্রীবত্স না পারলেন শেষ সতীর্থের উপর ভরসা রাখতে, না নিলেন সিঙ্গলস, স্পিনারকে মারতে গেলেন আবার সুইপ, যা অধিকাংশেই এলবির সম্ভাবনা ডেকে আনে। বঙ্গ সংসারের ‘ছোটে’র ইনিংসের পরিণতি চক্রব্যূহে অভিমন্যু বধের মতোই হল।
দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে নেমে বাংলার এখনই একটা চলে গিয়েছে। সামনে পড়ে বুধবারের গোটা দিন, হাতে আর ন’টা। কর্নাটককে আবার ব্যাট করাতে হলে চাই আরও ১১২। এ দিনের উইকেট পতনের প্রবাহের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ওই ১১২ তুলতেই আরও পাঁচটা খসবে কি না, কে জানে। তার পর লিড, তার পর আবার কর্নাটক ব্যাটিং।
বাংলা বাঁচতে পারে দুটো উপায়ে। এক, আলোর ঝামেলা যদি খেলা বন্ধ রাখে। দুই, কারও ব্যাট থেকে যদি আসে অলৌকিক ইনিংস।
কোচ হিসেবে ভিভিএস লক্ষ্মণকে আনা যেতে পারে। কিন্তু তাঁকে তো আর বাংলার জার্সিতে নামানো যাবে না!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
কর্নাটক ৪০৮
বাংলা ২৫১ (শ্রীবত্স ৬৮, সুদীপ ৫৭, অরবিন্দ ৩-৩১, বিনয় ৩-৫৬) ও ৪৬-১ (অরিন্দম ১১ ব্যাটিং, সুদীপ ২০ ব্যাটিং)।
অশোকের উষ্মা
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা
কর্নাটকের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফি ম্যাচে বিপর্যয়ের পর ব্যাটসম্যানদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করলেন বাংলার কোচ অশোক মলহোত্র। বললেন, “টিমের নয়-দশ-এগারোর কাছ থেকে আমি রান আশা করি না। কিন্তু টপ অর্ডার কী করল? পরের ম্যাচ থেকে ওদের দায়িত্ব নিতে হবে।” বাংলার মন্থর রান রেট নিয়ে অশোক বলেন, “আমার হাতে যা প্লেয়ার আছে তাতে এ-ই হবে। এর চেয়ে ভাল কেউ নেই। তাই এর চেয়ে ভাল সম্ভব না।” অশোক রুষ্ট হলেও সিএবি যুগ্ম-সচিব সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু দেখছেন না। বলে দেন, “দুটো ম্যাচ দেখেই গেল-গেল করার মানে নেই। কাল হেরে গেলেও হারব দেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক টিমের কাছে।” ব্যাটিং-বোলিং প্রসঙ্গে সৌরভ বলেন, “সে সব নিয়ে মরসুমের শেষে কথা বলা যাবে।”
এ দিকে, এ দিন আউট হওয়ার পর বাংলা অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল অসন্তোষ প্রকাশ করায় ম্যাচ রেফারির ঘরে তাঁর ডাক পড়ল। তবে লক্ষ্মী নাকি সেখানে বলে দিয়েছেন, তিনি আম্পায়ারদের প্রতি রোষ দেখাননি। নিজের ব্যর্থতার প্রতি দেখিয়েছেন। তাঁকে সতর্ক করা বা শাস্তি দেওয়া হয়নি।